টানা কয়েক দিন কমার পর ফের বাড়তে শুরু করেছে নদ-নদীর পানি। শুক্রবার তিন নদীর পানি চারটি পয়েন্টে বিপৎসীমার ওপর দিয়ে বইতে শুরু করেছে।
আগামী দুই দিনের মধ্যে দেশের উত্তরাঞ্চল, উত্তর-পূর্বাঞ্চল ও তৎসংলগ্ন হিমালয় পাদদেশীয় পশ্চিমবঙ্গ ও বিহার প্রদেশে ভারী থেকে অতি ভারী বর্ষণের পূর্বাভাস দিয়েছে বাংলাদেশ ও ভারতের আবহাওয়া অধিদপ্তর।
এর ফলে বহ্মপুত্র-যমুনা ও আপার মেঘনা অববাহিকার নদ-নদীর পানি দ্রম্নত বাড়ার আভাস দিয়েছে পানি উন্নয়ন বোর্ডের বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র।
চলতি মৌসুমে উজানে ঢলে জুনের শেষ সপ্তাহে নদ-নদীর পানি বাড়তে শুরু করে। জুলাইয়ের প্রথম সপ্তাহে ১৭টি স্টেশনে নদীর পানি ছিল বিপৎসীমার উপরে। তা কমতে কমতে বৃহস্পতিবার সব স্টেশনে বিপৎসীমার নিচে নেমে এলেও শুক্রবার আবার বাড়তে শুরু করেছে।
বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. আরিফুজ্জামান ভূঁইয়া জানান, বহ্মপুত্র-যমুনা, উত্তরাঞ্চলের তিস্তা-ধরলা এবং উত্তর-পূর্বাঞ্চলের আপার মেঘনা অববাহিকার নদ-নদীর পানি বাড়ছে। তাতে আগামী ২৪ ঘণ্টায় সিলেট ও সুনামগঞ্জ বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হতে পারে। তবে পদ্মা-গঙ্গার পানি আগামী ২৪ ঘণ্টায় স্থিতিশীল থাকতে পারে।
তিনি জানান, দেশের নদ-নদীগুলোর ১০১টি পর্যবেক্ষণ পয়েন্টের মধ্যে ৫৭টিতে শুক্রবার পানি বেড়েছে। এর মধ্যে সুরমা নদী কানাইঘাট ও সুনামগঞ্জ পয়েন্টে, যদুকাটা নদী লরেরগড় এবং গুড় নদী সিংড়া পয়েন্টে বিপৎসীমার উপর দিয়ে বয়ে যাচ্ছে।
বন্যা-পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র আগামী দুই সপ্তাহের পূর্ভাসে জানিয়েছে, উজানের ভারী বর্ষণে নদ-নদীর পানি বৃদ্ধির এ প্রবণতা আরও ৮-১০ দিন অব্যাহত থাকবে। তাতে বন্যার বিস্তারের সঙ্গে ভোগান্তিও দীর্ঘায়িত হতে পারে।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের সংক্ষিপ্ত পূর্বাভাসে জানানো হয়, ৮ জুলাই থেকে মৌসুমি বায়ু ফের সক্রিয় হওয়ায় উজানে ভারতের অরুণাচল, আসাম, মেঘালয় ও পশ্চিমবঙ্গে ভারি বৃষ্টিপাত হচ্ছে।
কেন্দ্রের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. আরিফুজ্জামান ভূঁইয়া বলেন, সোমবারের মধ্যে বেশ কিছু পয়েন্টে পানি বিপৎসীমার উপর দিয়ে প্রবাহিত হতে পারে। তাতে কুড়িগ্রাম, গাইবান্ধা, জামালপুর, বগুড়া, সিরাজগঞ্জ, টাঙ্গাইল, মানিকগঞ্জ, পাবনা, নওগাঁ ও নাটোর জেলার নিম্নাঞ্চললে বন্যা পরিস্থিতির সৃষ্টি হতে পারে।
কোথাও কোথাও বন্যা
পরিস্থিতির অবনতি হতে পারে। উজানের ভারী বর্ষণের উপর নির্ভর করে বন্যা পরিস্থিতি কোথাও কোথাও জুলাইয়ের চতুর্থ সপ্তাহ পর্যন্ত দীর্ঘায়িত হতে পারে।'
উত্তরাঞ্চলে তিস্তা-ধরলার পানি তিন-চার দিন বাড়তে থাকলে লালমনিরহাট, নীলফামারী ও রংপুর জেলার নিম্নাঞ্চলে স্বল্প মেয়াদি বন্যা পরিস্থিতির সৃষ্টি হতে পারে।
গঙ্গা-পদ্মা অববাহিকায় শনিবার থেকে নদ-নদীতে পানি বাড়তে শুরু করেছে। আজ রোববার থেকে কোথাও কোথাও বিপৎসীমার উপর দিয়ে বইতে পারে।
তাতে রাজবাড়ী, ঢাকা, মুন্সীগঞ্জ, ফরিদপুর, মাদারীপুর, শরীয়তপুর ও চাঁদুপুর জেলার নিম্নাঞ্চলে বন্যা পরিস্থিতির সৃষ্টি হতে পারে, যা মাসের শেষ সপ্তাহ পর্যন্ত দীর্ঘায়িত হতে পারে।
বৃষ্টি অব্যাহত থাকলে পাহাড়ি ঢলে মেঘনা অববাহিকায় চার-পাঁচ দিন পানি বাড়তে পারে। তাতে সুনামগঞ্জ, সিলেট ও নেত্রকোনার নিম্নাঞ্চলে স্বল্প মেয়াদি বন্যা হতে পারে।
নতুন করে ২৩টি জেলা বন্যায় পাবিত হওয়ার শঙ্কা থাকায় সেসব জেলায় আশ্রয়কেন্দ্র প্রস্তুত করতে ইতোমধ্যে ডিসিদের নির্দেশ দিয়েছে সরকার।
আমাদের ছাতক (সুনামগঞ্জ) প্রতিনিধি জানান, সুনামগঞ্জের ছাতকে আবারও বন্যা দেখা দিয়েছে। পস্নাবিত হয়ে পড়েছে উপজেলার বিস্তীর্ণ এলাকা। আগের বন্যার পানি ঘরবাড়ি থেকে নেমে যাওয়ার পরপরই আবারও বন্যায় পস্নাবিত হয়েছে ছাতকের সর্বত্রই। শুক্রবার সকাল থেকে সুরমা নদীসহ সব নদ-নদীতে পানি বৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে। বন্যা পরিস্থিতি এখানে আবারও ব্যাপক আকার ধারণ করতে পারে। ইতোমধ্যে বন্যায় তলিয়ে গেছে এখানের বহু রাস্তাঘাট, ঘরবাড়ি, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও শ শ একর বীজতলা। পৌরসভাসহ উপজেলার ১৩টি ইউনিয়ন বন্যার পানিতে পস্নাবিত হয়েছে। শহরের নিম্নাঞ্চল এলাকার বাসাবাড়িতে আবারও বন্যার পানি ঢুকেছে। শহরের রাস্তাঘাট ও বেশ কটি ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে বন্যার পানি ঢুকে পড়েছে। উজানে প্রবল বর্ষণ ও পাহাড়ি ঢলের কারণে এখানে সুরমা, চেলা ও পিয়াইন নদীতে পানি বৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে।
আমাদের ডিমলা (নীলফামারী) প্রতিনিধি জানান, উজানের পাহাড়ি ঢল ও ভারী বর্ষণের ফলে তিস্তার পানি বিপৎসীমার ২৮ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। বন্যা ও ভাঙনের কারণে পরিস্থিতি ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। জনপ্রনিধিদের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী পানিবন্দি হয়ে পড়েছে উপজেলার ৫টি ইউনিয়নের ৬ হাজার ৫শ পরিবারের প্রায় ২৫ হাজার মানুষ। শুক্রবার সন্ধ্যা থেকে শনিবার দুপুর পর্যন্ত তিস্তার পানি বিপৎসীমার (৫২ দশমিক ৮৪ সেন্টিমিটার) ২৪ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হলেও। দুপুর থেকে ডালিয়া পয়েন্টে তিস্তা নদীর পানি বৃদ্ধি পেয়ে বিকেল পর্যন্ত বিপৎসীমার (৫২ দশমিক ৮৮ সেন্টিমিটার) ২৮ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে তিস্তা ব্যারাজের সবকটি জলকপাট খুলে দিয়েছে বলে জানিয়েছে পানি উন্নয়ন বোর্ড ডালিয়া বিভাগের বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র (পাউবো)।
আমাদের পাবনা প্রতিনিধি জানান, পাবনায় পদ্মা ও যমুনাসহ বিভিন্ন নদ-নদীতে কমতে শুরু করেছে বন্যার পানি। তবে পানি কমার সঙ্গে সঙ্গে নতুন ভাঙনের শঙ্কা নদীপাড়ের মানুষের মধ্যে। আর ভাঙন প্রতিরোধে সকল প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছে পাউবো।
পাবনা পানি উন্নয়ন বোর্ড বেড়ার নির্বাহী প্রকৌশলী আব্দুল হামিদ জানান, শনিবার সকালে যমুনা নদীর নগরবাড়ি পয়েন্টে পানির রেকর্ড ৯.৪১ সেন্টিমিটার বিপৎসীমার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। তবে যমুনায় পানি বৃদ্ধির ফলে ভাঙন, নিচু ফসলি ও চরের জমি পস্নাবিত এবং ভাঙনকবলিত হয়। ভাঙনে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় পানি উন্নয়ন বোর্ডের তত্ত্বাবধানে রক্ষণাবেক্ষণ করা হচ্ছে। ভাঙন প্রতিরোধে নেওয়া হয়েছে বাড়তি সতর্কতা।
পাবনা পানি উন্নয়ন বোর্ডের উপসহকারী প্রকৌশলী মোফাজ্জল হোসেন জানান, পদ্মা নদীর পাকশী হার্ডিঞ্জ ব্রিজ পয়েন্টে ২.৩৬ সেন্টিমিটার বিপৎসীমার নিচ দিয়ে পানি প্রবাহিত হচ্ছে। এই পয়েন্টে বিপৎসীমা নির্ধারণ হয়েছে ১৪.২৫ সেন্টিমিটার। বর্তমানে ১১.৮৯ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে পানি প্রবাহিত হচ্ছে।
জৈন্তাপুর (সিলেট) প্রতিনিধি জানান, প্রায় ১০ দিনের ব্যবধানে সিলেটের জৈন্তাপুর উপজেলা আবারও বন্যার কবলে পড়েছে। গত তিন দিনের অতিবৃষ্টি এবং উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে তৃতীয় দফায় উপজেলার নদ-নদীর পানি বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে ৪ ইউনিয়নের নিম্ন্নাঞ্চল পস্নাবিত হয়। শনিবার দুপুর ২টায় উপজেলার সারী নদীর পানি স্বাভাবিকের চেয়ে বিপৎসীমার ১২.৩৫ মিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।
সারী নদী, করিচ নদী, বড়গাংসহ অন্যান্য নদীগুলোতে পানি বৃদ্ধি অব্যাহত আছে। ফলে উপজেলার নিচু এলাকায় পানি প্রবেশ করে ভোগান্তিতে পড়েছেন পস্নাবিত এলাকার মানুষ। পানির নিচে ডুবে গেছে অনেক রাস্তাঘাট। তাই বিশুদ্ধ পানি ও খাদ্যের অভাব দেখা দিয়েছে তাদের পরিবারে। বন্যা-পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র জানিয়েছে, আগামী ২-৩ দিন ভারী বর্ষণ অব্যাহত থাকতে পারে। ফলে পানিও বাড়তে পারে।
