করোনাভাইরাস

দেশের স্বাস্থ্য খাতে তালগোলে পরিস্থিতি

প্রকাশ | ১৬ আগস্ট ২০২০, ০০:০০

জাহিদ হাসান
দেশে করোনা সংক্রমণের দীর্ঘ ৬ মাস পার হলেও ভাইরাসটি প্রতিরোধে কার্যকর ভূমিকা কী হবে- তা এখন পর্যন্ত নির্ধারণ করতে পারেনি সরকার। বরং শুরু থেকেই সংক্রমণ প্রতিরোধে আক্রান্ত ব্যক্তিদের শনাক্তকরণ, পরীক্ষা-নিরীক্ষা বৃদ্ধি ও করোনা ডেডিকেটেড হাসপাতালের সেবাব্যবস্থা প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। এমন তালগোলে পরিস্থিতিতে ভাইরাসটির দ্বিতীয় ঢেউ এলে কীভাবে সামাল দেওয়া হবে তা নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। জনস্বাস্থ্যবিদরা বলছেন, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরসহ সরকারের একাধিক দপ্তরের মধ্যে সমন্বয়হীনতায় ক্রমেই স্বাস্থ্য খাতের নাজুক পরিস্থিতি প্রকাশ পাচ্ছে। সর্বশেষ করোনা পরীক্ষা নিয়ে বেসরকারি হাসপাতালের সীমাহীন দুর্নীতির বিষয় সামনে আসায় সাধারণ মানুষের মধ্যে আরও বেশি অনাস্থা তৈরি হয়েছে। যদিও এ থেকে উত্তরণে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তরে কিছু কর্মকর্তার চেয়ার রদবদল হয়েছে। কিন্তু আদতে সেবা ব্যবস্থার তেমন উন্নতি হচ্ছে না। বিশেষজ্ঞদের অভিযোগ- গত বছরের শেষদিকে চীনে প্রথম করোনা প্রাদুর্ভাব দেখা দেওয়ার পর প্রস্তুতি গ্রহণে বাংলাদেশ বেশ সময় পেয়েছে। করোনা প্রকোপের ভয়াবহতা আঁচ করে শুরু থেকে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও জনস্বাস্থ্যবিদরা পরীক্ষা বাড়ানোর উপর গুরুত্বারোপ করেছেন। কিন্তু ভাইরাসটির প্রার্দুভাব মোকাবিলায় নানা সময়ে সরকারের নীতিনির্ধারক ব্যক্তিদের হাস্যকর মন্তব্যে কী ধরনের কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে সে ব্যাপারে তালগোলে পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। সর্বোপরি স্বাস্থ্য খাত সংশ্লিষ্টদের জড়িয়ে নানা অনিয়ম অব্যবস্থাপনা ও কৌশল নির্ধারণে ব্যর্থতায় সংক্রমণ শুরুর (জানুয়ারি-ফেব্রম্নয়ারি) দিকে প্রায় ৭ লাখ প্রবাসী বাংলাদেশি দেশে ফিরলেও যথা সময়ে তাদের দেহে ভাইরাসটির সংক্রমণ শনাক্ত করে আইসোলেশন (পৃথকীকরণ), কোয়ারেন্টিন (সঙ্গনিরোধ) এবং রেড, ইয়োলো, গ্রিন জোন করে সংক্রমণভেদে অঞ্চলভিত্তিক লকডাউন (অবরুদ্ধ) শতভাগ বাস্তবায়ন হয়নি। দুটি ঈদসহ লকডাউনের ছুটিতে সাধারণ মানুষের মধ্যে স্বাস্থ্যবিধি প্রতিপালনও নিশ্চিত করা যায়নি। এসবের মধ্যে ৮ মার্চ দেশে প্রথম করোনা পজিটিভ ব্যক্তি শনাক্তের পর উপসর্গযুক্ত ও সন্দেহভাজন ব্যক্তিরা করোনা পরীক্ষা করাতে চাইলেও স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ও মন্ত্রণালয় চরম ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, যেসব নির্দেশকের মাধ্যমে সংক্রমণ কমার প্রবণতা বোঝা যায় তার কোনোটাই বাংলাদেশে দেখা যাচ্ছে না। কারণ সংস্থাটির (ডবিস্নউএইচও) মতে, টানা এক থেকে ৩ সপ্তাহ ধরে নতুন রোগী শনাক্ত, পরীক্ষার তুলনায় রোগী শনাক্তের হার ও মৃতু্য কমে এলে সংক্রমণ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে এসেছে বলা হয়। কিন্তু বর্তমানে পরীক্ষা কমে যাওয়ায় নতুন রোগী শনাক্ত কমেছে। শনিবার পর্যন্ত আক্রান্তের সংখ্যা পৌনে তিন লাখে (দুই লাখ ৭৪ হাজার ৫২৫ জন) পৌঁছেছে। বর্তমানে করোনা শনাক্তে শীর্ষ দেশগুলোর তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান ১৬তম। এমনকি বাংলাদেশে প্রতি ১০ লাখে মাত্র ৮ হাজার ৫৯ জনের করোনা পরীক্ষা হচ্ছে। এছাড়া ওয়ার্ল্ডো মিটারসের পরিসংখ্যান অনুযায়ী দুই লক্ষাধিক ব্যক্তি আক্রান্ত আছে এমন দেশের মধ্যে সবচেয়ে কম পরীক্ষা হচ্ছে বাংলাদেশে। জানতে চাইলে করোনা মোকাবিলায় জাতীয় পরামর্শক কমিটির একাধিক সদস্য যায়যায়দিনকে বলেন, দেশে ২৬ মার্চ থেকে ৩০ মে পর্যন্ত ঢিলেঢালা লকডাউন চললেও তা তুলে দেওয়ার পর সংক্রমণের চতুর্থ মাস বা গত জুনে পরিস্থিতি তীব্র আকার নেয়। আক্রান্ত, মৃতু্য যখন দ্রম্নত বাড়ছিল, তখন জুলাই মাসের শুরুতে এসে করোনা শনাক্তের পরীক্ষায় ফি আরোপ করে সরকার। পাশাপাশি আরও কয়েকটি নিয়ন্ত্রণমূলক ব্যবস্থার ফলে পরীক্ষার সংখ্যা কমে যায়। জুনে যেখানে প্রতিদিন ১৫ থেকে ১৮ হাজার নমুনা পরীক্ষা হয়েছে। জুলাইয়ে সেটা ১৪ হাজারের নিচে নেমে এসেছে। ফলে জুনের তুলনায় জুলাইয়ে প্রায় ১ লাখ ৩০ হজারের মতো পরীক্ষা কম হয়েছে। এটি এর আগের মাসের চেয়ে প্রায় ২০ হাজার কম। ওই মাসে করোনায় মৃতু্য হয়েছে ১ হাজার ১৩৬ জনের। এছাড়া সংক্রমণ হার পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, পঞ্চম মাসে মোট পরীক্ষা করা নমুনার ২৩ দশমিক শূন্য ৪ শতাংশ ছিল পজেটিভ বা করোনা আক্রান্ত। এর আগে সংক্রমণের চতুর্থ মাসে শনাক্তের হার ছিল ২১ দশমিক ৫১ শতাংশ। তার আগের মাসে ছিল ১৮ দশমিক ৪৯ শতাংশ। সংক্রমণের দ্বিতীয় মাসে এই হার ছিল ১১ দশমিক ৭৮ শতাংশ এবং প্রথম মাসে ছিল ৪ দশমিক ২২ শতাংশ। এরই ধারাবাহিকতায় ভাইরাস আক্রান্ত হয়ে দেশে মার্চ মাসে ২০ জন, এপ্রিলে ১৮৬ জন, মে মাসে ৭২৪ জন, জুনে ১ হাজার ২৬৭ ও জুলাইতে এসে ১ হাজার ১৬৮ জনের মৃতু্য হয়। আর ৮ মার্চের পর থেকে এখন পর্যন্ত (১৫ আগস্ট শনিবার) করোনায় মারা গেছেন ৩ হাজার ৬২৫ জন। বিষয়টি সম্পর্কে জানতে চাইলে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার দক্ষিণ-পূর্ব এশীয় অঞ্চলের সাবেক উপদেষ্টা ডা. মোজাহেরুল হক যায়যায়দিনকে বলেন, করোনার পরীক্ষা ও সনদ জালিয়াতি ছাড়াও চিকিৎসা ব্যবস্থায় দায়িত্বহীনতা, অব্যবস্থাপনা ও বিশৃঙ্খলার কারণে হাসপাতালের উপর মানুষ আস্থা হারিয়ে ফেলছে। ফলে ৭৭ শতাংশ শয্যা খালি পড়ে থাকছে। পরিকল্পিতভাবে চারটি উপসর্গ ছাড়া নমুনা পরীক্ষা না করা, পরীক্ষায় ফি আরোপ করে পরিস্থিতি আরও তালগোল করে ফেলা হচ্ছে। এমনকি দেশের ৮৭টি পরীক্ষাকেন্দ্রে দৈনিক ২০ হাজার পরীক্ষা সম্ভব হলেও তা ১২ থেকে ১৫ হাজারের ঘর পার হচ্ছে না। সংক্রমণের ৫ মাস পার হলেও ৪২টি জেলায় আরটি পিসিআর ল্যাব স্থাপন করা হয়নি। মূলত করোনা মোকালিয়া ব্যর্থ ও অযোগ্য লোক দায়িত্বে থাকায় গুণগত পরির্বতন হচ্ছে না। জনস্বাস্থ্যবিদ ডা. হাবিবুলস্নাহ তালুকদার রাসকিন যায়যায়দিনকে বলেন, করোনার শুরু থেকেই গণমুখী স্বাস্থ্যসেবা চালু করা জরুরি হলেও সরকার ব্যর্থ হয়েছে। এ জন্য জনস্বাস্থ্য, স্বাস্থ্য অর্থনীতি ও চিকিৎসা ব্যবস্থাপনায় বিশেষজ্ঞদের সমন্বয়ে কাজ করা জরুরি হয়ে পড়ছে বলে মন্তব্য করেন তিনি। সবশেষ জাতীয় রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার সাবেক পরিচালক ও বিশিষ্ট ভাইরোলজিস্ট অধ্যাপক ডা. বে-নজির আহম্মেদ যায়যায়দিনকে বলেন, সংক্রমণ শুরুর আগে থেকেই সরকারের স্বাস্থ্য খাতে দায়িত্বরতদের মধ্যে কার্যকর পদক্ষেপে সমন্বয়হীনতা দেখা গেছে। ফলে ভাইরাস প্রতিরোধে ব্যর্থ হচ্ছে। এর মূল কারণ দীর্ঘ ৬ মাস একাধিক কমিটি বারবার সুনির্দিষ্ট কিছু বিষয়ে পরামর্শ দিলেও তা বাস্তবায়ন না করা। আর এমনটা চলতে থাকলে আগামীতে পরিস্থিতি আরও জটিল হবে।