রেস্তোরাঁ-ক্যাফে খুললেও নেই সেই 'বিক্রিবাট্টা'

প্রকাশ | ০৭ জুলাই ২০২০, ০০:০০

যাযাদি রিপোর্ট
গ্রাহকশূন্য একটি রেস্তোরাঁ
রাজধানীর ধানমন্ডি এলাকার সাত মসজিদ রোডের একটি ক্যাফেতে গত ফেব্রম্নয়ারি মাসের মাঝামাঝি পর্যন্তও বন্ধুদের নিয়ে প্রতি সপ্তাহে আড্ডা দিতেন অদিতি ইরা। বেসরকারি একটি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত ইরা গত প্রায় তিন মাস পছন্দের ওই ক্যাফেতে যেতে পারেননি। করোনাভাইরাস মহামারির মধ্যে বন্ধ রয়েছে তার পছন্দের ক্যাফেটি। ফ্লেভারস মিউজিক ক্যাফে নামের ওই রেস্তোরাঁ সাত বছর আগে শুরু করেন এস এম রাজন। মহামারিকালে সম্প্রতি এটি পুনরায় চালু করার চিন্তা-ভাবনা করলেও এখনও দ্বিধাগ্রস্ত রাজন। প্রতিষ্ঠার পর থেকে সবচেয়ে সংকটের সময় পার করছেন এখন। দক্ষ কর্মী সংকট, দোকানের ভাড়া, আশানুরূপ গ্রাহক পাবেন কি না, এসবই এখন তার চিন্তার বিষয়। রাজন বলেন, 'অল্প কিছু দিনের মধ্যে আমরা পুনরায় চালু করার কথা ভাবছি। ডাইন-ইন দিয়েই শুরু করতে চাই। সেটা করতে চাইলে বসার ক্যাপাসিটি কমে যাবে। অনলাইনেও চালু করব। সেখানেও প্রায় একই স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে। রাজনের ক্যাফে সাত মসজিদ রোডের যে ভবন, সেখানে আরও বেশ কয়েকটি রেস্তোরাঁ বা খাবারের দোকান রয়েছে। দুয়েকটি খুললেও আশানুরূপ গ্রাহক পাচ্ছে না। নতুন করোনাভাইরাসের বিস্তার ঠেকাতে ২৬ মার্চ থেকে চলা টানা ৬৬ দিনের লকডাউন ওঠার পর গত ৩০ মে থেকে সীমিত পরিসরে অফিস খোলার পাশাপাশি দোকানপাটও দিনের বেলা খুলতে দেওয়া হয়। ১ জুলাই থেকে সন্ধ্যা ৭টা পর্যন্ত দোকানপাট ও শপিংমল খোলা রাখা যাচ্ছে। বাংলাদেশ রেস্তোরাঁ মালিক সমিতির হিসাব অনুযায়ী, বছরে প্রায় ৩০ হাজার কোটি টাকা বিক্রির এই খাতে করোনাভাইরাস মহামারির যে প্রভাব পড়েছে, তাতে অনেকের ব্যবসা বন্ধ হয়ে যেতে পারে। ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনে সমিতির তালিকাভুক্ত প্রায় ৮ হাজার রেস্তোরাঁ রয়েছে। সমিতির বাইরে রয়েছে আরও ছোটখাটো অনেক খাবারের দোকান। সমিতির হিসাব অনুযায়ী সারাদেশে প্রায় ৯ লাখ শ্রমিক সরাসরি যুক্ত এই খাতের সঙ্গে। আর ঢাকা শহরে লাখের ওপর। দীর্ঘদিন বন্ধ এবং ভাইরাস সংক্রমণের ঝুঁকির কারণে যেসব রেস্তোরাঁ খোলা আছে, সেগুলোতেও গ্রাহক কম। রেস্তোরাঁ মালিক এবং ব্যবস্থাপনার সঙ্গে জড়িতরা বলছেন, 'লকডাউনে' কর্মচারীদের ঢাকা ছেড়ে চলে যাওয়া, দীর্ঘদিন বন্ধ থাকায় পুঁজি হারানো, বাড়ি ভাড়ার সমস্যা এবং সময়ের বাধ্যবাধকতার কারণে তারা সংকটে পড়েছেন। তারা বলছেন, সন্ধ্যা ৭টা পর্যন্ত সময় দিলে এই ব্যবসা চালানো তাদের জন্য কঠিন হবে। তাদের যুক্তি, খাবার একটি নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস। সাধারণ দোকানের সঙ্গে এটিকে গুলিয়ে ফেললে হবে না। অনলাইনে খাবার সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানগুলো বলছে, ফেব্রম্নয়ারি-মার্চের তুলনায় তাদের অর্ডার বেড়েছে। অংশীদার রেস্তোরাঁর সঙ্গে আলাপ করে খেলার ব্যবস্থাও করছেন তারা। ধানমন্ডির ২৭ নম্বর রোডের প্রেজি কফি শপ কোভিড-১৯ মহামারির মধ্যে ৩১ মে থেকে ব্যবসা পুনরায় চালু করে। শুরুতে শুধু পার্সেল সার্ভিস রাখলেও দুই সপ্তাহ ধরে 'ডাইন-ইন' চালু করেছে তারা। তবে স্বাস্থ্যবিধি ও সামাজিক দূরত্ব মেনে গ্রাহক বসানোর বাধ্যবাধকতার জন্য কমে গেছে আসন সংখ্যা। আগে যেখানে ৯৫ জন বসতে পারত, এখন সেখানে সর্বোচ্চ ৩৫ জন বসতে পারছে। ৫-৭ জন কর্মী মিলে রোস্টার করে দোকানটি চালাচ্ছেন। আগে কর্মী সংখ্যা ছিল প্রায় দ্বিগুণ। প্রেজির সহকারী ব্যবস্থাপক শাহরিয়ার শিহাব বলেন, করোনাভাইরাস মহামারির কারণে তাদের বিক্রি কমে গেছে ৬০ শতাংশ। শঙ্কায় কর্মচারীরাও মোহাম্মদপুরের ফাস্ট ফুড শপ ঢাকা ফ্রায়েড চিকেনের এক কর্মচারী তার প্রতিষ্ঠান চালু থাকার পরও চাকরি নিয়ে শঙ্কায় আছেন। নাম প্রকাশ না করার অনুরোধ করে রংপুর থেকে ঢাকায় কাজ করতে আসা ওই কর্মচারী বলেন, 'দোকান চালু আছে, বেতনও পাচ্ছি। কিন্তু যেভাবে কাস্টমার কমেছে, তাতে মালিক কদিন দোকান চালু রাখবেন, বুঝতে পারছি না। আর দোকান বন্ধ থাকলে তো বসিয়ে বসিয়ে কেউ বেতন দেবে না।' প্রায় একই ধরনের আশঙ্কার কথা জানালেন একই এলাকার রেইনবো ক্যাফের কর্মচারী মোহাম্মদ রাসেল। তার প্রতিষ্ঠান বন্ধ রয়েছে তিন মাস। ক্যাফে বন্ধ হওয়ার পর বেশ কিছু দিন নরসিংদীতে বাড়িতে ফিরে বেকার ছিলেন। রোজার ঈদের পর কখনও মৌসুমি ফল, কখনও রাস্তার পাশে মাস্ক, স্যানিটাইজার এসব বিক্রি করেছেন। কিন্তু রাস্তার পাশে স্বাস্থ্য সুরক্ষার জিনিস বিক্রি কম হয় বলে রাসেলের অভিমত। তিনি বলেন, 'ক্যাফে খুলবে শুনছি। আর কিছু দিন দেখব। যদি না খুলে তবে বাড়ি চলে যাব। টুকটাক মাস্ক-স্যানিটাইজার বিক্রি করে কোনো রকমে চলছি। আর ক্যাফে খুলবেই বা কেমন করে? মানুষ যাবে?' বাংলাদেশ রেস্তোরাঁ মালিক সমিতির সভাপতি খন্দকার রুহুল আমিন বলেন, 'আমাদের সমিতিভুক্ত ৩০ শতাংশ রেস্তোরাঁ খুলতে পেরেছে। বাকি ৭০ ভাগ আমরা চালু করতে পারিনি। প্রকৃতপক্ষে রেস্তোরাঁয় সন্ধ্যার পরে বিক্রি বেশি হয়। কিন্তু ৭টা পর্যন্ত খোলা রাখতে বলাটা একটু অমানবিক। মন্ত্রণালয় যে প্রজ্ঞাপন দিয়েছিল সেখানে বলা ছিল ১০টা থেকে ৪টা খোলা রাখা যাবে। সেখানে কৃষিপণ্য, ওষুধ নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্য, খাবার জাতীয় ওই সময়ের আওতার মধ্যে পড়বে না এমন বলা ছিল। রেস্তোরাঁ লেখা ছিল না বলে পুলিশ রেস্তোরাঁ বন্ধ করে দিয়েছিল।' বিষয়টি বিবেচনার জন্য সরকারকে লিখিতভাবে অনুরোধ করা হয়েছে জানিয়ে রুহুল আমিন বলেন, '৭টা পর্যন্ত করলে হবে না। এটা ১২টা পর্যন্ত না করলে আমরা পারব না। দোকান বন্ধ রেখে শ্রমিকদের বেতন-বোনাস দিতে পারব না।' বেড়েছে অনলাইন পস্ন্যাটফর্মে অর্ডার এদিকে অনলাইন পস্ন্যাটফর্মে খাবার ডেলিভারি দেওয়া প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, মার্চ-এপ্রিল মাসের তুলনায় তাদের এখন অর্ডার বেড়েছে। অংশীদার রেস্তোরাঁগুলোর সঙ্গে ব্যবসা চালু করার বিষয়ে আলোচনাও চালাচ্ছে তারা। দেশীয় প্রতিষ্ঠান হাংরিনাকি ডটকমের সহপ্রতিষ্ঠাতা