পাহাড়ি ঢল ও বাঁধ ভেঙে দেশের নিম্নাঞ্চল পস্নাবিত

হ খুলে দেয়া হয়েছে তিস্তা ব্যারাজের ৪৪ গেট হ ভাঙনে নদীতে বিলীন ঘরবাড়ি ফসলি জমি হ তিস্তা ও মাতামুহুরীর পানি বিপদসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হ পানিবন্দি লাখো মানুষ

প্রকাশ | ১২ জুলাই ২০১৯, ০০:০০

স্বদেশ ডেস্ক
কক্সবাজারের মাতামুহুরী নদীর পানি বৃদ্ধিতে পস্নাবিত হয় বিস্তীর্ণ এলাকা -যাযাদি
উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢল, তিস্তা ব্যারাজের ৪৪টি গেট খুলে দেয়া, অবিরাম বর্ষণ, বিভিন্ন নদীর পানি বেড়ে যাওয়া ও বাঁধ ভেঙে নিম্নাঞ্চলসহ দেশের বিভিন্ন স্থান পস্নাবিত হয়েছে। নদীভাঙনে বিলীন হয়েছে বহু বাড়িঘর ও আবাদি জমি। পানিবন্দি ও আশ্রয়হীন হয়ে পড়েছে হাজার হাজার মানুষ। রাস্তাঘাট ক্ষতিসাধিত হওয়ায় সৃষ্টি হয়েছে ব্যাপক জনদুর্ভোগ। আমাদের প্রতিনিধি ও সংবাদদাতাদের পাঠানো রিপোর্ট : গাইবান্ধা: কয়েকদিনের টানা বৃষ্টি ও উজান থেকে আসা ঢলে গাইবান্ধার তিস্তা, ব্রক্ষপুত্র ও যমুনাসহ নদনদীর পানি বৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে। পানি বৃদ্ধির কারণে জেলার সদর, সুন্দরগঞ্জ, ফুলছড়ি ও সাঘাটা উপজেলার চরাঞ্চল ও নিম্ন্নাঞ্চলের বেশ কিছু গ্রামে পানি ঢুকে পস্নাবিত হয়েছে। পানিতে তলিয়ে গেছে গ্রামীণ কাঁচা রাস্তাঘাট, পাট, মরিচসহ বিভিন্ন ফসলের জমি। এছাড়া এসব এলাকার অন্তত ১ হাজার পরিবারের বসতভিটেয় বন্যার পানি ঢুকে পড়েছে। পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকায় চরাঞ্চল ও নিম্ন্নাঞ্চলের মানুষ বন্যা আতষ্কে ভুগছেন। এছাড়া পানি বৃদ্ধির ফলে বেশ কিছু এলাকায় নদীভাঙন তীব্র আকার ধারণ করছে। এতে দিশেহারা হয়ে পড়েছেন তীরবর্তী এলাকার মানুষ। ভাঙনে গত ১৫ দিনে বিলীন হয়েছে সুন্দরগঞ্জ, সদর ও ফুলছড়ি উপজেলার অন্তত পাঁচ শতাধিক বসতভিটা, আবাদি জমি, গাছপালাসহ বিভিন্ন ফসলের জমি। অন্যদিকে নদীভাঙনে বসতভিটা হারিয়ে নিঃস্ব মানুষ আশ্রয় নিচ্ছেন বাঁধসহ উঁচু এলাকায়। অনেকে ভাঙনের কবল থেকে রক্ষা পেতে ঘরবাড়ি সরিয়ে এবং সহায় সম্বল নিয়ে ছুটছেন অন্য এলাকায়। উঁচু জায়গায় ও অন্যের বাড়িতে আশ্রয় নেয়া কর্মহীন এসব মানুষ অনেকে খেয়ে না খেয়ে দিনাতিপাত করছেন। শাহজাদপুর (সিরাজগঞ্জ): সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুর উপজেলার রাউতারা নবনির্মিত রিং বাঁধটি দুই দফায় দুই স্থানে কেটে দিয়েছে স্থানীয় অসাধু মৎস্যজীবী ও নৌকাচালকরা। ফলে শাহজাদপুর উপজেলার পশ্চিম এলাকার ৩টি ইউনিয়নসহ চলনবিল অঞ্চলের ৯ উপজেলার বিস্তীর্ণ এলাকা বন্যাকবলিত হয়ে পড়েছে। এ বন্যার পানিতে পস্নাবিত হয়ে পড়েছে এ এলাকার বিস্তীর্ণ ফসলের মাঠ ও গো-বাথান। ফলে কৃষকরা তাদের গবাদি পশু বাড়িতে নিয়ে রেখেছে। কাঁচা ঘাসের মাঠ বন্যার পানিতে ডুবে যাওয়ায় এ এলাকায় গো-খাদ্যের দাম বস্তা প্রতি ২০০-৩০০ টাকা করে বেড়ে গেছে। ফলে এ অঞ্চলের গো-খামার মালিক ও গবাদি কৃষকেরা তাদের গবাদি পশুর খাদ্য নিয়ে চরম বিপাকে পড়েছেন। কাউনিয়া (রংপুর) : ভারত গাজল ডোবায় পানির প্রবাহ বেড়ে যাওয়ায় বাংলাদেশের ডালিয়া পয়েন্টে তিস্তার পানি বিপদসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। তিস্তায় অস্বাভাবিক পানি বৃদ্ধির কারণে রংপুরের কাউনিয়ার তিস্তার তীরবর্তী ও চরাঞ্চলের গ্রামগুলোতে বন্যা দেখা দিয়েছে। নদীর তীরবর্তী অনন্ত ৫ শতাধিক মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। এদিকে তিস্তায় প্রবল স্রোতে নবনির্মিত তিস্তা সড়ক সেতুর গাইড বাঁধে ধস দেখা দেয়ায় ভাঙনের আশঙ্কায় রয়েছে এলাকাবাসী। ডালিয়া পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী রবিউল ইসলাম জানান, ভারতে টানা বর্ষণের কারণে ভারত গাজল ডোবায় তিস্তায় পানি বিপদসীমা কাছ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। সেখানে অস্বাভাবিক পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় তিস্তার ডালিয়া ব্যারাজ পয়েন্টে পানি হু হু করে বাড়ছে। তিনি বলেন, উজান থেকে নেমে আসা ঢলে নদীর পানির প্রবল স্রোতের কারণে তিস্তা ব্যারাজের ৪৪টি গেট খুলে দেয়া হয়েছে। ফলে ভাটিতে পানি বেড়েছে ও ব্যারাজ এলাকার ভাটির চরাঞ্চলের গ্রামগুলোতে বন্যা দেখা দিয়েছে। রাজারহাট (কুড়িগ্রাম) : গত চার দিন ধরে অবিরাম বর্ষণ এবং উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে তিস্তা নদীর পানি হু হু করে বৃদ্ধি পাচ্ছে। ফলে কুড়িগ্রামের রাজারহাট উপজেলার ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া তিস্তার চরাঞ্চলসহ নিম্নাঞ্চলের পাঁচ হাজার মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। এদিকে পানি বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে প্রবল স্রোতে শুরু হয়েছে তীব্র নদীভাঙন। ইতোমধ্যে নদীর তীরবর্তী চরাঞ্চলের ২০টি বাড়ি ও কয়েক বিঘা ফসলি জমি নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। কয়েকদিন আগে বিদ্যানন্দ ইউনিয়নের হংসধর কালিরহাট এলাকায় নদীভাঙন রোধে জিও ব্যাগ ফেলা হয়। সে কারণে নদীর পশ্চিমাঞ্চলের তীর এলাকায় নতুন করে ভাঙন দেখা দেয়। শেরপুর : অবিরাম বর্ষণ ও পাহাড়ি ঢলে শেরপুরের ঝিনাইগাতী উপজেলার ৩টি ইউনিয়নের নিম্ন্নাঞ্চল পস্নাবিত হয়েছে। গত তিন দিনের টানা বর্ষণ ও ভারত থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে মহারশী ও সোমেশ্বরী নদীর পানির স্র্রোতে তীরবর্তী বাঁধ ভেঙে ঝিনাইগাতী উপজেলার ঝিনাইগাতী সদর, ধানশাইল ও কাংশা ইউনিয়নের প্রায় ৩০টি গ্রামের নিম্নাঞ্চল পস্নাবিত হয়েছে। এতে চরম ভোগান্তিতে পড়েছে ব্যবসায়ী ও স্থানীয়রা। পানিবন্দি হয়ে পড়েছে শত শত মানুষ। পস্নাবিত এলাকার রাস্তাঘাট, ছোট ছোট পুল কালভার্ট, কাঁচা-পাকা বাড়িঘরের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। এছাড়া ভারী বর্ষণে নদীর পানি বৃদ্ধি পেয়ে ঝিনাইগাতী বাজার ও বাড়িঘরে প্রবেশ করতে শুরু করেছে। বর্ষণ এবং উজানের পানি অব্যাহত থাকলে দুই-এক দিনের মধ্যে ঝিনাইগাতি উপজেলা পরিষদসহ পুরো বাজার এলাকা তলিয়ে যাওয়ার আশংকা করছে স্থানীয়রা। চকরিয়া (কক্সবাজার): টানা ভারী বৃষ্টি ও পাহাড়ি ঢলে কক্সবাজারের চকরিয়ার নিম্নাঞ্চল পস্নাবিত হয়েছে। এতে উপজেলার অভ্যন্তরীণ সড়ক তলিয়ে যাওয়ায় পানিবন্দী রয়েছেন লক্ষাধিক জনসাধারণ। গত শুক্রবার থেকে চকরিয়া, পার্বত্য জেলা বান্দরবানের লামা ও আলীকদমে মুষলধারে বৃষ্টিপাত শুরু হয়। এ বৃষ্টির পানি রাতের দিকে মাতামুহুরী নদী দিয়ে ভাটির দিকে চলে আসে। এ সময় নদীর দুই কূল উপচে সুরাজপুর-মানিকপুর, কাকারা, লক্ষ্যারচর, বরইতলী, সাহারবিল, চিরিংগা, কৈয়ারবিল ও উপকূলীয় সাত ইউপি ও পৌরসভার একাংশসহ বেশকটি ইউপির শতাধিক গ্রাম ডুবে রয়েছে। বরইতলি ইউপি চেয়ারম্যান জালাল আহমদ সিকদার ও কোনাখালী ইউপি চেয়ারম্যান দিদারুল হক সিকদার বলেন, সাত দিনের টানা বৃষ্টিতে এলাকার বেশির ভাগ নিম্নাঞ্চল ঢলের পানিতে তলিয়ে গেছে। অভ্যন্তরীণ সড়কগুলোও বর্তমানে ঢলের পানির নিচে রয়েছে। এতে যোগাযোগ ব্যবস্থা ব্যাহত হচ্ছে। কলমাকান্দা (নেত্রকোনা) : নেত্রকোনার কলমাকান্দা উপজেলা বিরামহীন বৃষ্টি ও পাহাড়ি ঢলে উপজেলার ৮টি ইউনিয়ন পস্নাবিত হয়েছে। পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন প্রায় ২ শত গ্রামের লোকজন। বন্যার পানি সর্বত্র ঢুকে পড়ায় সর্বস্তরের মানুষের দুর্ভোগ চরম আকার ধারণ করেছে। খেটে খাওয়া মানুষের দুর্ভোগ অধিকতর বৃদ্ধি পেয়েছে। পাশাপাশি গো-খাদ্য সমস্যা প্রকট আকার ধারণ করেছে। হাতীবান্ধা (লালমনিরহাট) : লালমনিরহাটে হাতীবান্ধা উপজেলায় ভারী বর্ষণ ও উজান থেকে নেমে আসা পানির ঢলে তিস্তা ও ধরলা নদীর চর অঞ্চলগুলোতে বন্যা ও জলাবদ্ধতা দেখা দিয়েছে। জেলার হাতীবান্ধা উপজেলার ৬ ইউনিয়নসহ তিস্তা ও ধরলা নদীর তীরবর্তী ইউনিয়নগুলোতে প্রায় ৫ হাজার পরিবার পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তারা বলছেন, উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে ভারী বর্ষণের কারণে চর অঞ্চলগুলোর বেশ কিছু পরিবার পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। তিস্তা ব্যারাজ দোয়ানী পয়েন্টে পানি বিপদসীমার ২০ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। পানি নিয়ন্ত্রণের জন্য ব্যারাজের সবকটি গেট খুলে রেখেছে পানি উন্নয়ন বোর্ড কর্তৃপক্ষ। রাঙামাটি: অবিরাম ভারী বর্ষণে রাঙামাটি জেলার লংগদু ও বরকল উপজেলায় পানির তোড়ে দুইজনের মৃতু্য হয়েছে। বন্যায়কবলিত জেলার বাঘাইছড়ি উপজেলার নিম্নাঞ্চল। দুর্গতরা এখন আশ্রয় কেন্দ্রে। প্রশাসন ও স্থানীয় সূত্র এসব তথ্য জানিয়েছে। এদিকে প্রায় সপ্তাহব্যাপী ভারী বর্ষণে রাঙামাটি-চট্টগ্রাম প্রধান সড়কের সাপছড়ি, শালবাগান, কলাবাগানসহ বিভিন্ন স্থানে ভূমিধস ও ভাঙন অব্যাহত রয়েছে। মাটি ধসে পড়ছে রাস্তার ওপর। এতে তৈরি হয়েছে ঝুঁকি। যান চলাচলে মারাত্মক বিঘ্ন ঘটছে। জেলার লংগদুতে বোট থেকে কাপ্তাই হ্রদে পড়ে পানির তোড়ে ভেসে গিয়ে মো. রুবেল (২৭) নামে এক বোট চালক মারা গেছেন। বুধবার সন্ধ্যার দিকে এ ঘটনা ঘটে। বৃহস্পতিবার সকালের দিকে কাপ্তাই হ্রদের কাট্টলি বিল নামক এলাকা থেকে তার লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। নিহত মো. রুবেল লংগদু উপজেলার মাইনিমুখ ইউনিয়নের জারুলছড়ি এলাকার বাসিন্দা। লংগদু থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা রঞ্জন কুমার সামন্তু ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত করেছেন। অন্যদিকে বুধবার বিকালের দিকে অন্য উপজেলা বরকলের ভুষণছড়া ইউনিয়নের অজ্যেংছড়ি এলাকায় পানির তোড়ে ভেসে গিয়ে বিজুরাম চাকমা (৬৭) নামে এক বৃদ্ধ মারা গেছেন। স্থানীয়রা জানান, অবিরাম বর্ষণে উজান থেকে পাহাড়ি ঢল নামায় ছড়ার পাশে খুঁটিতে বাঁধা গরু বাঁচানোর চেষ্টা করছিলেন বিজুরাম চাকমা। তখন ছড়ার পানির তোড়ে ভেসে যান। ঘন্টা দুয়েক পর ভাটি এলাকার পাহাড়ি ছড়ায় থাকা পাথরে আটকা অবস্থায় তার লাশ উদ্ধার করেন এলাকাবাসী। লামা (বান্দরবান) :প্রবল বর্ষণ ও পাহাড়ি ঢলে সৃষ্ট বন্যায় বান্দরবানের লামায় নিম্নাঞ্চল বন্যা পস্নাবিত হয়ে পড়েছে। বৃহস্পতিবার সকাল থেকে পৌর এলাকাসহ উপজেলার বিভিন্ন ইউনিয়নের নিম্নাঞ্চল এলাকা পানির নিচে তলিয়ে গেছে। পানি বন্দি হয়ে পড়েছে হাজার হাজার মানুষ। পাহাড়ি ধলে উপজেলা নির্বাহী অফিসার বাসভবনসহ উপজেলা নিম্নাঞ্চল পস্নাবিত হয়ে পড়েছে। উপজেলা প্রশাসক থেকে ভারী বর্ষণের সতর্কবাণী বিজ্ঞপ্তি জারি করেছে। ফাঁসিয়াখালী সড়ক সাথে লামা-আলীকদম সড়কে বিভিন্ন পয়ন্টে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। উপজেলা প্রশাসন পক্ষ থেকে পাহাড়ে পাদদেশে ঝুঁকিপূর্ণ বসবাসকারীদেরকে নিরাপদে আশ্রয় গ্রহণের জন্য বলা হয়েছে।