১৬ ডিসেম্বর মহান বিজয় দিবস বাঙালি জাতির হাজার বছরের শৌর্যবীর্য ও বীরত্বের এক অবিস্মরণীয় গৌরবময় দিন। ১৯৪৮ সাল থেকে বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন, ছেষট্টির ছয় দফা, ঊনসত্তরের গণ-অভু্যত্থান, একাত্তরের ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ পর্যায়ক্রমে জাতিকে চূড়ান্তভাবে উজ্জীবিত করে স্বীয় অধিকার আদায়ের সংগ্রামে লিপ্ত হতে। এরপর ২৫ মার্চে গণহত্যা শুরু হলে ২৬ মার্চ প্রথম প্রহরে স্বাধীনতার ঘোষণার মাধ্যমে ১৭ এপ্রিল মুজিবনগর সরকার গঠন হয়। এরপর দীর্ঘ ৯ মাস রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের পর ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর ঢাকার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে পাকিস্তানি বাহিনীর প্রায় ৯১,৬৩৪ সদস্যের আনুষ্ঠানিকভাবে আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে ৩০ লাখ শহীদ ও দুই লাখ মা-বোনের আত্মত্যাগের বিনিময় অর্জিত হয় চূড়ান্ত বিজয়। এর ফলে ওইদিন পৃথিবীর মানচিত্রে স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে অভু্যদয় ঘটে বাংলাদেশের।
এ উপলক্ষে প্রতিবছর বাংলাদেশে যথাযথ ভাবগাম্ভীর্য এবং বিপুল উৎসাহ-উদ্দীপনার সঙ্গে পালিত হয় এই দিবসটি। ১৬ ডিসেম্বর ভোরে ৩১ বার তোপধ্বনির মাধ্যমে দিবসের শুভ সূচনা ঘটে। এরপর রাষ্ট্রীয়ভাবে গৃহীত নানা কর্মসূচি পালনের পাশাপাশি মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে নিহত শহীদদের প্রতি ঢাকার সাভারে অবস্থিত জাতীয় স্মৃতিসৌধে পুষ্পস্তবক অর্পণের মাধ্যমে নিবেদন করা হয় গভীর শ্রদ্ধা। এ ছাড়াও দেশের প্রতিটি জেলা-উপজেলায় বিজয় দিবসের কুচকাওয়াজ, বিশেষ আলোচনা অনুষ্ঠান, মতবিনিময় সভা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। দেশের প্রধান প্রধান সড়কগুলোকে সাজানো হয় জাতীয় পতাকা দিয়ে।
১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বাঙালি জাতি পরাধীনতার শেকল ভেঙে প্রথম স্বাধীনতার স্বাদ গ্রহণ করে। দীর্ঘ দুই যুগের পরাধীনতার নাগপাশ ছিন্ন করে জাতির ভাগ্যাকাশে দেখা দেয় এক নতুন সূর্য। প্রভাত সূর্যের রক্তাভা ছড়িয়ে পড়ে বাংলাদেশের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্তে। সমস্বরে একটি ধ্বনি যেন নতুন বার্তা ছড়িয়ে দেয়, পূর্ব দিগন্তে সূর্য উঠেছে, রক্ত লাল, রক্ত লাল, রক্ত লাল। মহামুক্তির আনন্দ ঘোর এই দিনে এক নতুন উলস্নাস জাতিকে প্রাণ সঞ্চার করে সজিবতা এনে দেয়। যুগ যুগ ধরে শোষিত-বঞ্চিত বাঙালি চোখে আনন্দ অশ্রম্ন আর ইস্পাত কঠিন দূঢ়তা নিয়ে এগিয়ে যায় সামনে। বিন্দু বিন্দু স্বপ্ন অবশেষে মিলিত হয় জীবনের মোহনায়। বিশ্ব কবির সোনার বাংলা, নজরুলের বাংলাদেশ, জীবনানন্দের রূপসী বাংলা রূপের তাহার নাইকো শেষ, বাংলাদেশ আমার বাংলাদেশ। বাঙালি যেন খুঁজে পায় তার আপন সত্তাকে।
মূলত মুক্তিপাগল বাংলার দামাল ছেলেরা স্বাধীনতার রক্তিম সূর্যকে ছিনিয়ে আনবে বলে বৈষম্য আর বঞ্চনার বিরুদ্ধে একদিন অস্ত্র কাঁধে তুলে নেয়। ছাত্র-শিক্ষক, বুদ্ধিজীবী, কৃষক-শ্রমিক, কামার-কুমার সবাই শরিক হয় সেই লড়াইয়ে। যতই দিন অতিবাহিত হতে থাকে, আরও শাণিত হয় প্রতিটি মুক্তিযোদ্ধার অস্ত্র। লক্ষ্য স্থির রেখে শত্রম্ন হননে দৃঢ়তায় এগিয়ে যায় বীর বাঙালি। বাঙালির বীরত্ব থেকে স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রতি আন্তর্জাতিক সমর্থন ক্রমান্বয়ে স্পষ্ট হয়ে ওঠে। সেই সঙ্গে বাঙালির বুকের ভেতর জ্বলে ওঠা আগুন যেন সহস্র বাঙালির মধ্যে প্রবাহিত হতে থাকে। অপরদিকে পাকিস্তানি হায়েনারা বাঙালি নিধনে মারাত্মক মারণাস্ত্র নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে নিরস্ত্র জাতির ওপর। তারাও অংক কষতে থাকে কীভাবে বাঙালি জাতিকে দমন করা যায়। তাদের পক্ষ থেকে শুরু হয় বাঙালি নিধনযজ্ঞ। বাতাসে ভাসতে থাকে লাশের গন্ধ। বারুদে আর ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন হয়ে যায় আকাশ। এ যেন এক প্রেতপুরী। বিপন্ন মানুষের বিলাপে দিন দিন ভারী হতে থাকে পরিবেশ।
সবশেষে হিসাব-নিকাশ চুকিয়ে দেওয়ার পালা আসে বাঙালির হাতে। ক্রমান্বয়ে নিশ্চিত হয় পাকিস্তানিদের চূড়ান্ত পরাজয়। গভীর কালো নিকষ আঁধার থেকে জেগে ওঠে নতুন এক সূর্য। বিজয়ের সূর্য। সেই মহেন্দ্রক্ষণ বিজয়ের দামামা বাজিয়ে জানান দেয় কাঙ্ক্ষিত স্বাধীনতার শুভ বার্তা। পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর পূর্বাঞ্চলের অধিনায়ক জেনারেল আমির আব্দুলস্নাহ খান নিয়াজি ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা ৫-২৫ মিনিটে ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) মিত্র বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করে। আজ আমরা সেই গৌরবের ধারক ও বাহক হয়ে এই দিবসে লাল-সবুজের পতাকা উত্তোলন করে শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করব আমাদের বীর মুক্তিযোদ্ধাদের মহান ত্যাগের প্রতি। আর আমাদের কণ্ঠে চারদিকে ধ্বনিত হবে- 'এক সাগর রক্তের বিনিময় বাংলার স্বাধীনতা আনলে যারা/ আমরা তোমাদের ভুলবো না। দুঃসহ বেদনার কণ্টক পথ বেয়ে/শোষণের নাগপাশ ছিঁড়লে যারা/ আমরা তোমাদের ভুলবো না।'