ঢাকার পাশ্ববর্তী জেলা মানিকগঞ্জের সিংগাইরে বছরের ১২ মাসই শাকসবজি উৎপাদন করেন কৃষকরা। স্থানীয় চাহিদা মিটিয়ে এসব শাকসবজি রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায়ও সুনাম বিস্তার করে আসছে। বিশেষ করে শীতকালীন মৌসুমে শাকসবজিতে ভরে থাকে উপজেলার প্রতিটি পাড়া, মহলস্নার কৃষি জমিগুলো। উৎপাদন করা হয় নতুন নতুন সবজি। যার ফলে একদিক দিয়ে যেমন স্থানীয় পুষ্টি পূরণ করছে, তেমনি দেশের অর্থনীতিতে রাখছে বিশেষ অবদান। ফলে সিংগাইরে দিন দিন বেড়ে চলছে সবজির আবাদ। উপজেলার প্রতিটি এলাকার কৃষক শাকসবজি আবাদে এখন ব্যস্ত সময় পার করছেন। এ বছর শাকসবজির উৎপাদন বেশি করতে চান স্থানীয় কৃষকরা।
উপজেলায় পূর্ব ভাকুম গ্রামের আকরাম হোসেন নামের একজন কৃষক জানান, প্রতি বছরই তিনি সবজির চাষাবাদ করেন। সবজি বিক্রির টাকা দিয়ে তার সংসার ভালো চলছে। এ বছর উপজেলা কৃষি অফিস থেকে তাকে রঙিন ফুলকপির প্রণোদনা দেয়। তারপর ৬ শতাংশ জমিতে এই রঙিন ফুলকপি আবাদ করেন। গত বুধবার পর্যন্ত রঙিন ফুলকপি বিক্রি করেছেন ৬ হাজার টাকার মত। জমিতে আরও যে কপি রয়েছে তা বাজারে বিক্রি করতে পারবেন ১২-১৫ হাজার টাকা মতো। তিনি বলেন, বাজারে এই বেগুনি রঙের ফুলকপির চাহিদা রয়েছে। সাধারণ ফুলকপির তুলনায় এতে পুষ্টি অনেক বেশি এবং দেখতে সুন্দর হওয়ায় সহজেই ভালো দামে বিক্রি করা যায়।
উপজেলা কৃষি অফিস সূত্রে জানা যায়, সিংগাইর উপজেলার আবাদি জমিনের পরিমাণ ১৬ হাজার ২৪৫ হেক্টর। এর শুধুমাত্র সবজিই চাষাবাদ হয় ৪ হাজার ৮২৫ হেক্টরে। এবছর উপজেলায় শীতকালীন সবজির লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ১ লাখ ৫৪ হাজার ৩শ' মেট্রিকটন, যার বাজারমূল্য প্রায় ৩৫৪ কোটি ৯০ লাখ টাকার মত।
কৃষককরা জানান, উপজেলাজুড়ে লালশাক, পালং শাক, গাজর, পেঁপে, ফুলকপি, বাঁধাকপি, মিষ্টি কুমড়া, শিম, বেগুন, কচু, মটর শাক, টমেটো কলা, আলু, কাঁচা মরিচ, স্কোয়াশ, ব্রকোলি, লাউ, মটরসুঁটি, ধনিয়া পাতা, খেসারি শাক, পেঁয়াজ বরবটিসহ অসংখ্য প্রজাতির দেশীয় শাক-সবজির চাষাবাদ হয়ে থাকে। তবে এ সব শাকসবজি সরকারিভাবে সংরক্ষণের ব্যবস্থা না থাকায় নায্যমূল্য থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন স্থানীয় কৃষক। গত বুধবার সকাল থেকে সারাদিন ব্যাপি উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় ঘুরে এবং স্থানীয় কৃষকদের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য পাওয়া যায়।
বুধবার সকালে উপজেলার রায় দক্ষিণ গ্রামের ঢুকতেই চোখে পড়ে অর্ধশতাধিক লোকজন নিয়ে একটি বাড়ির উঠানে বসে কৃষি বিষয়ক ক্লাস নিচ্ছেন সিংগাইর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা হাবিবুল বাশার চৌধুরী। এ সময় ক্লাস শেষে কথা হলে তিনি জানান, এটি কৃষি অধিদপ্তরের পার্টনার ফিল্ড স্কুল ও কৃষক সেবা কেন্দ্র। এখানে কৃষকদের সমস্যা এবং পুষ্টি বিষয়ক আলোচনা সমন্ধে হাতে কলমে শেখানো হয়। উপজেলায় এমন স্কুল রয়েছে ৬টি। প্রতিটি স্কুলে ২৫ জন করে কিষাণী রয়েছেন। এ সময় উপস্থিত ছিলেন স্থানীয় কৃষি অফিসের কর্মকর্তারা।
স্কুলে থাকা সুমি আক্তার নামের এক কৃষাণী বলেন, 'আগে সংসারের জন্য নিজেদের জমিতে টুকিটাকি কৃষি কাজ করতাম। এই পুষ্টি স্কুল চালু হওয়ার পর থেকে বাড়ির আঙিনায় চাষাবাদ করছি এবং কি পুষ্টি চাহিদা পূরন করতে হয় সেটাও শিখছি। এমন স্কুল বিশেষ করে গ্রামবাংলার প্রতিটি উপজেলায় দরকার। একজন মা যদি পুষ্টি উৎপাদন জানে তখন তার সন্তান ও পরিবারের কেউ পুষ্টিহীনতায় ভুগবে না।'
কথা হয় উপজেলার জয়মন্ডব এলাকার কোহিনূর ফকির নামের এক কৃষককের সঙ্গে। তিনি নিজের চাষাবাদকৃত বেগুনের জমি পরিদর্শন করে দেখান। সেখানে গিয়ে দেখা যায় মাঝারি আকৃতির বেগুন গাছে ঝুলে আছে ছোট, মাঝারি, বড় বেগুন। দেখে প্রাণ জুড়িয়ে যায়। কৃষক কোহিনূর ফকির জানান, এবছর উপজেলা কৃষি অফিস থেকে ২০ শতাংশ জমিতে বেগুন চাষাবাদ করার জন্য প্রণোদনা দেয় তাকে। ২০ শতাংশের সঙ্গে তিনি আরও ৬০ শতাংশ বন্ধক রাখেন অন্য আরেকজনের কাছ থেকে। মোট ৮০ শতাংশ জমি বন্ধক রেখে প্রথমেই তিনি দুই দফা লাল শাক করেন। লাল শাক বিক্রি করে পান প্রায় ৯০ হাজার টাকা মতো। পরবর্তীতে বেগুন চাষাবাদ করে বুধবার পর্যন্ত ৬০ মণ বেগুন বিক্রি করছেন। জমিতে থাকা বাকি বেগুন হবে ১০০ মণের উপরে, যা বাজারে ৭০-৮০ হাজার টাকার বেশি দামে বিক্রি করতে পারবেন। বেগুন চাষাবাদের পাশাপাশি তিনি পেঁপে গাছও লাগিয়েছেন। বাজারে দাম ভালো থাকলে এ জমি থেকে প্রতি বছর ৮ থেকে ৯ লাখ টাকার সবজি বিক্রি করা যাবে।
কৃষি অধিদপ্তরের পার্টনার প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক(পিডি) মিজানুর রহমান 'যায়যায়দিন'কে বলেন, আপনি যে সব পার্টনার ফিল্ড স্কুল (পুষ্টি উপরে) দেখেছেন সেগুলোতে শতভাগ মহিলা শিক্ষার্থী। আমাদের দেশে পুষ্টিহীনতা একটা বড় সমস্যা। পুষ্টি বিষয়টা পুরোপুরি দেখেন এই দেশের মহিলারা, যার কারণে এই পার্টনার প্রকল্পের পুষ্টি ভিত্তিক ফিল্ড স্কুলে ১০টি সেশনে কি ভাবে পুষ্টিকর খাবার উৎপাদন করা যায় তা হাতে কলমে শেখানো হচ্ছে।