বরগুনার বেতাগীতে বিষখালী নদীতে ডিঙ্গি নৌকায় মাছ ধরায় ব্যস্ত জেলে -যাযাদি
ডিঙ্গি নৌকায় ভেসে বিষখালী নদীতে বড়শি দিয়ে মাছ শিকার করাই তাদের পেশা। শিকার করা মাছ বিক্রি করে যা আয় হয় তা দিয়েই চলে দেশের উপকূলীয় জনপদ বরগুনার বেতাগী পৌরসভার ৪নং ওয়ার্ডের বাসিন্দা সোহরাব হাওলাদারের পরিবার। এখানে তার মতো আরও অনেকেই আছেন, যাদের সংসার চলে শুধু মাছ শিকার করে।
বলা যায় মাছ শিকারই তাদের জীবন-জীবিকা ও প্রায় সারা বছর মাছ ধরে বা বেঁচেই কাটে তাদের জীবনধারা। অন্য কোন কাজ করেন না তারা। একই অবস্থা পৌর এলাকার হিরন হাওলাদার, আব্দুস সালাম ও মো. কবিরসহ অনেকের।
এখানে নৌকায় চেপে নিয়মিত মাছ শিকার করেন সোহরাব হাওলাদার। কথা হয় তার সঙ্গে। তিনি বলেন, বড়শিতে মাছ শিকার করেই চলছে তার এবং তারই মতো আরও বহু পরিবারের জীবন-সংসার। জীবিকার প্রয়োজনে দিন নেই, রাত নেই সব ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগ উপেক্ষা করে বছরের পর বছর ধরে শুধু মাছ শিকার করেই চলেছেন। এখন এটাই পেশা, এটাই নেশা। এর রোজগার দিয়েই স্ত্রী, ছেলে-মেয়েদের পড়ালেখাসহ সংসার চলে তার। এমন কাজে জীবন পার করে দিলেও এদের অনেকে কিন্তু স্বীকৃত জেলে বা মৎস্যজীবী নন। এদের বিশেষ আর কোন পরিচয়ও নেই। অথচ মাছ ধরেই তারা জীবিকা নির্বাহ করেন।
তারই কথার মাঝে আরেকজন মৎস্য শিকারি লাভলু মিয়া এসে আগ বাড়িয়ে বলেন, বছরের এ সময়টাই আসলে মাছ শিকারের জন্য। এ সময় অন্য পেশার লোকজনও এসে শামিল হন মাছ ধরায়। কেউ কেউ আবার নিজে খাওয়ার জন্যও শখের বশে মাছ ধরে থাকেন। পরে আবার ফিরে যান নিজ কর্মস্থলে।
বাস্তবে উপার্জনের অন্য কোনো উপায় না থাকায় এ উপজেলায় বড়শির সুতোয় বাঁধা পড়ে আছে সোহরাবের মতো ৬ থেকে ৭ শতাধিক পরিবারের জীবন ও জীবিকা। কারণ বড়শি বেয়েই চলছে তাদের জীবিকা।
তাদের সঙ্গে শিশুরাও মাছ শিকার করে।
বেতাগী পৌরসভার ৪নং ওয়ার্ডের বাসিন্দা এমনই দুই শিশু রাফসান ও সিয়াম। এরা জানায়, 'সবার দেখাদেখি নেমে পড়েছি। মাঝে মধ্যে বড়শিতে ভালো পরিমাণে মাছ পাই। বেশিরভাগ সময়ই চিড়িং মাছ ধরা পড়ে।'
স্থানীয় জেলেরা জানান, কয়েক বছর আগেও এখানকার খাল-বিল ও নদ-নদীতে পাঙ্গাস, শিলল, গাঁগড়া, রিটা, কাউন, পোয়া, আইড়, ফাহা, পাবদা, সরপুঁটি ও কোরালের মতো বিভিন্ন প্রজাতির মাছ সচারচার পেতেন। এখন গলদা চিড়িং মাছ ছাড়া ওইসব মাছের দেখা মেলে কম।
সোহরাব হাওলাদারের মতো বেতাগী পৌরসভার ৮নং ওয়ার্ডের বাসিন্দা হেলাল ২নং ওয়ার্ডের বাসিন্দা ইলিয়াস, ১নং ওয়ার্ডর বাসিন্দা সাহেব আলী, একই ওয়ার্ডের শহিদুল ইসলাম, কনক, ৭নং ওয়ার্ডর মেহেদী হাসান, রুবেলসহ উপজেলার বিবিচিনির বাড়ই খাল, বিবিচিনি খেয়াঘাট, ফুলতলা খাল, গাবুয়া খাল, ছোট ঝোপখালী, কেওয়াবুনিয়া, বেতাগী খাল, কেওড়াবুনিয়া, ঝিলবুনিয়া, ছোট মোকামিয়া খাল, মোকামিয়া লঞ্চঘাট, বেতাগী খালের স্স্নুইজগেট এলাকাসহ বিভিন্ন এলাকার খাল, বিষখালী নদী এবং বেড়েরদোন নদীর বিভিন্ন পয়েন্টে বড়শিতে মাছ শিকারে সংসার চলে শত শত পরিবারের জীবন।
তারা বড়শির টোপে লালশো বা গেছে লাল পিঁপড়ের ডিম, এ্যাকাঙ্গি, মহুয়া ফুল, পুরনো মধু, মিষ্টির বাসি রস, আটাসহ বিভিন্ন ধরনের মসলা ব্যবহার করে মাছ শিকার করেন। গলদা চিংড়ি ধরতে কেঁচোই ব্যবহার করেন অনেকে। তবে সময়ের পবিবর্তনে কাজের ধরণ কিংবা মাছ ধরার কৌশল পরিবর্তন হলেও যেন পরিবর্তন নেই এদের জীবন-মানের। বড়শিতে বাঁধাই এদের জীবন-সংসার। এ
\হসময়ে নদীতে গলদা চিংড়ি, আইড়, পোয়া, বোয়াল, পাঙ্গাস, কোরালসহ মিঠা পানির বিভিন্ন মাছের পাশাপাশি নদীতে ধরা পড়ছে।
স্থানীদের সঙ্গে বিষখালী নদীর একাধিক পয়েন্টে বড়শিতে মাছ শিকারে এসেছেন বামনা, কাঠাঁলিয়া, রাজাপুর, বাকেগরঞ্জ উপজেলার অনেক মাছ শিকারি। কাঁঠালিয়া উপজেলার শৌলজালিয়া গ্রামের সাহারুল খান ও মিলন দাস জানান, ২৫-৩০ বছর ধরে বড়শিতে মাছ শিকার করছেন তারা।
বড়শিতে মাছ শিকার করেই ছেলে মেয়ের পড়াশুনার পাশাপাশি সংসার চলে তাদের। জমি-জমা না থাকায় ছোট থেকেই এই পেশায় জড়িয়ে আছেন তারা।
বেতাগী সরকারি কলেজের এইসএসসির পড়ুয়া ছেলে কামরুল হাসানের লেখাপড়ার খরচ চলে বড়শিতে মাছ শিকারের টাকায়। বাবা আলতাফ হোসেন লেখাপড়া না জানলেও মাছ শিকারে ওস্তাদ। অনেকে প্রায়শই খালি হাতে ফিরলেও তার ডোল মাছে ভরে যায়। মাছ শিকার শেষে তা শহরে বিক্রি করেন। দৈনিক আয় তার ৪শ' থেকে ৮শ' টাকা। কখনো আবার ভাগ্য সুপ্রসন্ন হলে বড়শিতে বড় মাছ পেলে ৭ থেকে ৮ হাজার টাকাও আয় করেন তিনি।
বিষখালী নদীর মাঝ খানে জেগে ওঠা ছৈলার চরের শাখা খালে নৌকা নোঙ্গর করা পঞ্চার্ধো আব্দুর রহিম জানায়, পানির সঙ্গে লড়াই করে বেঁচে থাকতে হয় তাদের। তবে বড়শিতে মাছ শিকারই তাদের বেঁচে থাকার প্রধান অবলম্বন। কিন্ত আগের সব মাছ যেন হারিয়ে গেছে, এখন আর নদী-খালে দেখা যায় না।
উপজেলার কালিকাবাড়ি এলাকার সোহেল মিয়া জানান, চরের অনেক কাঁকড়া শিকারিও এ সময় বড়শিতে মাছ শিকার করছেন। মাঘ ও ফাল্গুনে এদের অনেকে আবার বাগদার রেণুও ধরেন থাকেন।
অবশ্য আগের তুলনায় আবহাওয়ার পরিবর্তন, রেণু পোনা নিধন, মা ইলিশ শিকার, নদী ভরাট, নিষিদ্ধজাল ব্যবহারসহ বিভিন্ন কারণে নদীতে মাছ এখন দুষ্প্রাপ্য হয়ে পড়েছে। শিকরির বড়শিতেও মিলছে না তেমন আর মাছ। ফলে কাটছে দুর্বিষহ জীবন এখানকার অনেক পরিবারের।
তবে এই প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকে জেলে তালিকাভুক্ত করার মাধ্যমে সুযোগ-সুবিধার আওতায় আনা প্রয়োজন বলে দাবি করেন উপজেলার জেলে প্রতিনিধি ও মৎস্যজীবী সমবায় সমিতির সভাপতি আব্দুর রব সিকদার।