বন্যা পরিস্থিতি

পানি কমলেও দুর্ভোগ কমেনি

প্রকাশ | ০৯ আগস্ট ২০২০, ০০:০০

যাযাদি ডেস্ক
বন্যায় পস্নাবিত ঢাকার নিম্নাঞ্চল
কমতে শুরু করেছে বন্যার পানি। তবে, মানুষের দুর্ভোগ মোটেও কমেনি। বিভিন্ন নদীর পানি কমে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই শুরু হয়েছে ভাঙন। বন্যা শেষ হতে না হতেই এমন ভাঙনে দিশেহারা হয়ে পড়েছেন নদীপাড়ের মানুষ। এছাড়া কর্মহীন হয়ে পড়েছেন শত শত মানুষ। ফলে এসব পরিবারে দেখা দিয়েছে অভাব-অনটন, কষ্টে দিন কাটাচ্ছেন তারা। পাশাপাশি বন্যায় পানিবাহিত নানা রোগেও আক্রান্ত হচ্ছেন অনেকেই। এছাড়া বন্যায় বিভিন্ন এলাকার রাস্তাঘাট ভেঙে গেছে, ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে শত শত ঘর-বাড়ি। এখনো অনেক স্থানে ডুবে আছে বসতবাড়ি। কোথাও আবার সৃষ্টি হয়েছে স্থায়ী জলাবদ্ধতা। ফলে বানভাসিদের দুর্ভোগ এখনো আছে আগের মতোই। বানভাসিরা বলছেন, চলমান দুর্ভোগে সরকারের পক্ষ থেকে ত্রাণ সহায়তা দেওয়া হলেও প্রয়োজনের তুলনায় তা অপ্রতুল। আমাদের আঞ্চলিক অফিস, স্টাফ রিপোর্টার ও প্রতিনিধিদের পাঠানো খবর: পাবনা প্রতিনিধি জানান, পাবনায় পদ্মা ও যমুনা নদীর পানি বিপৎসীমার নীচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। গত ২৪ ঘণ্টায় যমুনার পানি কমেছে ১৫ সেন্টিমিটার। একইভাবে কমতে শুরু করেছে পদ্মার পানি। পাবনা পানি উন্নয়ন বোর্ডের উপসহকারী প্রকৌশলী মোফাজ্জল হোসেন জানান, গত ২৪ ঘণ্টায় যমুনা নদীর নগরবাড়ি মথুরা পয়েন্টে পানি কমেছে ১৫ সেন্টিমিটার। ৮ সেন্টিমিটার বিপৎসীমার নীচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। অন্যদিকে পাকশী হার্ডিঞ্জ ব্রিজ পয়েন্টে পদ্মার পানি কমতে শুরু করেছে। বর্তমানে ৯৬ সেন্টিমিটার বিপৎসীমার নীচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এদিকে পদ্মা ও যমুনা নদীর পানি কমতে শুরু করলেও নতুন করে দেখা দিয়েছে নদী ভাঙন। দিশেহারা হয়ে পড়েছে নদীপাড়ের মানুষ। নদী ভাঙন রোধে কাজ করছে পানি উন্নয়ন বোর্ড। অন্যদিকে পানি কমতে শুরু করলে নতুন করে দেখা দিয়েছে পানি বাহিত নানা রোগ। এছাড়াও মানুষের খাদ্যের পাশাপাশি গো খাদ্য সংকট সৃষ্টি হয়েছে। পাবনা জেলা প্রশাসক কবীর মাহমুদ বলেন, বন্যাদুর্গতদের মধ্যে সরকারিভাবে ত্রাণ সহায়তা কার্যক্রম অব্যাহত রয়েছে। ইতোমধ্যে জেলার ফরিদপুর, বেড়া, সুজানগর, ঈশ্বরদী ও পাবনা সদরের বেশ কিছু স্থানে ৯৫ মেট্টিক টন খাদ্য ত্রাণ হিসেবে বিতরণ করা হয়েছে। দুর্গত মানুষের সহায়তায় সরকারি এই ত্রাণসামগ্রী বিতরণ অব্যাহত রয়েছে। জেলার সিভিল সার্জন ডা. মেহেদী ইকবাল বলেন, বন্যা দুর্গতদের পাশে স্বাস্থ্য দপ্তরের কঠিন নজরদারি রয়েছে। দুর্গত মানুষের রোগ বালাই নির্মূলে মেডিকেল টিম কাজ করছে। প্রয়োজনীয় ওষুধ সরবরাহ করা হচ্ছে। ফরিদপুর প্রতিনিধি জানান, চলমান বন্যার দ্বিতীয় দফা পানি বৃদ্ধিতে ফরিদপুরে ১৫ হাজার হেক্টর জমির ফসল বিনষ্ট হয়েছে, এতে ক্ষতিগ্রস্ত ৬৩ হাজার কৃষক। যদিও স্থানীয় হিসেবে এর পরিমাণ আরও বেশি। এর মধ্যে ধান, সব্জি ও রবিশস্যের জমির পরিমাণ বেশি, রয়েছে ফরিদপুরের অন্যতম ফসল পাটও। সরেজমিন জেলার কয়েকটি ইউনিয়নে গিয়ে দেখা যায়, প্রথম দফার বন্যাতেই তলিয়ে যায় ফরিদপুরের নিম্নাঞ্চল। সে মময় ক্ষতিগ্রস্ত হয় বাদাম, ভুট্টাসহ বিভিন্ন রবিশস্য। এর পরে দ্বিতীয় দফায় পানি বাড়লে বিনষ্ট হয় পাকা ধান, সবজি ক্ষেত, কলা বাগান ও পাট। কয়েকদিনের মধ্যেই ধান ও পাট কাটার কথা ছিল কৃষকদের। কিন্তু দ্রম্নত গতিতে পানি বৃদ্ধি পেয়ে ধান ও পাট কেটে ঘরে তোলার সুযোগ হয়নি তাদের। জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক ড. মো. হযরত আলী জানান, জেলায় আউশ, রোপা আমন, বোপা আমন, রিলে আমন, বীজতলা ও সবজিক্ষেতসহ ১৪ হাজার ৬৫৮ হেক্টর জমির ফসল পানির তলিয়ে নষ্ট হয়েছে। বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে জেলার ৬৩ হাজার ৪২৫ জন কৃষক। এর বাইরে চরাঞ্চলের কলা বাগানসমূহের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে বলে জানান তিনি। সরকারি হিসাবে পাটের তথ্য উলেস্নখ না থাকলেও কৃষকরা জানিয়েছে, তাদের সকলের পাট ক্ষেত পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় তারা কাটতে পারেনি। আর এতদিন পানিতে ডুবে থাকায় ওই পাট আর কোনো কাজেও আসবে না। নর্থ চ্যানেল ইউপির গোলডাঙ্গির এলাকার চাষি হাফিজুর বলেন, একদিকে করোনায় আয়-ইনকামের পথ বন্ধ, এখন বন্যায় ক্ষতি হলো। কীভাবে চলবে, বুঝতে পারছি না। সদর উপজেলার নর্থচ্যানেল ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মুস্তাকুজ্জামান জানান, আমার ইউপির ৯০ শতাংশ পানিতে পস্নাবিত। ক্ষেত-খামার যা ছিল সব নষ্ট হয়ে গেছে। ফরিদপুর সদর উপজেলার কৃষি কর্মকর্তা মো. আবুল বাশার জানান, এলাকার চাষিদের আবাদকৃত ফসল নষ্ট হয়ে গেছে। আমরা ক্ষতিগ্রস্ত চাষিদের তালিকা করে জেলা কৃষি বিভাগকে জানিয়েছি। কাশিয়ানী (গোপালগঞ্জ) প্রতিনিধি জানান, গোপালগঞ্জ জেলার কাশিয়ানীতে বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হচ্ছে। প্রায় সাত হাজার পরিবার পানিবন্দি অবস্থায় রয়েছে। তিন শতাধিক পরিবার উঁচু ব্রিজ, কালভার্ট, রাস্তা ও আশ্রয় কেন্দ্রে বসবাস করছে। জানা গেছে, উপজেলার সিংগা, হাতিয়াড়া, পুইসুর, নিজামকান্দি, মাহমুদপুর, পারুলিয়া, মহেশপুর, সাজাইল ইউনিয়নের মানুষ বেশি ভোগান্তির স্বীকার হচ্ছে। সরকারি হিসেবে এ পর্যন্ত ৭ হাজার পরিবার পানিবন্দি অবস্থায় বসবাস করছে। তাদের গৃহপালিত পশু তাদের সঙ্গেই বসবাস করছে। উপজেলার পারুলিয়া, পুইসুর, হাতিয়াড়া, সিংগা, মাহমুদপুর ইউনিয়নসহ নিম্নাঞ্চলের অধিকাংশ পাকা রাস্তা পানিতে তলিয়ে গেছে। বিপাকে পড়ছে পথ যাত্রীরা। বন্যা পরিস্থিতির আরত অবনতি হলে নিম্নাঞ্চলের সঙ্গে উপজেলা ও জেলার যোগাযোগ বিছিন্ন হতে পারে। উপজেলা ভারপ্রাপ্ত কৃষি কর্মকর্তা তিলোক কুমার ঘোষ জানান, আউশ ৮১২ হেক্টর, আমন ১২৪০ হেক্টর ও সবজি ৫০০ হেক্টর জমির ক্ষতি হয়েছে। এতে কৃষক ব্যাপক ক্ষতির শিকার হয়েছে। উপজেলা নির্বাহী অফিসার রথীন্দ্রনাথ রায় জানান, পর্যাপ্ত ত্রাণের ব্যবস্থা আছে। বন্যায় ক্ষতিগ্রস্তদের সরকারিভাবে সহযোগিতা অব্যাহত থাকবে। কৃষকদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা হবে। খুলনা অফিস জানায়, খুলনা পাইকগাছার দেলুটি ইউনিয়নের চক্রিবক্রি বদ্ধ জলমহলের বাঁধ ভেঙে ৩টি গ্রাম পস্নাবিত হয়েছে। এতে ধানের বীজতলাসহ ফসলের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। স্থানীয় চেয়ারম্যানের নেতৃত্বে স্বেচ্ছাশ্রমে বাঁধ মেরামত করে পস্নাবিত এলাকা রক্ষার চেষ্টা করা হচ্ছে। উপজেলার দ্বীপ বেষ্টিত ৪নং দেলুটি ইউনিয়ন গত ঘূর্ণিঝড় আম্পানে শিবসা নদীর গেওয়াবুনিয়া ও কালিনগরের ওয়াপদার বাঁধ ভেঙে ব্যাপক এলাকা পস্নাবিত হয়। যার ক্ষয়ক্ষতির রেশ কাটিয়ে উঠতে না উঠতেই বুধবার দুপুরে জোয়ারের পানির চাপে চক্রিবক্রি বদ্ধ জলমহলের ক্ষতিগ্রস্ত বাঁধ ভেঙে গেওয়াবুনিয়া, পারমধুখালী ও চক্রিবক্রির এলাকা পস্নাবিত হয়েছে। যাতে আমন ধানের বীজতলা, মৎস্য ঘের, ফসলের ক্ষেত পস্নাবিত হয়ে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ঘর-বাড়ি। পানিবন্দি হয়ে পড়েছে শত শত পরিবার। স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান রিপন কুমার মন্ডল জানান, খুলনার জনৈক আনাম চক্রিবক্রির ৩৭ একর জলমহলটিতে মাছ চাষ করে আসছে। অথচ খালের উত্তর ও দক্ষিণপাশে দুটি বাঁধ মেরামত না করায় বাঁধটি ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়ে। ফলে জোয়ারের পানির চাপে উত্তরপাশের বাঁধ ভেঙে ৩টি গ্রাম পস্নাবিত হয়। শনিবার সকালে স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান রিপন কুমার মন্ডলের নেতৃত্বে স্বেচ্ছাশ্রমে বাঁধটি মেরামত করলেও বাঁধটি ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। উপজেলা নির্বাহী অফিসার এবিএম খালিদ হোসেন সিদ্দিকী বলেন, জলমহলটির ইজারা বাতিল করা হয়েছে। ভাঙন কবলিত এলাকার রিপোর্ট প্রদানের জন্য কানুনগোকে পাঠানো হয়েছে। টেকসই বাঁধ মেরামতের ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে।