বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১
পানি কমলেও দুর্ভোগ কমেনি

বানভাসিদের মানবেতর জীবনযাপন

যাযাদি ডেস্ক
  ১১ আগস্ট ২০২০, ০০:০০
আপডেট  : ১১ আগস্ট ২০২০, ২১:৩৯

দেশের বিভিন্ন নদ-নদীর পানি কমে বিপৎসীমার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হলেও সার্বিক বন্যা পরিস্থিতির তেমন উন্নতি হয়নি। বন্যাকবলিত এলাকায় পানি কমলেও বাড়িঘরে ফেরার অবস্থা না থাকায় দুর্গতরা বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধে আশ্রয় নিয়েছেন। সেখানে খাবার ও বিশুদ্ধ পানির সংকট দেখা দিয়েছে। আমাদের আঞ্চলিক অফিস ও প্রতিনিধিদের খবর: শাহজাদপুর (সিরাজগঞ্জ) :যমুনা ও বড়াল নদীর পানি কমে বিপৎসীমার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হলেও সার্বিক বন্যা পরিস্থিতির তেমন উন্নতি হয়নি। প্রায় দেড় মাস অতিবাহিত হলেও শাহজাদপুর উপজেলার বন্যাদুর্গতদের অনেকে এখনো বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধে বা জলমগ্ন বাড়িতে অতিকষ্টে বসবাস করছেন। যমুনা, বড়াল, করতোয়া, হুরাসাগর নদীর পানি কমলেও বাড়িঘরে ফেরার অবস্থা না থাকায় দুর্গতরা বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধে আশ্রয় নিয়ে আছেন। অনেকে ডুবে যাওয়া বাড়ির কাছে বাঁশের মাচা তৈরি করে, কেউ কলার ভেলায় সেখানে অতিকষ্টে বসবাস করছেন। তাদের খাবার ও বিশুদ্ধ পানির সংকট দেখা দিয়েছে। চলতি বন্যায় বিপর্যস্ত হয়ে গেছে শাহজাদপুর উপজেলার প্রত্যন্ত জনপদ। পানি নেমে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে জেগে উঠতে শুরু করেছে বন্যার ভয়াবহ ক্ষত। রাস্তাঘাট, ব্রিজ-কালভার্ট, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, হাটবাজার, বসতবাড়ি কোনোটিই বাদ যায়নি বন্যার ছোবল থেকে। অথচ কিছুদিন আগেও এসব এলাকার রাস্তাঘাট, ঘরবাড়ি ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো দৃষ্টিনন্দন ছিল। নিম্নাঞ্চল হিসেবে পরিচিত উপজেলার ১৩টি ইউনিয়নের বেশির ভাগ গ্রামই আক্রান্ত হয়েছে বন্যার ভয়াবহতায়। বিশেষ করে শাহজাদপুর-জামিরতা সড়ক, গোপালপুর-এনায়েতপুর সড়ক, রাণীকোলা-পোরজনা সড়ক সম্পূর্ণ চলাচল অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। সরেজমিন ঘুরে উপজেলার বিভিন্ন কাঁচা-পাকা সড়কের বেহাল চিত্র লক্ষ করা গেছে। এসব সড়ক দিয়ে যানবাহন তো দূরের কথা, হেঁটে চলাই কঠিন। ফলে জনদুর্ভোগ বাড়ছে চরমভাবে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোরও বেহাল দশা। বিশেষ করে বিভিন্ন আধাপাকা হাইস্কুল, মাদ্রাসা, কিন্ডারগার্টেন বন্যায় চরম ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠান দ্রম্নত সংস্কার করা না গেলে পাঠদানে বিঘ্ন ঘটবে। একই অবস্থা উপজেলার গ্রামীণ হাটবাজারগুলোর। বন্যায় বিধ্বস্ত বাজারগুলোর অবকাঠামো ভেঙে পড়েছে। ব্যবসাবাণিজ্যেও চরম বিঘ্ন ঘটছে। বিশেষ করে যমুনাতীরবর্তী গ্রামগুলোর অবস্থা একেবারেই নাজুক। যমুনা চরের বাসিন্দাদের ঘরবাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে রেকর্ডসংখ্যক। নতুন করে ঘুরে দাঁড়ানোর মতো অর্থ নেই বানভাসি অসহায় পরিবারগুলোর। এ জন্য তারা সরকারি বেসরকারি সাহায্য কামনা করেছেন। বানভাসি অনেকেই বাড়িঘর বিধ্বস্ত হওয়ায় ঘরে ফিরতে পারছেন না। অনেকে এখনো সড়ক মহাসড়কে ডেরা বেঁধে বসবাস করছেন। বন্যার পর থেকেই নিম্ন্ন আয়ের শ্রমজীবী মানুষের কোনো কাজকর্ম না থাকায় পরিবার পরিজন নিয়ে চলছে মানবেতর জীবনযাপন। খেয়ে না-খেয়ে দিন কাটছে তাদের। এখন বিধ্বস্ত বাড়িঘর সংস্কার মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা হয়ে দাঁড়িয়েছে। পানি নেমে গেলেও অনেক স্থানে এখনো পানি রয়েছে বাড়ির আঙিনায়। ফলে চলাচলে চরম বিঘ্ন ঘটছে। বাড়ির উঠানে কাদা জমে আছে হাঁটুসই। ফলে দুর্ভোগের যেন শেষ নেই। ফলে ভয়াবহ বন্যার প্রায় এক মাস পেরিয়ে গেলেও দুর্ভোগ এখনো পিছু ছাড়েনি এসব বন্যাকবলিত মানুষের। বন্যার পানিতে ভেঙে গেছে শত শত বাড়িঘর। বন্যার শুরু থেকে এ পর্যন্ত আশ্রয়হীন হয়ে খোলা আকাশের নিচে এখনো দিনাতিপাত করছে অর্ধশতাধিক পরিবার। যাদের অধিকাংশ পরিবারই সরকারি কোনো সহায়তা পায়নি। হাতে গোনা কিছু এলাকায় ত্রাণসহায়তা দেওয়া হলেও বেশির ভাগ মানুষ বঞ্চিত হয়েছে। লোহাগড়া (নড়াইল) : ১১০ বছরের এই বয়োবৃদ্ধ নারী কানে একটু কম শুনতে পেলেও চোখে দেখেন ঠিকই। তাই এ এলাকার দীর্ঘদিনের নদীভাঙনের দুঃখ-দুর্দশার জীবন্ত সাক্ষী তিনি। মধুমতি নদী ভাঙতে ভাঙতে এবার বয়োবৃদ্ধ এই নারীর খুপরি ঘরের কাছেই হানা দিয়েছে। শেষ সম্বল ভিটেমাটিটুকু হারানোর শঙ্কায় চোখে-মুখে দুশ্চিন্তার যেন শেষ নেই তার। লোহাগড়া উপজেলার ইতনা ইউনিয়নের চরপরাণপুর গ্রামের বয়োবৃদ্ধ অজিরন নেসার (১১০) মতো এ এলাকার শতাধিক মানুষ ভাঙন-আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছেন। ইতনা ইউনিয়নের পীরচরসুচাইল গ্রামের শেখ আব্দুল মান্নান বলেন, এ এলাকার বেশির ভাগ মানুষ কৃষক ও শ্রমজীবী। দীর্ঘ ১০ বছর ধরে মধুমতি নদীভাঙনে দিশেহারা আমরা। চরসুচাইল, চরপাঁচাইল, চরপরাণপুর ও চরঘোনাপাড়ার লোকজন বেশি ক্ষতিগ্রস্ত। ভাঙন প্রতিরোধে দ্রম্নত কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ না করলে ১৯৩১ সালে প্রতিষ্ঠিত চরসুচাইল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়টি নদীতে বিলীন হয়ে যাবে। ইতোমধ্যে স্কুলের এক একর ১০ শতক মাঠ নদীতে বিলীন হয়ে গেছে। পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) কর্তৃপক্ষের কাছে বারবার আবেদন করেও কোনো সুফল মেলেনি। চরসুচাইল গ্রামের আশরাফ শেখ, আজিজুর রহমান, কুলসুম বেগম, মালেকা বেগম, সোহেল মুন্সী ও রাজিবসহ ভুক্তভোগীরা জানান, প্রায় ১০ বছর ধরে এ এলাকায় নদীভাঙন অব্যাহত থাকলেও প্রতিরোধে কার্যকর কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি। এছাড়া চরসুচাইলসহ চারটি গ্রামের শতাধিক বাড়িঘর, হাজারো গাছপালা ও কৃষি জমি নদীগর্ভে চলে গেছে। চরসুচাইল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মুন্সী কামরুজ্জামান বলেন, ১০ বছর আগে এই বিদ্যালয়ে শিক্ষক হিসেবে যোগদান করি। প্রথম দিকে ২০০ ছাত্রছাত্রী পেলেও নদীভাঙনের শিকার হয়ে অনেকে এলাকা ছেড়ে অন্যত্র চলে গেছে। বর্তমানে প্রথম থেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষার্থীর সংখ্যা ১১০ জন। স্কুল মাঠটিও নেই, এক বছর আগে নদীগর্ভে চলে গেছে। এখন টিনশেডের পাকাঘরটির কাছেই ভাঙন শুরু হয়েছে। ভাঙন থেকে মাত্র ১০ ফুট দুরে আছে স্কুলঘরটি। এ ব্যাপারে পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) নড়াইলের কর্মকর্তারা জানান, চরসুচাইল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়সহ এ এলাকার ভাঙন প্রতিরোধে গত বছর একটি প্রকল্প দাখিল করা হলে ২ কোটি টাকা বরাদ্দ হয়, যা দিয়ে ১৭০ মিটার কাজ বাস্তবায়ন সম্ভব হলেও ভাঙন প্রতিরোধে কার্যকর ভূমিকা রাখা সম্ভব হতো না। তাই পাউবোর ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ প্রকল্পটি গ্রহণ করেনি। পরে মধুমতি নদীর অতিকূল ঝুঁকিপূর্ণ প্রকল্পের আওতায় এলাকাটি অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এখানে ৬০০ মিটার নদীতীর সংরক্ষণ কাজ বাস্তবায়ন করা হবে। এক্ষেত্রে প্রস্তাব অনুযায়ী ৮ কোটি টাকা প্রয়োজন। আশা করা যাচ্ছে, চলতি বছরের ডিসেম্বরের মধ্যে প্রকল্পটি অনুমোদন হতে পারে। নেত্রকোনা : নেত্রকোনার বিভিন্ন নদ-নদীর পানি কমতে শুরু করেছে। তবে জেলার বিভিন্ন উপজেলায় মানুষের মধ্যে বাড়ছে দুর্ভোগ। ধনু নদীর পানি বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। দুর্গাপুরের সোমেশ্বরী, উদ্ধাখালী, মগড়া, ধনু, কংসসহ বিভিন্ন নদ-নদীর পানি কমতে শুরু করেছে। বিভিন্ন নদ-নদীর পানি বিপৎসীমার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। ধনু নদীর পানি খালিয়াজুরী এলাকায় বিপৎসীমার ৩০ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এছাড়া বারহাট্টা, আটপাড়া, কলমাকান্দা, পূর্বধলা, মোহনগঞ্জ, মদন, খালিয়াজুরী, সদর উপজেলার নিম্নাঞ্চলের মানুষ এক মাসের অধিক সময় ধরে পানিবন্দি হয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছেন। ওই সমস্ত উপজেলায় আমন জমিতে জলাবদ্ধতা থাকায় চাষাবাদ ব্যাহত হচ্ছে। চারপাশে পানি থাকায় মানুষ বাড়ি থেকে বের হতে পারছে না। দেখা দিয়েছে বিশুদ্ধ পানীয় জলের সংকট।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে