গোয়েন্দা প্রতিবেদন

করোনা মহামারির মধ্যেই বাড়তে পারে ডেঙ্গু

প্রকাশ | ৩১ জুলাই ২০২০, ০০:০০

তানভীর হাসান
কোরবানির পশুর হাট ঘিরে নানা ধরনের শঙ্কা তৈরি হয়েছে। এর মধ্যে কোথাও ক্রেতা-বিক্রেতারা স্বাস্থ্যবিধি না মানার কারণে করোনার বিস্তার ঘটতে পারে। হাটকে ঘিরে ছিনতাইকারী, জাল টাকা সরবরাহকারী ও অজ্ঞানপার্টির সদস্যরাও মাথাচাড়া দিতে পারে। পাশাপাশি হাটের সংখ্যা কমে আসায় ব্যাপারীদের জোর করে নিজের হাটে গরু নামাতে বাধ্য করতে পারেন ইজারাদাররা। যত্রতত্র পশু জবাই ও হাটে জমে থাকা বর্জ্য থেকে পরিবেশ দূষণের কারণে ডেঙ্গুরও প্রাদুর্ভাব ঘটারও শঙ্কা রয়েছে। সব মিলিয়ে এবার কোরবানির হাটকে ঘিরে এ ধরনের নানাবিধ শঙ্কা তৈরি হয়েছে বলে সরকারের একটি গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদনে উঠে এসেছে। ১৪ দফা সুপারিশযুক্ত ওই প্রতিবেদনের কপি চলতি সপ্তাহের শুরুতেই সরকারের উচ্চপর্যায়ে পাঠানো হয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র নিশ্চিত করেছে। সূত্রমতে, বর্তমান বিশ্বব্যাপী চলছে কোভিড-১৯ মহামারি। সাথে রয়েছে ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব। এমন পরিস্থিতিতে উদ্‌যাপিত হতে যাচ্ছে ঈদুল আজহা। এ উপলক্ষে রাজধানীসহ সারাদেশেই চলছে পশু কোরবানির আয়োজন। প্রত্যেক সিটি করপোরেশনের নির্ধারিত জবাইখানা থাকলেও সেখানে না গিয়ে বরাবরই যত্রতত্র রাস্তাঘাটে কোরবানির পশু জবাই করা হয়ে থাকে। এবারও সেই শঙ্কা রয়েছে। এতে কোরবানির পশু জবাইকে কেন্দ্র করে অধিক জনসমাগমের মাধ্যমে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ার সম্ভাবনা রয়েছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত বছর সারাদেশে প্রায় ১ কোটি ৫ লাখ পশু কোরবানি হলেও এ বছর করোনা মহামারির ফলে পরিবর্তিত আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপটে ২৫-৩০ শতাংশ কম পশু কোরবানির সম্ভাবনা রয়েছে। কোরবানির পশু জবাইয়ের জন্য সিটি করপোরেশনের এলাকাভিত্তিক জবাইখানা রয়েছে। সেখানে কোরবানির পশু জবাই নিশ্চিত করা প্রয়োজন। অন্যথায় যত্রতত্র পশু জবাইয়ের ফলে পরিবেশ দূষণ এবং ডেঙ্গু প্রাদুর্ভাব ঘটার সম্ভাবনা রয়েছে। করোনা মহামারির মধ্যে ডেঙ্গু প্রাদুর্ভাব ঘটলে তা মারাত্মক পরিস্থিতির সৃষ্টি করবে। গোয়েন্দা সংস্থাটির পর্যবেক্ষণ বলছে, করোনাভাইরাসের সংক্রমণ সবচেয়ে বেশি ঢাকায়। এমন পরিস্থিতিতে রাজধানীর ফ্ল্যাট বাড়ির পার্কিং এরিয়া, বাসাবাড়ির আঙ্গিনা ও সামনের রাস্তাসহ যত্রতত্র কোরবানির পশু জবাই করা হলে বিভিন্ন এলাকা থেকে আসা কসাই, কোরবানিকারী, মাংস সংগ্রহকারীদের অধিক সমাগম ঘটবে। ফলে স্বাস্থ্যবিধি উপেক্ষিত হবে। এতে করে মহামারি করোনা সংক্রমণের ঝুঁকি বাড়বে। এছাড়া ডেঙ্গু সময়কাল চলায় যত্রতত্র পশু জবাই করা হলে পরিবেশ দূষণের ফলে ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব ঘটার আশঙ্কা রয়েছে। করোনা মহামারিকালে ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব ঘটলে তা জনস্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক ক্ষতির কারণ হবে। এ পরিস্থিতি এড়াতে সিটি করপোরেশনের এলাকাভিত্তিক জবাইখানা নির্ধারণপূর্বক নির্ধারিত স্থানে কোরবানির পশু জবাইয়ে বাধ্যবাধকতা আরোপ করার প্রয়োজন রয়েছে। ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের কর্মকর্তারা জানান, যত্রতত্র কোরবানির পশু জবাই ও বর্জ্য ফেলার কারণে সিটি করপোরেশনের পরিচ্ছন্ন বিভাগকেও হিমশিম খেতে হয়। তাছাড়া জবাইকৃত পশুর সংখ্যা সঠিকভাবে নিরুপণও করা সম্ভব হয় না। এ থেকে নির্ধারিত করও আদায় করা সম্ভব হয় না। পাশাপাশি পশু জবাইয়ের পূর্বে তার অবস্থার কথাও জানা যায় না। কোনো ডাক্তারের কাছ থেকেও জবাইর ছাড়পত্র নেওয়া হয় না। কোভিড-১৯ মহামারির মধ্যেই প্রাক-বর্ষাকালের এ সময়ে এবার আরেক বিপজ্জনক রোগ ডেঙ্গুর প্রকোপ ধীরে ধীরে বৃদ্ধি পাচ্ছে বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। গত বছরও ডেঙ্গুর প্রকোপে নাজেহাল হয়ে উঠেছিল নগরবাসী। বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করে জানিয়েছেন, গত বছরের তুলনায় এ বছর এডিস মশাবাহিত ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব মারাত্মক আকার ধারণ করতে পারে। কারণ হিসেবে তারা বলছেন বসন্তের প্রথম দিক থেকেই মশার উপদ্রব খুব বেশি ছিল। পরবর্তীতে তা আরও বৃদ্ধি পেয়ে ভয়াবহ আকার ধারণ করার সম্ভাবনা রয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে কোভিড-১৯ আক্রান্ত রোগী যদি ডেঙ্গু আক্রান্ত হন, সেক্ষেত্রে তিনি গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়বেন। তৈরি হবে প্রাণ শঙ্কাও। এদিকে বরাবরের মতো এবারও কোরবানির পশুর চামড়ার প্রকৃত মূলপ্রাপ্তির ক্ষেত্রে ট্যানারি ব্যবসায়ীরা বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারেন বলে ইঙ্গিত করেছে গোয়েন্দা সংস্থাটি। তাদের পর্যবেক্ষণ বলছে, গত বছরে সারাদেশে কোরবানির পশুর কাঁচা চামড়া বিক্রিতে ধস নামে। গরুর একটি চামড়া বিক্রি হয়েছে সর্বোচ্চ ৫শ টাকা দরে এবং খাসির চামড়া বিক্রি হয়েছে একশ টাকা দরে। চট্টগ্রামে কাঁচা চামড়ার মূল্য না পাওয়ায় চামড়া মাটিতে পুঁতে ফেলাসহ খাল-নদী ও ময়লার ভাগাড়ে ফেলে দেওয়ার ঘটনাও ঘটে। রাজধানীতে এমন ঘটনা না ঘটলেও আড়তে চামড়া বিক্রি করতে না পেরে সাভার, হেমায়েতপুরসহ রাজধানীর প্রধান চামড়ার পাইকারি বাজার লালবাগের পোস্তায় আড়তদাররা মৌসুমি ও ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে সরকার নির্ধারিত মূল্যের চেয়ে কম দামে চামড়া কেনায় তারা লোকসানের মুখে পড়েন। পাশাপাশি গত ঈদে চামড়ার মূল্য কম হওয়ায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে কোরবানির চামড়ার প্রকৃত সুবিধাভোগী এতিম, মিসকিন, দুস্থ ও তাদের দেখভালের দায়িত্বে নিয়োজিত বিভিন্ন মাদ্রাসা, এতিমখানা ও লিলস্নাহ বোর্ডিংগুলো। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ট্যানারি মালিকরা আন্তর্জাতিক বাজারে চামড়ার মূল্য হ্রাস, পূর্বের চামড়া অবিক্রীত অবস্থায় মজুত থাকাসহ বিভিন্ন অজুহাত দিলেও বিষয়টি ট্যানারি মালিক, আড়তদার ও তাদের অ্যাসোসিয়েশনের কারসাজি ছিল বলে জানা যায়। কারণ, দেশে উৎপাদিত মোট চামড়ার ৭০ ভাগ রপ্তানি করা হলেও বাকি ৩০ ভাগ অভ্যন্তরীণ বাজারে বিক্রি হয়ে থাকে। ট্যানারির ফিনিশড লেদার দিয়ে দেশের বিভিন্ন কোম্পানি জুতা, স্যান্ডেল, ব্যাগ, বেল্ট ও অন্যান্য চামড়াজাত এক্সেসরিজ তৈরি করে থাকে। বাজারে চামড়াজাত এসব পণ্যের কোনোটিরই দাম নিম্নমুখী নয়, বরং ঊর্ধ্বমুখী। ট্যানারি শিল্পকে সুরক্ষা দিতে কাঁচা চামড়া পাচার রোধে ট্যানারি ব্যবসায়ী ও আড়তদারদের ঋণ সুবিধা ইত্যাদি প্রদান করা হলেও প্রতিবছর ক্রমান্বয়ে চামড়ার দাম কমিয়ে দেওয়ার যুক্তিসঙ্গত কোনো কারণ নেই। এর নেপথ্যে অতি মুনাফালোভী ট্যানারি মালিক, আড়তদার ও তাদের অ্যাসোসিয়েশনের যোগসাজশ রয়েছে। এ ধরনের কারসাজি প্রতিরোধে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে টাস্কফোর্স গঠনের মাধ্যমে মনিটরিংয়ের ব্যবস্থা করার সুপারিশ করেছে সংস্থাটি। পুলিশ সদর দপ্তরের এআইজি (মিডিয়া) মো. সোহেল রানা বলেন, নির্ধারিত স্থানে কোরবানির পশু জবাই এবং চামড়া পাচার রোধে বাংলাদেশ পুলিশের বিভিন্ন ইউনিটসমূহ আইনি ও সচেতনামূলক কার্যক্রম অব্যাহত রেখেছে। বিভিন্ন স্টেকহোল্ডারদের সাথে অংশীদারিত্বের সাথে সমন্বিতভাবে এ বিষয়ে পুলিশ আইনের যথাযথ প্রয়োগ নিশ্চিত করবে। এ বিষয়েও পুলিশ মহাপরিদর্শকের (আইজিপি) পক্ষ থেকে মনিটরিং করা হবে।