ভেজাল ছত্রাকনাশকে পেঁয়াজ ক্ষেতে পচন, চরম ক্ষতিতে চুয়াডাঙ্গার চাষিরা

প্রকাশ | ০৪ মার্চ ২০২৫, ০০:০০

রেজাউল করিম লিটন, চুয়াডাঙ্গা
ছত্রাকের আক্রমণ থেকে পেঁয়াজের গাছ ভালো রাখতে ক্ষেতে ছত্রাকনাশক স্প্রে করেছিলেন চাষিরা। ভালো তো দূরের কথা, সেই কীটনাশকে নষ্ট হয়েছে পেঁয়াজের ক্ষেত। পচন ধরে নষ্ট হয়ে গেছে বিঘার পর বিঘা পেঁয়াজ। মাথায় হাত চাষিদের। চুয়াডাঙ্গার দামুড়হুদা উপজেলার জাহাজপোতা গ্রামের কৃষক সেলিম উদ্দিন। তিন বিঘা জমিতে পেয়াজের চাষ করেছেন। এই চাষে লাখ টাকা খরচ যোগাতে নিজের পোষা গরু বিক্রি করেন। আশা ছিল এবার পেঁয়াজের ফলন ও দামে বেশ লাভবান হতে পারবেন। তার এ স্বপ্ন কেড়ে নিয়েছে কীটনাশক কোম্পানী। মার্শাল কোম্পানীর য়োকরাল কীটনাশক স্প্রে করে পেঁয়াজ গাছে লেগেছে পচন। তার মতো একই অবস্থা কিষানী রেবেকা আক্তার রুনার। পেঁয়াজের সঙ্গে সাথী ফলস হিসেবে চাষ করা কচু, কলাগাছও মরে গেছে। উপজেলার জাহাজপোতা, হুদাপাড়া, হরিরামপুর, মুন্সিপুর মাঠে ১৬ জন কৃষকের প্রায় ২০ বিঘা জমির পেঁয়াজ মার্শাল কোম্পানীর কীটনাশক স্প্রে করে এভাবে পচন লেগে নষ্ট হয়ে গেছে। হুদাপাড়া গ্রামের কীটনাশক বিক্রেতার কাছ থেকে মার্শাল কোম্পানীর য়োকরাল নামের কীটনাশক কিনে ক্ষেতে স্প্রে করেছিলেন কৃষকরা। সরেজমিন উপজেলার ভারত সীমান্তবর্তী কার্পাসডাঙ্গা ইউনিয়নের কয়েকটি গ্রামের মাঠ ঘুরে দেখা গেছে, ২০ জন পেঁয়াজ চাষি তাদের ক্ষেতে মার্শাল এগ্রোভেট কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ উৎপাদিত য়োকরাল নামক ছত্রাকনাশক স্প্রে করেন। এর ফলে তাদের প্রায় ৩০ বিঘা জমির পেঁয়াজ পচে সম্পূর্ণ নষ্ট হয়ে গেছে। এতে তারা প্রায় কোটি টাকার ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছেন। চাষিরা জানিয়েছেন, তাদের ক্ষতির পরিমাণ কোটি টাকার মতো। বিঘা প্রতি পেঁয়াজ চাষে তাদের ৫০-৫৫ হাজার টাকার মতো খরচ হয়েছে। অপরদিকে তাদের ফলন হওয়ার কথা প্রতি কাঠায় ৮ মণ হিসাবে বিঘায় প্রায় ১৬০ মণ। গড়ে ২ লাখ টাকার উপরে তাদের মুনাফা হতো। আর মাত্র এক মাস পরেই তাদের উৎপাদিত পেঁয়াজ ওঠার কথা। এখন তাদের মাথায় হাত। এমন অবস্থায় ছেলে-মেয়ে নিয়ে তারা পথে বসে পড়েছেন। তার উপরে আছে বিভিন্ন এনজিও এবং মহাজনের কাছ থেকে চড়া সুদে নেওয়া ঋণের বোঝা। জাহাজপোতা গ্রামের পেয়াজ চাষি কৃষক সেলিম বলেন, 'আড়াই লাখ টাকার গরু বিক্রি করে পেঁয়াজ চাষ করেছিলাম, আমার যে অপূরণীয় ক্ষতি হয়েছে তা পূরণ হওয়ার নয়। আমার ৮ লাখ টাকার ক্ষতি হয়েছে। সাড়ে তিন বিঘা পেঁয়াজের জমিতে মার্শাল কোম্পানীর য়োকরাল কীটনাশক প্রয়োগ করেছিলাম। আমি এখন মহাজনের এবং এনজিওর ঋণের কিস্তি কিভাবে পরিশোধ করবো, সেটা ভেবেই চরম অনিশ্চয়তার মাঝে এখন দিন কাটছে আমার। পার্শ্ববর্তী হরিরামপুর গ্রামের আরিফুলের দোকান থেকে কীটনাশক কিনে ব্যবহার করি। কোম্পানীর লোক ক্ষতিগ্রস্ত পেঁয়াজের জমি দেখে গেছে। ক্ষতিপূরণ দেওয়ার কথা থাকলেও না দিয়ে কালক্ষেপণ করছেনা দিলে উচ্চ পর্যায়ে অভিযোগ করব।' জাহাজ পোতা গ্রামের ফয়সালের স্ত্রী রেবেকা রুনা কান্না জড়িত কন্ঠে জানান, 'আমিও আড়াই লাখ টাকা দামের গরু বিক্রি করে দেড় বিঘা জমিতে পেঁয়াজ চাষ করেছিলাম। হুদাপাড়া গ্রামের সারের দোকানদার ইমরানের কাছ থেকে কেনা য়োকরাল বিষ দিয়ে আমার জমিরও পুরো পেঁয়াজ পুড়ে শেষ হয়ে গেছে। আমি এখন পথে বসে গেছি, আমার কি হবে আমি এর বিচার চাই।' এ বিষয়ে জানতে দোকানী আরিফুলের সঙ্গে কথা বললে তিনি বলেন, 'আমার এ বিষের ডিলার কার্পাসডাঙ্গা বাজারের ব্রীজ মোড়ের কীটনাশক দোকানী হাসিবুর। আপনি তার সঙ্গে কথা বলেন। আমি শুনেছি এলাকায় আরও অনেক কৃষকের ক্ষতি হয়েছে। কোম্পানি তালিকা করে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার প্রতিশ্রম্নতি দিয়েছে।' এ বিষয়ে কোম্পানির ডিলার হাসিবুরের সঙ্গে কথা বললে তিনি নিজের দায় এড়িয়ে বলেন, 'আমি কিছু জানি না, কোম্পানীর লোক সব বলতে পারবে। কোম্পানীর বড় বড় অফিসার এটা দেখছে। আপনি এই কোম্পানীতে কর্মরত লোকনাথপুর গ্রামের আরিফের সঙ্গে কথা বলেন।' কোম্পানীর ফিল্ড অফিসার আরিফুলের সঙ্গে কথা বললে তিনি জানান, 'আমরা মাঠে তদন্ত করে একটা তালিকা করেছি। ক্ষতিপূরণ দেওয়ার ব্যবস্থা করা হবে। তাছাড়াও আমাদের কীটনাশকে ক্ষতি হয়েছে কিনা তার পরীক্ষা চলছে, ক্ষতি হলে আমরা দেখব।' হুদাপাড়া গ্রামের য়োকরাল ছত্রাকনাশক বিক্রেতা ইমরান আলী বলেন, 'আমার কাছ থেকে দুইজন চাষি য়োকরাল বিষ কিনেছেন। তাতে ক্ষতি হয়েছে কিনা বলতে পারব না, তবে কোন কোন কৃষকের ক্ষতি হয়েছে এটা আগের য়োকরালেও হতে পারে। কোম্পানির লোকজন মাঠে গিয়েছে। ডেমো করে তাদের ক্ষতিপূরণ দেয়ার তালিকা করেছে এবং তারা ক্ষতিপূরণ পাবে বলে আমি শুনেছি।' কার্পাসডাঙ্গা ইউনিয়নের উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা মামুন জানান, 'আমরা মাঠ তদন্ত করেছি। ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের বলেছি কোম্পানী ক্ষতিপূরণ না দিলে আমাদের উপজেলা কৃষি অফিসে লিখিত অভিযোগ করতে। আমরা কৃষকের পাশে থাকব।' হুদাপাড়া গ্রামের মৃত নিশিন্দ হালসনার ছেলে মহত আলীর দেড় বিঘা, মৃত সাহাদতের ছেলে ফয়সালের স্ত্রী রেবেকা রুনার দেড় বিঘা, মৃত নাসির কেয়ারের ছেলে কালো কয়ালের ১০ কাঠা, আলিবদ্দিনের ছেলে সাগরের ১০ কাঠা, মৃত ভগার ছেলে খোকনের ১০ কাঠা, দয়লা মোড়লের ছেল লিটনের ১৫ কাঠা, কার্পাসডাঙ্গার এম.মফিজুর রহমানের ছেলে সাঈদের ১৬ কাঠা, জাহাজপোতা গ্রামের শরীফ উদ্দিনের ছেলে সেলিম উদ্দিনের সাড়ে ৩ বিঘা, মৃত আবেদিনের ছেলে আব্দুর রাজ্জাকের দেড় বিঘা, হরিরামপুরের শাহজাহান আলী ডাক্তারের ছেলে ছাবদারের ২ বিঘা, মুন্সীপুরের কৃষক আব্দুর রাজ্জাকের ২ বিঘা জমির পেয়াজ সম্পূর্ন পচে নষ্ট হয়ে গিয়েছে। উলেস্নখিত গ্রামগুলির বেশিরভাগ কৃষক তাদের শতকরা ৬০ থেকে ৭০ ভাগ জমিতে পেয়াজচাষ করে থাকেন। কারন এই এলাকার জমি সাধারনত পেয়াজ চাষের জন্য অত্যন্ত উপযোগী। দামুড়হুদা উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা শারমিন আক্তার জানান, 'আমরা শুনেছি এবং সরেজমিন ক্ষতিগ্রস্ত মাঠ পরিদর্শন করেছি। ঘটনার সঙ্গে জড়িত কীটনাশক কোম্পানির কর্মকর্তাদের ডেকে কথা বলেছি, তারা আমাদের প্রতিশ্রম্নতি দিয়েছেন ক্ষতিগ্রস্ত কৃষককে ক্ষতিপূরণ দেওয়া হবে। আমি আশা করব তারা শিগগিরই ক্ষতিপূরণ দিবে। না হলে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।'