শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১
আট জেলায় অবনতির শঙ্কা

দেশের উত্তর ও মধ্যাঞ্চলে বন্যার বিস্তার বাড়ছে

পানি বাড়তে থাকায় কুড়িগ্রাম, গাইবান্ধা, বগুড়া, জামালপুর, সিরাজগঞ্জ, টাঙ্গাইল, নাটোর, রাজবাড়ী-এ আট জেলায় বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হতে পারে
যাযাদি ডেস্ক
  ১৪ জুলাই ২০২০, ০০:০০
আপডেট  : ১৪ জুলাই ২০২০, ১০:৪৪
আবারও বাড়ছে আত্রাই নদীর পানি। পস্নাবিত হয়ে জলাবদ্ধ হয়েছে হাজার হাজার হেক্টর ফসলের জমি। আর এ জলাবদ্ধ পানিতে কলাগাছ দিয়ে ভেলা বানিয়ে দুরন্তপনায় মেতেছে দুটি শিশু। ছবিটি সোমবার নওগাঁর আত্রাইয়ের আদর্শ এলাকা থেকে তোলা -পিবিএ

টানা বর্ষণ ও পাহাড়ি ঢলে নদ-নদীর পানি বাড়তে থাকায় দেশের উত্তর ও মধ্যাঞ্চলে বন্যার বিস্তার বাড়ছে। পানি বাড়তে থাকায় কুড়িগ্রাম, গাইবান্ধা, বগুড়া, জামালপুর, সিরাজগঞ্জ, টাঙ্গাইল, নাটোর, রাজবাড়ী- এ আট জেলার নিম্নাঞ্চলে বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হতে পারে বলে আভাস দিয়েছে পানি উন্নয়ন বোর্ডের বন্যা সতর্কীকরণ ও পূর্বাভাস কেন্দ্র। প্রথম দফার বন্যার ক্ষত না সারতেই দ্বিতীয় ধাপের এ বন্যায় লাখো মানুষ দুর্ভোগে পড়েছেন। গেল সপ্তাহে বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হওয়ায় দুর্গতদের অনেকেই আশ্রয়কেন্দ্র থেকে বাড়ি ফিরে আবার পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন। সোমবার সকাল ৯টায় দেশের নদ-নদীতে পানি উন্নয়ন বোর্ডের ১০১টি পর্যবেক্ষণ স্টেশনের মধ্যে ৭৮টি পয়েন্টেই পানি বেড়েছে। এর মধ্যে বিপৎসীমার উপরে বয়ে যাচ্ছিল ২২টি পয়েন্টে। ২০টি পয়েন্টে পানি কমলেও দুটি পয়েন্টে অপরিবর্তিত রয়েছে। বন্যা সতর্কীকরণ ও পূর্বাভাস কেন্দ্রের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. আরিফুজ্জামান ভূঁইয়া বলেন, ব্রহ্মপুত্র-যমুনা, গঙ্গা-পদ্মা অববাহিকার নদ-নদীর পানি বাড়ছে। আগামী ৭২ ঘণ্টা তা অব্যাহত থাকবে। সুরমা নদী ছাড়া মেঘনা অববাহিকার নদ-নদীর পানিও আগামী ২৪ ঘণ্টা বাড়তে থাকবে। ব্রহ্মপুত্র, যমুনা, পদ্মা, ধরলা, তিস্তা, ঘাগট, গুড়, আত্রাই, সুরমা, কুশিয়ারা, সারিগোয়াইন, পুরাতন সুরমা, সমেশ্বরী ও ?মুহুরী নদীর ২২টি পয়েন্টে পানি বিপৎসীমার উপরে প্রবাহিত হচ্ছে। এর মধ্যে কুড়িগ্রামে ধরলা নদীর পনি বিপৎসীমার সর্বোচ্চ ৮৮ সেন্টিমিটার উপরে বয়ে যাচ্ছে। আরিফুজ্জামান জানান, আগামী ২৪ ঘণ্টায় নীলফামারী, লালমনিরহাট ও রংপুর জেলার বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হতে পারে। সিলেট, সুনামগঞ্জ, নেত্রকোনা ও ফেনীর বন্যা পরিস্থিতি স্থিতিশীল থাকতে পারে। তবে কুড়িগ্রাম, গাইবান্ধা, বগুড়া, জামালপুর, সিরাজগঞ্জ, টাঙ্গাইল, নাটোর ও রাজবাড়ী জেলার বন্যা অবনতি হতে পারে। আমাদের সাঘাটা (গাইবান্ধা) প্রতিনিধি জানান, উজানের ঢল আর স্থানীয়ভাবে প্রবল বর্ষণে ব্রহ্মপুত্র নদের পানি হুহু করে বৃদ্ধি পাওয়ায় গাইবান্ধার ফুলছড়ি উপজেলার নিম্নাঞ্চলের ১৬টি গ্রাম পস্নাবিত হয়েছে। বাড়িঘরে পানি প্রবেশ করায় ইতোমধ্যে ওইসব গ্রামের মানুষ গবাদিপশু নিয়ে চরম বিপাকে পড়েছেন। দ্বিতীয় দফার বন্যায় ফুলছড়ি উপজেলার সৈয়দপুর ঘাট হতে বালাসীঘাট পর্যন্ত পুরানো বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধের ভাঙা অংশ দিয়ে পানি প্রবেশ করায় আবারও ভাষারপাড়া ও মাঝিপাড়া গ্রামের অনেক বাড়িঘর পানিতে তলিয়ে গেছে। এ কারণে এলাকার লোকজনকে চরম দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে। বন্যার পানিতে গাইবান্ধা-বালাসী সড়কের আধা কিলোমিটার এলাকা আবারও তলিয়ে গেছে। এদিকে পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকায় উপজেলার উত্তর উড়িয়া, রতনপুর, কাবিলপুর, ভাষারপাড়া, রসুলপুর, খলাইহাড়া, মাঝিপাড়া, ছাতারকান্দি, বাজে তেলকুপি, বুলবুলির চর, কাউয়াবাধা, উজালডাঙা, কৃষ্ণমনি, পূর্ব খাটিয়ামারী, জিয়াডাঙা ও নামাপাড়া গ্রামের লোকজনের বাড়িঘরে পানি প্রবেশ করেছে। গাইবান্ধা পানি উন্নয়ন বোর্ড জানায়, সোমবার বিকেল ৩টা পর্যন্ত পূর্ববর্তী ২৪ ঘণ্টায় ফুলছড়ির তিস্তামুখঘাট পয়েন্টে ব্রহ্মপুত্র নদের পানি ৩৬ সেন্টিমিটার বৃদ্ধি পেয়ে ৬৭ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হতে দেখা যায়। পানি বৃদ্ধির এ ধারা আরও কয়েকদিন অব্যাহত থাকবে বলে ধারণা করছে পানি উন্নয়ন বোর্ড। চিলমারী (কুড়িগ্রাম) প্রতিনিধি জানান, উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢল ও ভারী বর্ষণে চিলমারী ব্রহ্মপুত্র নদে পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় ২৫ হাজার মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন। পুটিমারী কাঁজল ডাঙ্গা, কাঁচকোল বাজার এলাকা, ফকিরেরহাট, কড়াই বরিশাল, উত্তর খাউরিয়া, দক্ষিণ খাউরিয়া, রমনা গুড়াতি পাড়া, জোড়গাছ, পাত্রখাতা, ফেইচকা, বৈলমনদিয়ার খাতা, চর মুদাফৎকালিকাপুর এলাকার বাড়িঘরে পানি উঠে ২৫ হাজার মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন। পানিবন্দি লোকেরা পাউবো বাঁধ, আশ্রয়ণ কেন্দ্র, কেসি রাস্তার ধারসহ বিভিন্ন উঁচু স্থানে আশ্রয় নিয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছেন। প্রথম দফা বন্যার পানি সরতে না সরতে দ্বিতীয় দফা বন্যায় রোপা আমন বীজতলা ও সবজি খেত পানিতে তলিয়ে গিয়ে ব্যাপক ক্ষতি সাধিত হয়েছে। পাউবো জানায়, ব্রহ্মপুত্র নদের চিলমারী পয়েন্টে গত ২৪ ঘণ্টায় ৩৯ সেন্টিমিটার পানি বৃদ্ধি পেয়ে বিপৎসীমার ৫৭ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে পানি প্রবাহিত হচ্ছে। হাতীবান্ধা (লালমনিরহাট) প্রতিনিধি জানান, ভারতের উজান থেকে নেমে আসা পানি ও পাহাড়ি ঢলে তিস্তা নদীর পানি আবারও বৃদ্ধি পেয়েছে। সোমবার তিস্তা নদীর পানি বিপৎসীমার ৪৪ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হতে দেখা গেছে। পানির স্বাভাবিক প্রবাহ ৫২:৬০ সেন্টিমিটার। বর্তমান পানি প্রবাহ ৫৩:০৪ সেন্টিমিটার। পানি অস্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধি পাওয়া ব্যারেজ এলাকায় সতর্কবার্তা দিয়ে প্রচারণা চালিয়েছে পানি উন্নয়ন বোর্ড। ব্যারেজের ৪৪ গেট খুলে পানি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা চালাচ্ছে। এদিকে, সোমবার ভোরে নিজ শয়নকক্ষে পানিতে পড়ে ৮ মাসের এক শিশু মারা গেছে। আকস্মিক বন্যায় জোলায় লক্ষাধিক মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন। এতে নতুন নতুন এলাকা পস্নাবিত হচ্ছে। ধরলার পানি বিপৎসীমার ৬৪ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। পাটগ্রামের দহগ্রাম, হাতীবান্ধা উপজেলার গড্ডিমারী, সানিয়াজান, শিংগীমারী, সিন্দুর্না, পাটিকাপাড়া, ডাউয়াবাড়ী, কালীগঞ্জের ভোটমারী, তুষভান্ডার, আদিতমারী, মহিষখোচা ও লালমনিরহাট সদরের রাজপুর, খুনিয়াগাছ, গোকুন্ডা কুলাঘাট ও মোগলহাটের বিস্তীর্ণ এলাকা পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। ঝিনাইগাতী (শেরপুর) প্রতিনিধি জানান, শেরপুর জেলার সীমান্তবর্তী ঝিনাইগাতী উপজেলায় গত ৫ দিনের প্রচুর বৃষ্টিপাত ও ভারতের মেঘালয় রাজ্য থেকে বয়ে আসা পানিতে ১১ জুলাই শনিবার ভোর থেকে মহারশি নদীতে পাহাড়ি ঢলের পানি বৃদ্ধি পায়। ঢলের এবং প্রচুর বৃষ্টিপাতে উপজেলার নিম্নাঞ্চল পস্নাবিত হয়ে যায়। ঝিনাইগাতীর বনগাঁও, চতল, বাগেরভিটা, কাংশা, দড়িকালিনগর, সারি কালিনগর, পাগলারমুখ, মালঝিকান্ধা, হাতিবান্ধা, বগাডবিসহ নিম্ন এলাকা পস্নাবিত হয়ে কৃষকের সদ্য রোপণকৃত আমন ফসলের বীজতলার ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। পানির কারণে হাজারো মানুষের জীবনযাপনে বিঘ্ন ঘটছে। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা রুবেল মাহমুদ পানিবন্দি নিম্নাঞ্চল এলাকা পরিদর্শন করেছেন। দুর্গাপুর (নেত্রকোনা) প্রতিনিধি জানান, নেত্রকোনার দুর্গাপুরে উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় বন্যা দেখা দিয়েছে। নিম্নাঞ্চলসহ কুলস্নাগড়া, গাঁওকান্দিয়া, কাকৈরগড়া ও বাকলজোড়া ইউনিয়নের শতাধিক গ্রাম পস্নাবিত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। ভেসে গেছে পুকুরের মাছ, বিনষ্ট হয়েছে আমন ধানের চারা। সোমবার সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, গত তিন দিনের টানা ভারী বর্ষণ আর ভারতের মেঘালয় থেকে আসা পানির কারণে গাঁওকান্দিয়া ইউনিয়নে প্রায় পনেরো দিনের ব্যবধানে ফের বন্যা দেখা দিয়েছে। বেড়িবাঁধ ভেঙে প্রায় ৩০টি গ্রামের মানুষ পানিবন্দি অবস্থায় জীবনযাপন করছেন। ওই এলাকার নেতাই নদীর পানি প্রবল স্রোতে গ্রামে প্রবেশ করছে। এলাকায় কোনো বেড়িবাঁধ না থাকায় ওই ইউনিয়নের বন্দউষান, ভাদুয়া, জাকিরপাড়া, শ্রীপুরসহ প্রায় ৩০টি গ্রামের মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়ছে। কাকৈরগড়া ইউনিয়নের ঝাঞ্জাইল, খাঁ পাড়া, পাল পাড়া, তাতিরকোনা, বরবাট্টা, মেকুরজানী ও সিদলী এলাকার প্রায় ৩০টি গ্রাম পস্নাবিত হয়েছে। বাকলজোড়া ইউনিয়নেরও প্রায় ১৫টি গ্রামে বন্যার পানি প্রবেশ করেছে। এছাড়া কুলস্নাগড়া ইউনিয়নের কামারখালী, কাকরাকান্দা, মাধবপুর, বিপিনগঞ্জ এলাকাসহ প্রায় ৩০টি গ্রাম পস্নাবিত হয়েছে। ওইসব গ্রামের সবক'টি গ্রামীণ সড়ক পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় যোগাযোগ ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে। ভেলা তৈরি করে মানুষ প্রয়োজনীয় কাজ সেরে নেওয়ার চেষ্টা করছেন। কাউনিয়া (রংপুর) প্রতিনিধি জানান, রংপুরের কাউনিয়ায় উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে তিস্তা নদীর পানি বেড়ে বিপৎসীমার ৮ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। পাহাড়ি ঢল নামায় বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে। বন্যায় উপজেলার প্রায় ১০ হাজার মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন। বন্যাকবলিত এলাকায় খাদ্য ও বিশুদ্ধ পানির সংকট দেখা দিয়েছে। উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন অফিসার আহসান হাবীব সরকার জানান, গত ২৪ ঘণ্টায় কাউনিয়া পয়েন্টে তিস্তা নদীর পানি বিপৎসীমার ৮ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হতে দেখা গেছে। নদীর পানি আরও বাড়তে পারে বলে পাউবো সূত্র জানিয়েছে। এদিকে, উজান থেকে ব্যাপক পরিমাণে পাহাড়ি ঢল নামায় গত তিন দিন ধরে বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে। বন্যায় উপজেলার হারাগাছ, টেমামধুপুর ও বালাপাড়া ইউনিয়নের ৩০টি গ্রামের প্রায় ১০ হাজার মানুষ পানিবন্দি রয়েছেন।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে