নরসিংদীর রায়পুরায় পাকা রাস্তার অভাবে এভাবেই যাতায়াতে দুর্ভোগ পোহাচ্ছেন উপজেলার দূর্গমচরাঞ্চল নদীবেষ্টিত মির্জাচর ইউনিয়নবাসী -যাযাদি
স্বাধীনতার বিগত ৫৪ বছরে বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে ব্যাপক পরিবর্তনের ছোঁয়া লেগেছে বাংলাদেশেও। কিন্তু দূর্ভাগ্যবশত আজোও সেই অন্ধকার যুগে, অনুন্নত ও অবহেলিতই রয়ে গেছে একটি ইউনিয়ন। স্বাধীনতার ৫৪ বছরে ১ ইঞ্চি রাস্তাও পাকাকরণ হয়নি। ২০২৫ সালে এসেও ১২ টি গ্রামের প্রায় ১৫ হাজার মানুষের ভরসা মাটির রাস্তা ও বর্ষা মৌসুমে নৌকা। জন্মের পর থেকেই যোগাযোগ ক্ষেত্রে কষ্ট তাদের জীবন সঙ্গী। সেই নরসিংদীর রায়পুরা উপজেলার দূর্গমচরাঞ্চল নদীবেষ্টিত জনপদ মির্জাচর ইউনিয়নবাসীর কথা শুনা বা বলার যেন কেউ নেই। যোগাযোগ ব্যবস্থার কারণে প্রতিনিয়তই কমছে শিক্ষার হার। বৃদ্ধি পাচ্ছে গোষ্টিগত দাঙ্গা-হাঙ্গামা।
সরেজমিনে গিয়ে জানা যায়, ২৪টি ইউনিয়ন ও একটি পৌরসভা নিয়ে গঠিত রায়পুরা উপজেলা। আর এ উপজেলারই প্রায় ৮ বর্গ কিলোমিটার আয়তন নিয়ে অবস্থিত মির্জারচর ইউনিয়ন। এখানে ১২টি গ্রামের প্রায় ১৫ হাজার মানুষ বসবাস করছে। নারী-পুরুষসহ ভোটার রয়েছে প্রায় সাড়ে ৯ হাজার। এ ইউনিয়নের কোথাও এক ইঞ্চি পাকা সড়ক নেই। একটি ইটের সলিং চোখে পড়লেও সেগুলোর ইট উঠে গেছে অনেকাংশে। প্রয়োজনীয় সেতু-কালভার্ট নেই। ইউনিয়নের ১২ গ্রামে যাতায়াতের রয়েছে প্রায় ১৬ কিলোমিটার রাস্তার কোথাও পাকা নেই। পুরো ইউনিয়নে একটি মোটর সাইকেল চোখে পড়লেও আর কোন রিক্সা, ভ্যানগাড়ি বা যাতায়াতের এমন কোন কিছুই চোখে পড়েনি। ইউনিয়ন থেকে অন্য কোথাও যেতে হলে দীর্ঘপথ হেঁটে ও নৌকায় নদী পার হয়ে যেতে হয়। কষ্টের সঙ্গেই বসবাস ইউনিয়নবাসীর।
ইউনিয়নের লোকজন বলেন, বৃষ্টি হলে কাদামাটি দিয়ে চলাচল করতে হয়। জুতা পরে রাস্তায় চলা যায় না। সারাদেশে উন্নয়নের কথা শুনলেও তারা চোখে দেখেননি। তাদের রাস্তাঘাটের কোনো উন্নয়ন হয়নি। প্রাকৃতিক দুর্যোগপ্রবণ ইউনিয়ন এটি। মেঘনা থেকে সৃষ্ট যেকোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগ প্রথমে আঘাত হানে ইউনিয়নের বিভিন্ন গ্রামে। এখানকার বাসিন্দাদের দুঃখ-কষ্টের শেষ নেই। এখানকার মানুষগুলো কত কষ্টে আছে সেটা যারা আসেননি, তারা অনুভব করতে পারবেন না।
মির্জারচর উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষিার্থী মুক্তা আক্তারসহ আরও কয়েকজন শিক্ষার্থী বলেন, 'আমরা অনেক দূর থেকে হেঁটে স্কুলে আসি। অনেক কষ্ট হয়। রাস্তা ভালো হলে আমাদের কষ্ট কম হতো।'
স্থানীয় ইউপি সদস্য অহিদ মেম্বার বলেন, 'আমাদের ইউনিয়নে এক ইঞ্চি পাকা রাস্তা নেই। উপজেলা সদরে যাইতে আমাদের কষ্ট হয়। ছেলে-মেয়ের ডেলিভারী হতে পারে না এবং অসুস্থ রোগীকে নিয়েতে পারি না। এখানে রাস্তা করে দিলে অনেক উপকার হতো।'
সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান আব্দুর রহিম বলেন, 'বাংলাদেশের মধ্যে মির্জারচরের মতো এমন অনুন্নত ইউনিয়ন আর কোথাও নেই। নদী ভাঙনের কথা নাই বা বললাম।'
মির্জারচর উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক বিলস্নাল হোসেন বলেন, 'রায়পুরা উপজেলার সবচেয়ে অবহেলিত গ্রাম এবং ইউনিয়ন মির্জারচর। এখানে একটি মাত্র মাধ্যমিক উচ্চ বিদ্যালয় সেটি হলো মির্জারচর উচ্চ বিদ্যালয়। এখানে ৮শতাধিক শিক্ষার্থী থাকলেও নিয়মিত পাওয়া যায় ৫শ'। বাকীগুলো পার্শ্ববর্তী ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার নবীনগরে চলে যায়। সেখানে ৮ কি.মি. দূরত্ব হলেও পাকা রাস্তা থাকায় তারা নদী পরা হয়ে বিভিন্ন যানবাহনে সহজে যেতে পারে। এই বিদ্যালয়ে অবকাঠামো, কম্পিউটার ল্যাব, ডিজিটাল ক্লাস রুম, মানসম্মত শিক্ষক এবং বিদ্যালয়ের পরিবেশ সব কিছু অনেক ভালো থাকা স্বত্তেও শুধু যোগাযোগ ব্যবস্থা ভালো না হওয়া আমরা পিছিয়ে পড়ছি। এই ইউনিয়নে সড়ক ব্যবস্থার উন্নতি হলে শিক্ষা ব্যবস্থা সহ সার্বিক মান উন্নয়ন হবে।'
মির্জাচর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মাহফুজা আক্তার বলেন, 'একটি এলাকার উন্নয়নের জন্য আগে যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নত করতে হবে। সেটি আমাদের নেই। বিশেষ বরাদ্দ দিয়ে মির্জারচরকে যোগাযোগ ব্যবস্থার আওতায় আনার দাবি জানাই।'
স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের (এলজিইডি) রায়পুরা উপজেলা প্রকৌশলী মাজেদুল ইসলাম সজিব বলেন, উপজেলার ৬টি ইউনিয়ন নদী দ্বারা বেষ্টিত। এই চরাঞ্চলগুলোতে যোগাযোগ ব্যবস্থা খুব একটা উন্নত না, স্পেশালি মির্জারচর ইউনিয়নে এলজিইডি কর্তৃক একটিও পাকা রাস্তা করা হয়নি। এখানে আমাদের এলজিইডির গ্যাজেটভুক্ত রাস্তা আছে প্রায় ১৬ কিলোমিটারের মতো। মূল প্রতিবন্ধকতাটা হচ্ছে এই ইউনিয়নটা নদী বেষ্টিত এবং এখানে ব্রিজ না থাকার কারনে এটার এক্সেসটা বা এক্সসের সুফলটা পাচ্ছে না। চরাঞ্চলের উন্নয়নের জন্য ব্যাপক একটা মাস্টার পস্নান ছিল। মাস্টার পস্নানের আলোকে রায়পুরার মেইন নদী পান্তশালা ঘাটে বড় একটা ব্রিজ আমাদের দরকার। সেটা হচ্ছে ১৪৭০ মিটার।
আমি যতটুকু জানি চায়না অর্থায়নে হওয়ার কথা। এই ব্রিজটা যখন হবে তখন রায়পুরাবাসী চরাঞ্চলের জন্য যুগান্তকারী একটি ঘটনা ঘটবে। বাশগাড়ী জিসি টু মির্জারচর জিসি, বাশগাড়ী জিসি টু চরমধুয়া জিসি, পাড়াতলী ইউনিয়নের বকটরিয়াকান্দি থেকে কালিকাপুর এবং চরআড়ালিয়া ইউনিয়নের মাছিমপুর ফেরিঘাট। এই ৪টি ব্রিজই আমাদের ডিপিবি অন্তর্ভক্ত করা আছে এবং একনেকে উঠার অপেক্ষায় আছে। আমি আশা করি বর্তমান সরকারের আমলেই এই ৪টি ব্রিজসহ ১৪৭০ মিটার ব্রিজ একনেকে অনুমোদিত হবে।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মাসুদ রানা বলেন, মির্জারচর খুবই একটা অবহেলিত ইউনিয়ন হিসেবে পরিগনিত হয়েছে। বিভিন্ন মাধ্যমে খবর পেয়েছি এখানে সেরকম কোন উন্নয়নমূলক কর্মকান্ড হয় নাই। আমরা চেষ্ঠা করবো পরবর্তিতে উন্নয়ন বিভিন্ন কর্মসূচী আসছে সেগুলো অগ্রাধিকার ভিত্তিতে যেন মির্জারচরে দেওয়া হয়। সেখানে বিভিন্ন মসজিদ, মন্দির, মাদরাসা, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সহ রাস্তাঘাটের ব্যাপক একটা উন্নয়ন কর্মসূচী যেন নেওয়া যায় সে প্রেক্ষিতে আমরা উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নিকট লিখবো এবং স্থানীয় সরকার ও উপজেলা পরিষদের তহবিল থেকে সেখানে যথেষ্ঠ পরিমান বরাদ্ধ দেওয়ার চেষ্ঠা করবো। ইতিমধ্যে টি.আর, কাবিখা একটি বরাদ্ধ আমরা সংশ্লিষ্ট ইউনিয়ন পরিষদে পাঠিয়েছি এবং তাকে নির্দেশও দেওয়া হয়েছে সে যেন এই বরাদ্ধ থেকে এখানে উলেস্নখ্যযোগ্য পরিমান গ্রামীণ অবকাঠামো উন্নয়ন ঘটানো হয়।