ইব্রাহিম বিন মহিউদ্দিন বলেন, 'আগে আমাদের যে অর্ডার হতো সেটা মার্চ এপ্রিলে ১৫-২০ শতাংশে নেমে গিয়েছিল। এখন যদি তুলনা করি সেটা ৪০ শতাংশ।' প্রতিষ্ঠানটির ডেপুটি সিইও ইব্রাহিম বলেন, 'এই সময়টাতে ব্যক্তিগত অর্ডারের চেয়ে পারিবারিক অর্ডার বেশি আসছে।' মহামারিকালের আগে সপ্তাহে ২-৩ দিন বিভিন্ন অনলাইন পস্ন্যাটফর্মে খাবার অর্ডার করতেন ব্যাংক কর্মকর্তা জয়া তাসনিম রহমান। কোভিড-১৯ মহামারির মধ্যে তা বন্ধ হয়ে যায়। তবে সম্প্রতি পছন্দের একটি রেস্তোরাঁ অনলাইন ডেলিভারি চালু করায় আবারও টুকটাক অর্ডার করছেন তিনি। তিনি বলেন, 'মাত্র দুদিন আগেই অনলাইনে কাচ্চি বিরিয়ানি অর্ডার করেছি। সুলতানস ডাইনের কাচ্চি পছন্দ করি। স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলে বলেই অর্ডার করেছি।' সামজিক দূরত্বের বালাই নেই অনেক রেস্তোরাঁয় পুরান ঢাকা, মোহাম্মদপুর, ধানমন্ডি এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, সাধারণ রেস্তোরাঁগুলোর মধ্যে যারা ব্যবসা চালু করেছে তাদের মধ্যে গ্রাহকদের সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার কোনো ব্যবস্থাই নেই। অভিজাত এলাকার রেস্তোরাঁগুলো সামাজিক দূরত্ব এবং স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলছে। পুরান ঢাকা বেচারাম দেউড়ীর ঐতিহ্যবাহী হাজি নান্না বিরিয়ানির দোকানে কর্মরত মোহাম্মদ কবীর জানান, রোজার সময় তারা পার্সেল বিক্রি করেছে। এরপর ১৪ জুন থেকে দোকান খুলেছে। ওই দোকানে গিয়ে দেখা যায়, সামাজিক দূরত্ব মানা হচ্ছে না। একসাথে চারজন পাশাপাশি বসে খাওয়া-দাওয়া করছে। দোকানের ক্যাশকাউন্টার এবং ঢোকার মুখেও দূরত্ব বজায় রেখে চলার কোনো ব্যবস্থা নেই। বিষয়টি কথা বলতে চাইলে দোকানে কর্মরত কেউই মুখ খুলতে চাননি। পুরান ঢাকার নাজিরা বাজার এলাকার বিরিয়ানি ও সাধারণ রেস্তেরাঁগুলোতেও একই অবস্থা। একমাত্র বিখ্যাত হাজির বিরিয়ানি পার্সেল বিক্রি করছে। তারা রশি টাঙিয়ে দূরত্ব নিশ্চিত করার ব্যবস্থা করেছে। মোহাম্মদপুরের শিয়া মসজিদ এলাকার আলস্নাহর দান রেস্তোরাঁর ম্যানেজারকে সামাজিক দূরত্ব না মেনে বসতে দেওয়ার ব্যবস্থা না করার কারণ জিজ্ঞেস করলে নাম প্রকাশ না করে তিনি বলেন, 'এখন কাস্টমারই তো কম আসে। যার যেখানে খুশি বসতে পারে।' বিষয়টি নিয়ে রেস্তোরাঁ মালিক সমিতির সভাপতি রুহুল আমিনের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে তিনি বলেন, 'অনেক খাবারের দোকানে নিয়ম মানা হচ্ছে। সাধারণ শ্রেণির দোকানগুলোর ক্ষেত্রে সমস্যা হচ্ছে। তারা অনেকে আমাদের সদস্যও নয়। এখানে সিটি করপোরেশন যদি একটু দেখভাল করে, ট্রেড লাইসেন্স ছাড়া দোকানগুলো তুলে দিত তাহলে ভালো হতো।' নিজের রেস্তোরাঁয় স্বাস্থ্যবিধি মেনে চালানো হচ্ছে জানিয়ে রুহুল আমিন বলেন, 'সামাজিক দূরত্ব মানার বিষয়টা চেষ্টা করছি। ক্রেতাদের এখানে দায়িত্ব আছে। তারা একসাথে বসতে চাচ্ছে। তবে অনেকেই অভ্যস্ত হচ্ছেন। গত প্রায় চার মাস ধরো মাস্ক-স্যানিটাইজার, সাবান দিয়ে হাত ধোয়া এগুলো অভ্যাস করছে।'