বগুড়ার নন্দীগ্রামে সরিষা ক্ষেতে মধু সংগ্রহের ব্যস্ত সময় পার করছেন বিভিন্ন অঞ্চল থেকে আসা মৌ চাষিরা -যাযাদি
বগুড়ার বিভিন্ন উপজেলায় সরিষা ফুল থেকে মধু সংগ্রহে ব্যস্ত সময় পার করছেন ভ্রাম্যমাণ মৌ-চাষিরা। এর মধ্যে দুপচাঁচিয়া ও নন্দীগ্রাম অন্যতম। এ দুই উপজেলার এক এককটিতে সপ্তাহে প্রায় ৯ থেকে ১০ মণ মধু সংগ্রহ হয়। প্রতিনিধিদের পাঠানো বিস্তারিত খবর-
দুপচাঁচিয়া (বগুড়া) প্রতিনিধি জানান, বগুড়ার দুপচাঁচিয়া উপজেলায় মাঠে মাঠে এখন সরিষার হলুদ ফুলের সমারোহে ভরপুর। প্রতি বছরের ন্যায় এবারও দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে ভ্রাম্যমাণ মৌ চাষিরা উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় সরিষা ফুল থেকে মধু সংগ্রহের জন্য মৌমাছির খামার স্থাপন করেছেন। শুরুর দিকে সরিষার ক্ষতি হবে ভেবে কৃষকরা মৌ বাক্স বসাতে আপত্তি করেন। পরে কৃষি অফিসারের পরামর্শে এখন এলাকায় মৌ চাষ খুব জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে।
এ বছর উপজেলার বিভিন্ন জায়গায় মৌ চাষিরা তাদের শত-শত মৌ বাক্স নিয়ে বিভিন্ন সরিষার জমিতে স্থাপন করেছেন। মৌ চাষিরা বলেন, মধু সংগ্রহের জন্য স্টিল ও কাঠ দিয়ে বিশেষভাবে তৈরি করা হয় এ বাক্স। এর উপরের অংশটা কালো রঙের পলিথিন ও চট দিয়ে মোড়ানো থাকে। বাক্সের ভেতরে কাঠের তৈরি পাঁচ থেকে সাতটি ফ্রেমের সঙ্গে মোম দিয়ে বানানো বিশেষ কায়দায় লাগানো থাকে এক ধরনের সিট। পরবর্তীতে বাক্সগুলো সরিষা ক্ষেতের পাশে সারিবদ্ধভাবে রাখা হয়। পাশাপাশি বাক্সগুলোর ভেতরে দেওয়া হয় রানি মৌমাছি। যাকে ঘিরে আনাগোনা করে হাজারো পুরুষ ও শ্রমিক মৌমাছি। রানির আকর্ষণে সরিষা ফুল থেকে মধু সংগ্রহ করে মৌমাছিরা। একেকটি বাক্সে একটি রানি মৌমাছির বিপরীতে প্রায় দুই থেকে তিন হাজারের মতো পুরুষ ও শ্রমিক মৌমাছি থাকে। মৌমাছিরা ফুল থেকে মধু সংগ্রহ করে চলে আসে ক্ষেতের পাশে স্থাপিত বাক্সেই। ৭ থেকে ১০ দিন পর মৌচাকে নিষ্কাশন যন্ত্র দিয়ে বিক্রির জন্য প্রস্তুত করা হয় মধু। এতে প্রতি ১০দিনে মৌকলনী থেকে প্রতি বাক্সে ৩ থেকে ৪ লিটার মধু সংগ্রহ করেন তারা। মৌসুম শেষে মৌমাছিদের খাবার হিসাবে ডাল ও চিনি মিশ্রিত পানি দেওয়া হয়।
এ নিয়ে কথা হয় সিরাজগঞ্জে উলস্নাপাড়ার মৌ চাষি নজরুল ইসলামের সঙ্গে। তিনি বলেন, অভাব অনটনের কারণে সংসারে খরচ চালানো খুব কষ্ট হচ্ছিল। কোন উপায় না পেয়ে বন্ধুর পরামর্শে ভ্রাম্যমাণ মৌ চাষের উপর ট্রেনিং নেন। এরপর বন্ধুর কাছ থেকে কিছু বাক্স নিয়ে নিজে মৌমাছি দিয়ে মধু সংগ্রহে করেন। ১৩বছর ধরে মধুর সংগ্রহের পেশায় জড়িত। এবার দুপচাঁচিয়ার সাজাপুর এলাকায় নিজস্ব ১২০টি মৌচাকের বাক্স স্থাপন করেছেন। তার মতে আবহাওয়া যদি ভালো থাকে সরিষার ফুল থেকে মৌ খামারের মাধ্যমে তার সব খরচ বাদ দিয়ে মোটা অংকের অর্থ লাভ হবে। প্রতি লিটার মধু ৪শ' টাকা দরে দেশের বিভিন্ন কোম্পানির প্রতিনিধি এসে কিনে নিয়ে যান।
উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা কৃষিবিদ সাজেদুল আলম বলেন, সরিষা ফুল থেকে মৌ চাষের ফলে একদিকে দেশের যেমন মধুর চাহিদা পূরণ হচ্ছে পাশাপাশি সঠিক পরাগায়নের মাধ্যমে জমিতে ফসলের উৎপাদন বৃদ্ধি পাচ্ছে। অন্যদিকে খামারি ও সংশ্লিষ্ট লোকেরা আর্থিকভাবে লাভবান হচ্ছেন।
নন্দীগ্রাম (বগুড়া) প্রতিনিধি জানান, বগুড়ার নন্দীগ্রাম উপজেলার বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে এখন হলুদের সমারোহ। সরিষা ফুলের রূপ এবং গন্ধে মাতোয়ারা চারিদিক। প্রতি বছরের মতো এবারও সরিষা ক্ষেত থেকে মধু সংগ্রহ করতে ব্যস্ত সময় পার করছেন বিভিন্ন অঞ্চল থেকে আসা মৌ চাষিরা।
উপজেলার বিভিন্ন মাঠে সরেজমিন ঘুরে দেখা যায়, সরিষা ক্ষেতের পাশে ফাঁকা জমিতে পোষা মৌমাছির শত শত বাক্সে সাজিয়ে রাখা হয়েছে। মৌমাছির দল উড়ে উড়ে সরিষা ফুলে ঘুরে ঘুরে মধু আহরণ করছে। মুখভর্তি মধু নিয়ে ফিরে যাচ্ছে মৌ খামারিদের মৌ বাক্সে। এভাবে দিনব্যাপী মৌমাছিরা যেমন মধু সংগ্রহ করছে তেমনি ফুলে ফুলে ঘুরে বেড়াতে গিয়ে ওই জমির সরিষা ফুলে পরাগায়ণ করতে সহায়তা করছে মৌমাছির দল।
মৌ চাষিরা জানায়, একটি বাক্সে ৮-১০টি মোম দিয়ে তৈরি মৌচাকের ফ্রেম রাখা হয়। আর মৌ বাক্সের ভেতরে রাখা হয় রানী মৌমাছি। ফুল থেকে মৌমাছিরা মধু এনে বাক্সের ভেতরের চাকে জমা করে। বাক্সের মাঝখানে নিচের দিকে ছিদ্র করে রাখা হয়। সে পথ দিয়ে মৌমাছিরা আসা-যাওয়া করতে থাকে। বাক্সের ভেতরের চাকগুলো মধুতে পরিপূর্ণ হতে সময় লাগে ১০ থেকে ১২ দিন। এরপর মধু চাষিরা বাক্স খুলে চাকের ফ্রেম থেকে মেশিনের সাহায্যে মধু সংগ্রহ করেন।
রাজশাহী জেলার কাটাখালি থেকে আসা মৌ চাষি জারজিস বলেন, 'আমরা ২০ জানুয়ারি নন্দীগ্রামে সরিষা ফুলের মধু সংগ্রহের জন্য এসেছি। আশাকরি ভালো পরিমাণ মধু সংগ্রহ করতে পারব। সরিষা ফুলের জন্য আমরা বগুড়া ও সিরাজগঞ্জ, এলাকাতেই মধু সংগ্রহ করি। এছাড়া ৪-৫ মাস মৌমাছিদের চিনি খাইয়ে রাখতে হয়। বছর শেষে খরচ বাদে ভালো আয় হয়।'
উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা গাজীউল হক বলেন, যে সকল সরিষা ক্ষেতে মধু সংগ্রহ করা হচ্ছে সেই জমিগুলোতে অন্য জমির তুলনায় ১৫-২০ ভাগ ফলন বেশি হবে। কারণ মৌমাছিরা ফুলে পরাগায়ণ করতে সহায়তা করে।