আন্দোলনের কারণে ট্রেন বন্ধ, ভোগান্তিতে যাত্রীরা

প্রকাশ | ২৯ জানুয়ারি ২০২৫, ০০:০০

স্বদেশ ডেস্ক
রেলওয়ে কর্মচারীদের দাবি বাস্তবায়ন না হওয়ায় সোমবার দিবাগত মধ্যরাত থেকে অনির্দিষ্টকালের কর্মবিরতি শুরু করেছেন রেলওয়ে কর্মচারীরা। বিধি মোতাবেক অর্জিত মাইলেজ (পার্ট অফ পে রানিং এলাউন্স) যোগ করে পেনশন ও আনুতোষিক প্রদানের দাবিতে কর্মবিরতিতে পালন করছেন রেলওয়ে কর্মচারীরা। দাবির বিষয়ে ২৭ জানুয়ারি পর্যন্ত সরকারকে সময়সীমা বেঁধে দিয়েছিল বাংলাদেশ রেলওয়ে রানিং স্টাফ ঐক্য পরিষদ (লোকো মাস্টার, গার্ড, টিটিই)। কিন্তু বেঁধে দেওয়া সময় পর্যন্ত এ বিষয়ে কোনো সুরাহা না হওয়ায় কর্মবিরতিতে যেতে বাধ্য হন রেলওয়ের রানিং স্টাফরা। এতে সারাদেশে রেল যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যায়। এদিকে, রেলওয়ের রানিং স্টাফ ও শ্রমিক-কর্মচারীর ডাকে অনির্দিষ্টকালের ট্রেন ধর্মঘটের কারণে সারাদেশে ট্রেন চলাচল বন্ধ রয়েছে। এর ফলে সাধারণ যাত্রীরা চরম ভোগান্তির মধ্যে পড়েছেন। প্রতিনিধিদের পাঠানো খবরে বিস্তারিত- চট্টগ্রাম বু্যরো জানান, দাবি পূরণ না হওয়ায় পূর্বঘোষিত কর্মসূচি অনুযায়ী চট্টগ্রামসহ সারা দেশে কর্মবিরতি পালন করেছে রেলওয়ের রানিং স্টাফরা। এতে চট্টগ্রাম থেকে বন্ধ ছিল ট্রেন চলাচল। ফলে ট্রেন না চলার বিষয়ে আগাম কোনো ঘোষণা না থাকায় সকাল থেকেই যাত্রীরা স্টেশনে এসে বিপাকে পড়েছেন। পস্ন্যাটফর্ম ফাঁকা থাকলেও টিকেট কাউন্টারে দেখা গেছে টাকা ফেরত নিতে যাত্রীদের ভিড়। ভোগান্তিতে পড়া যাত্রীরা রেল কর্তৃপক্ষের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তুলে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। চট্টগ্রাম রেলওয়ে সূত্রে জানা গেছে, মঙ্গলবার সকাল থেকে দুপুর সাড়ে ১২টা পর্যন্ত চট্টগ্রামে মোট সাতটি ট্রেনের শিডিউল বাতিল করা হয়েছে। তবে চট্টগ্রাম থেকে বিভিন্ন রুটে ১৩টি আন্তনগর, ১০টি লোকাল এবং চারটি মেইল ট্রেন চলাচল করে। স্টেশনে গিয়ে সকালে চট্টগ্রাম রেলওয়ে স্টেশনে ট্রেনের অপেক্ষায় অনেক যাত্রীকে বসে থাকতে দেখা গেছে। তারা ট্রেন চলাচলের বন্ধের খবর জানতেন না। মাইকে ট্রেনের শিডিউল বাতিলের ঘোষণার পর যাত্রীরা স্টেশন ছেড়ে চলে যেতে থাকেন। অনেকেই সড়কপথে নিজেদের গন্তব্যে যাত্রা শুরু করেন। সকাল ৮টা থেকে চট্টগ্রাম রেলওয়ে স্টেশনে ট্রেনের অপেক্ষায় বসে ছিলেন সিদ্দিক মিয়া নামে একজন শিক্ষিক। তিনি বলেন, 'জরুরি প্রয়োজনে ঢাকায় যাওয়ার জন্য সুবর্ণ এক্সপ্রেস ট্রেনে অগ্রিম টিকিট কেটে ছিলাম। স্টেশনে এসে দেখি ট্রেন চলাচল বন্ধ। এসব আন্দোলন কারণে সাধারণ জনগণ কেন কষ্ট পাবে' আসিফ নামে স্টেশনে অপেক্ষারত এক যাত্রী জানান, তিনি ঢাকায় যাবেন। কিন্তু ট্রেন বন্ধ থাকায় স্টেশনেই অপেক্ষা করছেন। তিনি বাসে চড়তে পারেন না। তাই ট্রেন যখন ছাড়বে তখন যাবেন। চট্টগ্রাম রেলওয়ে স্টেশন ম্যানেজার মো. মনিরুজ্জামান বলেন, 'রানিং স্টাফদের কর্মসূচির কারণে ৭টি ট্রেনের শিডিউল বাতিল হয়েছে। যাত্রীরা বন্ধের খবর জানতেন না বলে স্টেশনে এসে অপেক্ষা করছিলেন। মাইকে ঘোষণা দেওয়ার পর তারা চলে গেছেন।' এদিকে রেলের বিকল্প হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ রেল রুটগুলোতে যাত্রী পরিবহনের জন্য বিআরটিসি বাস সার্ভিস চালু করা হয়। যেসব ট্রেনের যাত্রা বাতিল হয় সেসব ট্রেনের টিকিটের টাকা যাত্রীদের ফেরত দেওয়া হয়। পাশাপাশি যারা টিকিট বাতিল করেনি তাদের বিআরটিসি বাসে যাতায়াত করার ব্যবস্থা করা হয়। চট্টগ্রাম বিভাগীয় রেলওয়ে ব্যবস্থাপক এবিএম কামরুজ্জামান বলেন, রেলওয়ের পক্ষ থেকে যাত্রীদের ভোগান্তি কমাতে বিকল্প হিসেবে বিআরটিসির বাসের মাধ্যমে সেবা দেওয়া হচ্ছে। তাছাড়া যাত্রী চাইলে টিকিট রিফান্ডের সুযোগ আছে। আর যারা অনলাইনে টিকিট নিয়েছেন তারা অনলাইনে রিফান্ড রিকোয়েস্ট দিয়ে টাকা ফেরত নিতে পারবেন। চট্টগ্রাম বিআরটিসি বাস ডিপোর ম্যানেজার জুলফিকার আলী বলেন, 'ট্রেন চলাচল বন্ধ থাকায় যাত্রীদের জন্য ২০ বাসের ব্যবস্থা করেছি। শুধু ট্রেন যাত্রীদের এ সার্ভিস দেওয়া হয়। ট্রেনের টিকিট দেখিয়ে বাসে উঠতে দেওয়া হয়। বাড়তি কোনও ভাড়া আদায় করা হয়নি।' পাবনা প্রতিনিধি জানান, অনির্দিষ্টকালের কর্মবিরতির কারণে পাবনা থেকে সারাদেশে ট্রেন চলাচল বন্ধ রয়েছে। এতে দুর্ভোগে পড়েছেন যাত্রীরা। মঙ্গলবার সকালে পাবনার ঈশ্বরদী জংশন স্টেশনে গিয়ে দেখা যায়, কিছু যাত্রী না জেনে এসেছিলেন স্টেশনে। ট্রেন বন্ধ থাকায় তারা ফিরে যান। তারপর থেকেই স্টেশনটিতে শুনসান নীরবতা বিরাজ করছে। দিনাজপুর থেকে গতরাতে ট্রেনযোগে ঈশ্বরদী এসেছেন দিনমজুর শ্রমিক আবুল কাশেম। বলেন, 'যাব পোড়াদহ দিনমজুরের কাজে। কিন্তু সকালে ঈশ্বরদী স্টেশনে এসে দেখি ট্রেন বন্ধ। এখন কিভাবে যাব এই চিন্তায় আছি।' আরেক যাত্রী মহিউদ্দিন বলেন, 'গতরাত থেকে যে ট্রেন বন্ধ সেটি জানতাম না। সকালে স্টেশনে আসার পর জানতে পারি। আমি যাব ফরিদপুর। এখন ট্রেন বন্ধ থাকলে কি হবে আমাকে তো যেতেই হবে। বিকল্প কোন গাড়িতে যাব।' রেলওয়ের রানিং স্টাফ ও শ্রমিক কর্মচারী ইউনিয়নের কেন্দ্রীয় কমিটির যুগ্ম সম্পাদক রবিউল ইসলাম জানান, ৮ ঘণ্টা কর্মদিবস হলেও রানিং স্টাফদের গড়ে ১৫-১৮ ঘণ্টা কাজ করতে হয়। এ জন্য তাদের দেওয়া হয় বিশেষ আর্থিক সুবিধা, যাকে রেলওয়ের ভাষায় বলা হয় মাইলেজ। মাইলেজ রানিং স্টাফদের বেতনেরই অংশ। মাইলেজের হিসাব হলো, প্রতি ১০০ কিলোমিটার ট্রেন চালালে রানিং স্টাফরা মূল বেতনের এক বেসিকের সমপরিমাণ টাকা বেশি পাবেন। ৮ ঘণ্টায় একদিনের কর্মদিন ধরলে রানিং স্টাফদের প্রতি মাসে কাজ দাঁড়ায় আড়াই বা দুই-তিন মাসের সমপরিমাণ। তাদের বেতনও সেভাবেই দেওয়া হয়। তিনি বলেন, এ ছাড়া মূল বেতনের হিসাবে অবসরকালীন ভাতা যা হয় তার সঙ্গে অতিরিক্ত আরও ৭৫ শতাংশ টাকা বেশি দিয়ে তাদের পেনশন দেওয়া হয়। কিন্তু ২০২২ সালের জানুয়ারিতে অর্থ মন্ত্রণালয় রানিং স্টাফদের সেই সুবিধা বাতিল করে। এর পর থেকে বাংলাদেশ রেলওয়ের রানিং স্টাফ ঐক্য আন্দোলন করে আসছে। রেলওয়ে গার্ডস কাউন্সিল কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক আফজাল হোসেন বলেন, ২৭ জানুয়ারির মধ্যে মাইলেজ প্রদানসহ সব দাবি পূরণে রেলওয়ে রানিং স্টাফ ঐক্য পরিষদের পক্ষ থেকে রেলওয়ে কর্মকর্তা ও রেল মন্ত্রণালয়কে চিঠির মাধ্যমে বারবার অবহিত করা হয়েছে। আমাদের এ আন্দোলন তিন বছর ধরে চলছে। অথচ কোনো সিদ্ধান্ত নেয়নি রেল কর্তৃপক্ষ। ফলে বাধ্য হয়ে আমাদের এ সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছে। এদিকে স্টেশনে পুলিশী নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে। রেলওয়ে নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা স্টেশনের বিভিন্ন এলাকায় টহল দিচ্ছেন। ঈশ্বরদী জংশন রেলওয়ে স্টেশনের মাস্টার শাজাহান আলী বলেন, 'আমরা স্টেশনে মাইকে যাত্রীদের উদ্দেশে আহবান জানাচ্ছি, যারা অগ্রিম টিকিট কেটেছিলেন, তাদের টিকিট ফেরত দেওয়ার জন্য। কখন ট্রেন চলাচল শুরু হবে আমাদের জানা নেই। আগে থেকে এ বিষয়টি জানাজানি হওয়ায় স্টেশনে যাত্রীদের কোন চাপ নেই।' উলেস্নখ্য, পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়ের পাকশী বিভাগীয় রেলওয়ের তথ্যমতে, এই অঞ্চলে ১০৮টি ট্রেন চলাচল করে। তার মধ্যে আন্তঃনগর ৫৪টি, মেইল ৩৫টি, লোকাল ১৯ এবং মালবাহী ট্রেন চলাচল করে। রংপুর প্রতিনিধি জানিয়েছেন, ঢাকা থেকে ছেড়ে আসা কুড়িগ্রাম এক্সপ্রেসটি মঙ্গলবার সকালে রংপুর রেলওয়ে স্টেশনে পৌঁছায়। ট্রেনটি রংপুরে আটকে আছে। গন্তব্যস্থল কুড়িগ্রামে আর যেতে পারেনি। ফলে ট্রেন যাত্রীরা বিপাকে পড়েছেন। বিভিন্ন গন্তব্যের যাত্রীরা ট্রেনের অপেক্ষায় রংপুর রেলওয়ে স্টেশনে অপেক্ষা করছেন। রংপুর থেকে কুড়িগ্রামের চিলমারীতে যাওয়ার জন্য রংপুর রেলওয়ে স্টেশনে অপেক্ষমাণ শামিলা বেগম বলেন, তার পরিবারের ৫ জন সকাল ৭টা থেকে অপেক্ষা করছেন। ট্রেনের জন্য গন্তব্যে যেতে পারছেন না। একই অভিযোগ, রংপুর অঞ্চলের বিভিন্ন স্থানে যাওয়ার জন্য অপেক্ষমাণ অসংখ্য যাত্রীর। রংপুর রেলওয়ে স্টেশন তত্বাবধায়ক শংকর গাঙ্গুলি বলেন, আন্তনগরসহ ১৫টি গন্তব্যে যাওয়া ট্রেনসহ সব ট্রেন চলাচল বন্ধ রেখেছে আন্দোলনকারীরা। ঢাকা থেকে ছেড়ে আসা কুড়িগ্রাম এক্সপ্রেসটি রংপুরে সকালে এসে আটকে পড়েছে। ঝিনাইদহ প্রতিনিধি জানান, সোমবার মধ্যরাতের পর থেকেই সারা দেশের ন্যায় ঝিনাইদহের উপর দিয়ে রেল চলাচল বন্ধ রয়েছে। ফলে চরম ভোগান্তি পড়েছেন যাত্রীরা। মঙ্গলবার সকালে যাত্রীরা স্টেমনে এসে জানতে পারেন রেল বন্ধের বিষয়টি। এ দিকে, রেলের রানিং স্টাফদের কর্মবিরতির কারণে মঙ্গলবার সকাল থেকে ঝিনাইদজ কালীগঞ্জ ও কোটচাদপুর উপজেলায় ৫টি স্টেশন রয়েছে। এরমধ্যে মেবারকগঞ্জ, কোটচাঁদপুর ও সাফদারপুর স্টেশনে ঢাকা ও রাজশাহীগামি ট্রেনের স্টপিস রয়েছে। ফলে আগে থেকে ক্রয় করা ট্রেনের শিডিউল অনুযায়ী মঙ্গলবার স্টেশনের এসে রেল বন্ধের সংবাদ জানতে পারেন যাত্রীরা। ফলে উপায় না পেয়ে টিকিটের টাকা ফিরিয়ে নিয়েছেন। এতে চরম ভোগান্তিতে পড়েন দূরপালস্নার শত শত যাত্রীরা। কালীগঞ্জ মোবারকগঞ্জ রেলস্টেশনে কথা হয় মোমিনুর রহমান নামে এক যাত্রীর সঙ্গে। তিনি বলেন, 'বিশেষ একটি কাজে খুলনায় যাওয়ার উদ্দেশে স্টেশনে এসেছিলাম। কিন্তু এখানে এসে জানতে পারি ট্রেন চলাচল বন্ধ। এখন ফিরে যাচ্ছি।' সাঈদ নামের এক ছাত্রী তিনি বলেন, 'সকালে স্টেশনে গিয়ে জানতে পারি ট্রেন বন্ধ। এখন গন্তব্যে যেতে হলে বাস ছাড়া আর কোন উপায় নেই।' এদিকে কালীগঞ্জের মোবারকগঞ্জ স্টেশন মাস্টার মো. শাহজাহান বলেন, সকালে কিছু যাত্রী স্টেশনে এসেছিলেন। তাদের বুঝিয়ে টিকিটের টাকা ফেরত দেওয়া হচ্ছে।