ভারী বর্ষণে উত্তর-পূর্বাঞ্চলে বন্যার অবনতির আশঙ্কা

প্রকাশ | ০৩ জুলাই ২০২০, ০০:০০

যাযাদি ডেস্ক
পানিতে তলিয়ে যাওয়া বাড়ি থেকে প্রয়োজনীয় তৈজসপত্র নিয়ে নিরাপদ স্থানে আশ্রয় নিচ্ছে এক পরিবার। ছবিটি বৃহস্পতিবার বগুড়ার ভান্ডারবাড়ি গ্রাম থেকে তোলা -পিবিএ
মাঝে বৃষ্টিপাত কমে যাওয়ায় উত্তর-পূর্বাঞ্চলের বন্যা পরিস্থিতি কিছুটা উন্নতির দিকে যাচ্ছিল। কিন্তু আবারও শুরু হয়েছে অতিভারী বর্ষণ। ফলে উত্তরের বন্যা পরিস্থিতি পুনরায় অবনতি হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। বৃহস্পতিবার আবহাওয়াবিদ এ কে এম নাজমুল হক জানান, বাংলাদেশের উত্তরাংশে মৌসুমি বায়ু সক্রিয় থাকার কারণে আজ শুক্রবার রংপুর, ময়মনসিংহ ও সিলেট বিভাগের কোথাও কোথাও ভারী (৪৪-৮৮ মিমি) থেকে অতিভারী (২৮৯ মিমি) বর্ষণ হতে পারে। এক পূর্বাভাসে আবহাওয়া অফিস জানিয়েছে, মৌসুমি বায়ুর অক্ষ রাজস্থান, পাঞ্জাব, হরিয়ানা, উত্তর প্রদেশ, বিহার, হিমালয়ের পাদদেশীয় পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চল হয়ে আসাম পর্যন্ত বিস্তৃত রয়েছে। এর একটি বর্ধিতাংশ উত্তর-পূর্ব বঙ্গোপসাগর পর্যন্ত বিস্তৃত। আর মৌসুমি বায়ু বাংলাদেশের ওপর মোটামুটি সক্রিয় এবং উত্তর বঙ্গোপসাগরে মাঝারি অবস্থায় বিরাজ করছে। এ অবস্থায় শুক্রবার রংপুর, ময়মনসিংহ ও সিলেট বিভাগের অধিকাংশ জায়গায় রাজশাহী বিভাগের অনেক জায়গায়; ঢাকা, খুলনা চট্টগ্রাম ও বরিশাল বিভাগের কিছু কিছু জায়গায় অস্থায়ীভাবে দমকা হাওয়াসহ হালকা থেকে মাঝারি ধরনের বৃষ্টি ও বজ্রসহ বৃষ্টি হতে পারে। সেই সঙ্গে দেশের উত্তরাঞ্চলের কোথাও কোথাও মাঝারি ধরনের ভারী থেকে অতিভারী বর্ষণ হতে পারে। তবে ভারী বর্ষণের কারণে সিলেটে পাহাড়ি অঞ্চলে ভূমিধসের কোনো আশঙ্কা নেই। এদিকে রংপুর, দিনাজপুর, ময়মনসিংহ, সিলেট, নোয়াখালী, চট্টগ্রাম এবং কক্সবাজার অঞ্চলের ওপর দিয়ে দক্ষিণ/দক্ষিণ-পূর্ব দিক থেকে ঘণ্টায় ৪৫-৬০ কিমি বেগে বৃষ্টি অথবা বজ্রবৃষ্টিসহ অস্থায়ীভাবে দমকা/ঝড়ো হাওয়া বয়ে যেতে পারে। তাই এসব এলাকার নদীবন্দরকে ১ নম্বর সতর্ক সংকেত দেখাতে বলা হয়েছে। দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের প্রধান প্রধান নদ-নদী ছাড়া দেশের প্রায় সব প্রধান নদ-নদীর পানি এখনো বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। যমুনা, ব্রহ্মপুত্র, পদ্মার পানিতে পস্নাবিত উত্তর ও মধ্যাঞ্চলে অন্তত ১০ জেলা। বন্যার পানি সরেনি উত্তর-পূর্বাঞ্চলেও। এ অবস্থায় অতিভারী বর্ষণে সেই এলাকায় পুনরায় বন্যা পরিস্থিতি অবনতির আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। বুধবার রাত থেকে বৃহস্পতিবার পর্যন্ত দেশে সর্বোচ্চ বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে ডিমলায়, ২০২ মিলিমিটার। এলাকাটির তিস্তার নদীর পানি বেড়ে গিয়েই দেশে প্রথম বন্যা পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। অন্যদিকে রাজধানীসহ দেশের বেশকিছু এলাকায় গত চার দিনে বৃষ্টিপাত বেশ কমেছে। রয়েছে প্রথম সূর্যকিরণ। তারওপর বাতাসের আর্দ্রতার পরিমাণও বেশি। রাজধানীতে বৃহস্পতিবার সকালে আর্দ্রতার পরিমাণ ছিল ৯৩ শতাংশ। ফলে গরম অনুভূত হচ্ছে বেশি। তবে তাপমাত্রাও কিছুটা বেড়েছে। আমাদের বকশীগঞ্জ (জামালপুর) প্রতিনিধি জানান, জামালপুরের বকশীগঞ্জে বন্যার পরিস্থিতি অপরিবর্তিত রয়েছে। বৃহস্পতিবার সারাদিন বন্যার পানি বৃদ্ধি বা কমে যায়নি। পানি স্থিতিশীল অবস্থায় রয়েছে। এখন পর্যন্ত চারটি ইউনিয়নে বন্যার পানিতে ৩০টি গ্রামের ৩৬ হাজার মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। চরম দুর্ভোগে পড়েছেন বন্যাকবলিত এলাকার মানুষ। সাধুরপাড়া ইউনিয়নের বিলেরপাড়, বাংগাল পাড়া, মদনের চর, চর গাজীরপাড়া, চর কামালের বার্ত্তী, চর আইরমারী, কতুবের চর গ্রামের সব যোগাযোগ ব্যবস্থা বিচ্ছিন্ন রয়েছে। গাজীরপাড়া বাজার থেকে বাংগাল পাড়া সড়কের ওপর নির্মিত একটি ১০০ মিটারের বাঁশের সাঁকো বন্যার পানির প্রবল স্রোতে ভেসে গেছে। এতে করে ৪টি গ্রামের মানুষকে সীমাহীন দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে। সাধুরপাড়া ইউনিয়নের চর কামালের বার্ত্তী খালের ওপর নির্মিত আরেকটি বাঁশের সাঁকো ভেঙে পড়ায় মানুষের চলাচল বন্ধ রয়েছে। এছাড়া মেরুরচর ইউনিয়নের ঘুঘরাকান্দি, উজান কলকিহারা, ভাটি কলকিহারা, পূর্ব কলকিহারা, চিনারচর, মাইছানিরচর, আউল পাড়া, খেওয়ারচর, নিলক্ষিয়া ইউনিয়নের দক্ষিণ কুশল নগর, সাজিমারা, গোমের চর পাগলাপাড়া, বগারচর ইউনিয়নের আলীরপাড়া, বালুরচর, পেরিরচর, টালিয়াপাড়া, সাতভিটা গ্রামসহ ৩০টি গ্রাম পস্নাবিত হয়েছে। বন্যার প্রবল স্রোতের কারণে গত এক সপ্তাহে সাধুরপাড়া ইউনিয়নের চর কামালের বার্ত্তী, আইরমারী, বাংগাল পাড়া, নিলক্ষিয়া ইউনিয়নের দক্ষিণ কুশল নগর গ্রাম, মেরুরচর ইউনিয়নের পূর্ব কলকিহারা, উজান কলকিহারা গ্রামের অর্ধশত ভিটামাটি ব্রহ্মপুত্র নদ ও দশানী নদীতে বিলীন হয়ে গেছে। অনেকেই দ্রম্নত বাড়িঘর অন্যত্র সরিয়ে নিচ্ছেন। বুধবার বিকালে উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান আবদুর রউফ তালুকদার, উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) আ স ম জামশেদ খোন্দকার বিভিন্ন বন্যার্ত এলাকা পরিদর্শন করেছেন। ভূঞাপুর (টাঙ্গাইল) প্রতিনিধি জানান, টাঙ্গাইলের ভূঞাপুর অংশে যমুনার পানি গত কয়েক সপ্তাহ ধরে অস্বাভাবিক হারে পানি বৃদ্ধি হলেও বুধবার থেকে স্থিতিশীল রয়েছে। তবে পানি বন্দী রয়েছে উপজেলার ৪টি ইউনিয়নের লক্ষাধিক মানুষ। ভাঙনঝুঁকিতে রয়েছে টাঙ্গাইলের ভূঞাপুর-তারাকান্দি গাইড বাঁধ। ভূঞাপুর অংশে যমুনার পানি বিপৎসীমার ৪৫ সেন্টিমিটারের ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। ইতোমধ্যে বন্যায় পানিবন্দি হয়ে পড়েছে লক্ষাধিক মানুষ। বসতবাড়িতে পানি ওঠায় বাঁশের মাচা করে পরিবার পরিজন নিয়ে দুর্বিষহ জীবনযাপন করছে। অনেকেই ঘরবাড়ি ছেড়ে গবাদিপশু নিয়ে আত্মীয়স্বজনের বাড়ি, স্কুল মাঠ ও বাঁধে আশ্রয় নিয়েছে। বিভিন্ন সড়কের পাশে পলিথিন দিয়ে ছাউনি তৈরি করে বসবাস ও মানবেতর জীবনযাপন করছে। এ রির্পোট লেখা পর্যন্ত দুর্গত এলাকার মানুষের জন্য সরকারি-বেসরকারি কোনো ত্রাণসামগ্রী পৌঁছেনি। এদিকে ভূঞাপুর-তারাকান্দি গাইড বাঁধের বিভিন্ন স্থানের প্রায় ৪০টি লিকেজ দেখা দিয়েছে। এর মধ্যে তাড়াই ও গাড়াবাড়ি সড়কের ১০ পয়েন্ট অত্যাধিক ঝুঁকিপূর্ণ। এতে যেকোনো সময় পানি প্রবেশ করতে পারে বলে আশঙ্কা করছে স্থানীয়রা। লিকেজ বন্ধ করতে গত মঙ্গলবার দুপুর থেকে কাজ করছে টাঙ্গাইল পানি উন্নয়ন বোর্ড। গত বুধবার দুপুরে ময়মনসিংহ সার্কেলের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী মো. শাহজাহান সিরাজ, টাঙ্গাইল পানি উন্নয়ন বোর্ডের প্রধান প্রকৌশলী মো. সিরাজুল ইসলাম, ভূঞাপুর থানা অফিসার ইনচার্জ মো. রাশিদুল ইসলাম ভাঙন রোধ কার্যক্রমের কাজ ও বন্যাকবলিত এলাকা পরিদর্শন করেছেন। এর আগে টাঙ্গাইল-২ (ভূঞাপুর-গোপালপুর) আসনের সংসদ সংদস্য ছোট মনির, উপজেলা চেয়ারম্যান আলহাজ মো. আব্দুল হালিম অ্যাডভোকেট, উপজেলা নির্বাহী অফিসার মোছা. নাসরীন পারভীন, উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান মনিরুল ইসলাম বাবুসহ স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা। জগন্নাথপুর (সুনামগঞ্জ) প্রতিনিধি জানান, সুনামগঞ্জের জগন্নাথপুরের নিম্নাঞ্চল বন্যায় পস্নাবিত হয়ে পয়েছে। প্রবল বর্ষণ আর পাহাড়ি ঢলে উপজেলার বিভিন্ন নদ-নদীর পানি বৃদ্ধি পাচ্ছে। কুশিয়ারা ও নলজুর নদীর পানি বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। ইতোমধ্যে বিভিন্ন গ্রামাঞ্চলে বাড়িঘর ও মৎস্যখামার পানির নিচে তলিয়ে গেছে। অনেক এলাকায় সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। নতুন নতুন এলাকা পস্নাবিত হচ্ছে। আকস্মিক বন্যায় পানিবন্দি অসহায় দরিদ্র খেটে খাওয়া পরিবারগুলো পড়েছেন চরম বিপাকে। জগন্নাথপুর উপজেলার ১টি পৌরসভা ও ৮টি ইউনিয়নে অধিকাংশ গ্রাম ও পাড়ামহলস্নার বাড়িঘর এবং সড়কপথ বন্যার পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় ওইসব এলাকার জনসাধারণ পানিবন্দি হয়ে পড়ায় চরম দুর্ভোগে পড়েছেন। জগন্নাথপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মাহফুজুল আলম মাসুম বলেন, উপজেলার সব জনপ্রতিনিধির সঙ্গে যোগাযোগ রয়েছে। পরিস্থিতি মোকাবিলায় প্রশাসন প্রস্তুত আছে।