সরকারি নিয়মের তোয়াক্কা করে না তারা

সরকারি প্রাথমিকের শিক্ষকদের সন্তানেরা পড়েন কিন্ডারগার্টেনে!

প্রকাশ | ৩১ জানুয়ারি ২০২৫, ০০:০০

ইমরান হোসাইন লিখন, বগুড়া
গ্রাম্য ভাষায় প্রবাদ রয়েছে যে, 'নিজেরটা ১৬ আনা, আর অন্যেরটা ঠন ঠনাঠন ঠন'। এই প্রবাদটি যেনো শতভাগ মিলে গেছে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের ক্ষেত্রে। নিজের সন্তান ও অন্যের সন্তানের মধ্যে বৈষম্য সৃষ্টিতে এই শিক্ষকরাই সবথেকে এগিয়ে। কারণ নিজের সন্তানকে উচ্চ শিক্ষিত করার লক্ষ্যে উপজেলা ও জেলা শহরের বিভিন্ন কিন্ডারগার্টেন এবং বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পড়তে দিয়ে অন্যের সন্তানকে কোনভাবে দায়সাড়া পাঠদান করে সময় পার করছেন তারা। আর মাস শেষে পকেটে তুলছেন কারি কারি টাকা। সারাদেশেই একই চিত্র। তবে বগুড়ায় আরও চোখে পরার মত। বগুড়ায় সর্বমোট প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সংখ্যা এক হাজার ৬০১টি। এসব বিদ্যালয়ে, প্রধান শিক্ষক রয়েছেন ৯৮৬ জন ও সহকারী শিক্ষক ৮ হাজার ২৪২ জন। অর্থাৎ প্রায় অর্ধেক পরিমান প্রধান শিক্ষক নিয়ে চলছে বিদ্যালয়গুলো। যায়যায়দিনের এই প্রতিবেদকের দীর্ঘ কয়েক মাসের অনুসন্ধানে উঠে এসেছে ভিন্ন চিত্র। এতে দেখা গেছে- প্রাথমিকের শিক্ষকদের প্রায় ৮০ শতাংশ সন্তানদের বিভিন্ন কিন্ডারগার্টেন ও বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তি করানো হয়েছে। সেখানে প্রতিমাসে মোটা অংকের টাকা গুনতে হয়। অর্থাৎ নিজের সন্তানকে বেসরকারিতে দিয়ে অন্যের সন্তানদের সরকারিতে ভর্তি করতে মানুষের দ্বারে দ্বারে ঘুরে বেড়াচ্ছেন সরকারি শিক্ষকরা। অভিভাবকদের শোনানো হচ্ছে নানা ধরনের নীতিবাক্য। তবে কোথাও কোথাও সন্তানদের ক্ষেত্রে এমন বৈষম্যের কারণে তোপের মুখেও পড়তে হচ্ছে তাদের। এসব নানাবিধ কারনে প্রতিবছর সরকারি প্রাথমিকে কমে যাচ্ছে শিক্ষার্থী সংখ্যা। শুধু তাই নয়, সন্তানদের পড়ালেখা করানোর জন্যই জেলা শহরের বিলাশবহুল বাড়ি ভাড়া নিয়ে বসবাস করেন অসংখ্য শিক্ষক। এ কারনে স্কুল ফাঁকিতেও শীর্ষে রয়েছেন তারা। কারন প্রতিদিন জেলা শহর থেকে উপজেলা পর্যায়ের বিদ্যালয়গুলোতে নির্দিষ্ট সময়ে কখনোই পৌছাতে পারেন না তারা। এছাড়া ট্রেননির্ভরশীল শিক্ষক রয়েছেন অনেক। তাদের ট্রেনযোগে স্টেশনে পৌঁছে আবার রিকশা, অটোরিকশাসহ বিভিন্ন যানবাহনে বিদ্যালয় পর্যন্ত পৌঁছাতেই দুপুর হয়ে যায়। সেখান থেকে বাসায় ফেরার জন্য ট্রেনের সময়সূচি অনুযায়ী বেলা ২টার মধ্যেই স্টেশনে পৌঁছাতে হয়। ট্রেনে যাতায়াতের মধ্যে শীর্ষে রয়েছেন সোনাতলা উপজেলায় কর্মরত শিক্ষকরা। এ ছাড়া অন্য উপজেলার স্কুলেও নির্দিষ্ট সময়ে পৌঁছাতে পারেন না শহরে বসবাসকারী শিক্ষকরা। অনিয়মের সঙ্গে জড়িত শিক্ষকরা সাধারণত শিক্ষা কর্মকর্তা ও সহকারী শিক্ষাকর্মকর্তাদের ম্যানেজ করেই এসব অনিয়ম করে থাকেন। নেপথ্যে রয়েছে অর্থনৈতিক লেনদেন। বিভিন্ন সময় বগুড়া শহরের বিভিন্ন হোটেল রেস্তোরা ও ঘরোয়া বৈঠকে এসব লেনদেনের আলোচনা করতে দেখা গেছে শিক্ষক ও কর্মকর্তাদের। বিগত সময়ে শিক্ষকদের সন্তানকে নিজ প্রতিষ্ঠান অথবা সরকারি প্রাথমিকেই পড়ালেখা করানোর জন্য একটি পরিপত্র জারি করা হয়েছিল। এছাড়া ২০২৪ সালের ১৮ অক্টোবরে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ড. আব্দুল হাকিম খুলনা জেলা প্রশাকের কার্যালয়ে আয়োজিত এক কর্মশালায় বলেন, প্রাথমিক শিক্ষার সঙ্গে জড়িত সব কর্মকর্তা ও শিক্ষক-শিক্ষিকার সন্তানদের অবশ্যই সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়া নিশ্চিত করতে হবে। কারো সন্তান কিন্ডারগার্টেন বা অন্য কোনো বিদ্যালয়ে পড়ার প্রমাণ পেলে তাকে দূরে কোথাও বদলি করা হবে। একই কথা দপ্তরের বিভিন্ন কর্মকর্তাদেরও বলতে শোনা গেছে। কিন্তু এসবে তোয়াক্কা না করে নিজেদের ইচ্ছেমতো কিন্ডারগার্টেনসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে ভর্তি করেছে সন্তানদের। এ বিষয়ে বিভিন্ন শিক্ষানুরাগি ও শিক্ষক, অভিভাবকসহ সচেতনমহল বলেন, আমরা নিজেদের সন্তানকে নিজেরাই বিপদে ফেলছি। কারন শিশুদের যে মেধা ধারণ ক্ষমতা তার চেয়ে কয়েকগুন বেশি চাপ সৃষ্টি করে শিশুদের মানসিক বিকারগ্রস্ত করছি। শিশুদের কি ধরনের পড়ালেখা করানো যাবে তা অনেক গবেষণা করেই সরকার একটি অবকাঠামো তৈরি করেছে এবং সেই পরিমান শিক্ষা উপকরণ নির্ধারণ করেছে। কিন্তু অর্থ হাতিয়ে নিতে নিজেদের ইচ্ছেমতো অসংখ্যা কিন্ডারগার্টেন তৈরি করে ব্যাবসার ফাঁদ সৃষ্টি করে অহেতুক এক বোঝা বই কাঁধে তুলে দেওয়া হচ্ছে কোমলমতি শিশুদের। আমরা অভিভাকরা এসবে অনেকটাই হিপনোটাইজ হয়ে গেছি। বিশেষ করে সরকারি প্রাথমিকের শিক্ষদের সন্তানদের এসবে ভর্তি করে শিক্ষার পরিবেশ আরও নষ্ট করে ফেলেছে। অতি দ্রম্নত এগুলোকে একটি নিয়মের মধ্যে নেওয়া দরকার। তা নাহলে আগামীতে প্রাথমিক শিক্ষাখাতকে আরও চরম হুমকির মুখে ফেলবে। এ বিষয়ে বগুড়া জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা রেজোয়ান হোসেন বলেন, 'শিক্ষকদের বিরুদ্ধে আমরা কঠোর পদক্ষেপ হাতে নিচ্ছি। আমরা কোনও অনিয়মকেই ছাড় দেব না। এ ছাড়া আপনার মাধ্যমে যেসব তথ্য জানতে পারলাম এতে আমাদের কার্যক্রম আরও ত্বরান্বিত করবে। বিশেষ করে ট্রেন নির্ভরশীল শিক্ষদের বিরুদ্ধে আমরা দ্রম্নত ব্যবস্থা গ্রহণ করব। কারণ সময় মতো বিদ্যালয়ে না পৌঁছালে তাদের কোনভাবেই ছাড় দেওয়া হবে না। সে সঙ্গে অনিয়মের সঙ্গে জড়িত শিক্ষা কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।