পাহাড়ি ঢল ও অতিবৃষ্টির ফলে উপজেলার ৬টি ইউনিয়নের নিম্নাঞ্চলের স্কুল, মাদ্রাসা, মসজিদ এবং বীজতলা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তাদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্তের স্বীকার হয়েছে নিম্ন্ন আয়ের দিনমজুর ও মৎস্যচাষিরা। গ্রামের দরিদ্র পরিবারগুলোর বসতবিটা কাঁচা থাকায় বন্যার পানিতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে পড়েছে। বন্যায় বাড়িঘরসহ মাছ চাষ করা পুকুর দীঘি তলিয়ে যাওয়ার কারণে ব্যাপক ক্ষতি সাধিত হওয়ায় বিপাকে পড়েছে গ্রামীণ জনপদে বসবাসকারীসহ মৎস্যচাষিরা। সীমান্তবর্তী ৩টি ইউনিয়নের বন্যায় আটকে পড়া পরিবারগুলোর মধ্যে শুকনো খাবারের ব্যবস্থা করে উপজেলা প্রশাসন।
কাউনিয়া (রংপুর) প্রতিনিধি জানান, আষাঢ়ের বর্ষণ ও উজান থেকে নেমে আসা ঢলে রংপুরের কাউনিয়ায় তিস্তা নদীর পানি বিপৎসীমার ওপর দিয়ে বইছে। পস্নাবিত হয়েছে নিম্ন্নাঞ্চল। লোকালয়ে ঢুকছে বানের জল, ঢুকছে গ্রামের পর গ্রাম।
রংপুর পানি উন্নয়ন বোর্ড জানায়, শনিবার দুপুর ১২টায় ডালিয়া ব্যারাজ পয়েন্টে বিপৎসীমার ২০ সেন্টিমিটার ও কাউনিয়া তিস্তা সড়ক সেতু পয়েন্টে ১ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে তিস্তা নদীর পানি প্রবাহিত হচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে কাউনিয়া উপজেলার চরঢুষমারা, গনাই, আজমখাঁ, বিশ্বনাথ, হরিচরণশর্মা, পূর্বপাঞ্চরভাঙ্গা, নিজপাড়া, হরিশ্বরসহ বেশ কয়েকটি গ্রামে পানিবন্দি হয়ে দুর্ভোগে পড়েছেন কয়েক হাজার মানুষ। পানিতে রাস্তাঘাট তলিয়ে যাওয়ায় ভেঙে পড়েছে যোগাযোগ ব্যবস্থা। তলিয়ে গেছে চরাঞ্চলে আবাদি জমি।
কলমাকান্দা (নেত্রকোনা) প্রতিনিধি জানান, নেত্রকোনার কলমাকান্দায় ফের বন্যায় কলমাকান্দা, নাজিরপুর, পোগলা, বড়খাপন, খারনৈ, রংছাতি, লেংগুড়া ও কৈলাটী ইউনিয়নের দুই শতাধিক গ্রামের পনের হাজার মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন। তাদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্তের স্বীকার হয়েছেন নিম্ন্ন আয়ের লোকজন। এ বন্যায় উপজেলা আটটি ইউনিয়নের বিভিন্ন গ্রামীণ রাস্তাঘাট তলিয়ে উপজেলা সদরের সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। এতে পানির মধ্যে আটকে পড়া মানুষের মধ্যে বিশুদ্ধ পানি ও খাদ্যের অভাব দেখা দিয়েছে। তাছাড়া আউশ বীজতলা, কাঁচা রাস্তাঘাট, পুকুর ও ঘরবাড়ির ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে।
শনিবার সকালে সরেজমিন পর্যবেক্ষণে দেখা যায়, দু'দিনের টানা ভারী বর্ষণে উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলের পানিতে উপজেলার আটটি ইউনিয়নের খাল-বিল, ছড়া ও জলাশয়সমূহ পানিতে ভরে উঠেছে। ফলে মাঠ-ঘাট ও গ্রাম্য সড়ক পানিতে ডুবে হাজার হাজার মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন। আর ছোট বড় প্রায় দুই হাজার পুকুর পানিতে তলিয়ে গেছে। এতে স্থানীয় কৃষক ও মৎস্যচাষিরা পুকুরের মাছ বেরিয়ে যাওয়ায় আর্থিকভাবে ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছেন।