বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

পস্নাজমা রূপ নিচ্ছে ব্যবসায় মানা হচ্ছে না নিয়মনীতি

যাযাদি ডেস্ক
  ১৫ সেপ্টেম্বর ২০২০, ০০:০০
কোভিড-১৯ থেকে সেরে ওঠা রোগীর পস্নাজমা

সুনির্দিষ্টভাবে কোভিড-১৯ আক্রান্ত রোগীকে সুস্থ করে তোলা নয় বরং সুস্থ হতে সহায়ক ভূমিকা পালন করা পস্নাজমা থেরাপি আশার আলো দেখিয়েছিল। গুরুতর রোগীদের চিকিৎসায় পস্নাজমা থেরাপি প্রয়োগ করে ভালো ফলাফল পাওয়া যাচ্ছে- এমন আশায় এর প্রতি ঝোঁকও বেড়েছিল। তবে দিনে দিনে সে ঝোঁক ব্যবসার দিকে রূপ নিচ্ছে, মানা হচ্ছে না কোনো নিয়মনীতি। এমনকি সর্বোচ্চ দুই ব্যাগ পস্নাজমা দেওয়া যায় বলে চিকিৎসকরা জানালেও ব্যবসার উদ্দেশে কোনো কোনো চিকিৎসক পাঁচ ব্যাগ পস্নাজমা দিতে হবে বলেও রোগীর স্বজনদের জানাচ্ছেন। পস্নাজমা দেওয়ার জন্য অ্যান্টিবডি টেস্ট করা আবশ্যক হলেও অ্যান্টিবডি টেস্ট ছাড়াই পস্নাজমা দেওয়া হচ্ছে। এমনকি নন-কোভিড রোগী থেকেও পস্নাজমা নেওয়া হচ্ছে বলে অভিযোগ রয়েছে। রক্তের তরল, হালকা হলুদাভ অংশকে পস্নাজমা বা রক্তরস বলে। তিন ধরনের কণিকা ছাড়া রক্তের বাকি অংশই রক্তরস। মেরুদন্ডী প্রাণীর শরীরের রক্তের প্রায় ৫৫ শতাংশই রক্তরস। ইতোমধ্যে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যসহ কয়েকটি দেশে পস্নাজমা থেরাপির মাধ্যমে কোভিড-১৯ আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা পস্নাজমা থেরাপিকে শুধু পরীক্ষামূলক প্রয়োগের পর্যায়ে রাখার জন্য বলে একটি অন্তর্র্বর্তীকালীন গাইডলাইন দিয়েছে। যেখানে একে 'ইনভেস্টিগেশনাল থেরাপিউটিকস' বলা হয়েছে। সংস্থাটি বলছে, এটা সব রোগীর ওপর নিশ্চিতভাবে কাজ করছে এমন প্রমাণ নেই। জানতে চাইলে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক নাসিমা সুলতানা বলেন, এখনো আমাদের নিজেদের কোনো গাইডলাইন নেই, করোনাভাইরাসের সব চিকিৎসাই এখনো পরীক্ষামূলক। পস্নাজমা থেরাপিও তার ব্যতিক্রম নয়। দেশে ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল ছাড়া পস্নাজমা থেরাপি না দিতে কোভিড-১৯ বিষয়ক জাতীয় পরামর্শক কমিটির সুপারিশ থাকলেও সেটা মানা হচ্ছে না। নেই কোনো মনিটরিং সিস্টেম। যে কারণে চিকিৎসক ও রোগীর স্বজনদের চাহিদাকে কেন্দ্র করে চলছে পস্নাজমা ব্যবসা। চিকিৎসকরা বলছেন, বলার মতো যথেষ্ট তথ্য-উপাত্ত নেই যে করোনা আক্রান্ত রোগীর চিকিৎসায় পস্নাজমা থেরাপি ইফেক্টিভ। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাও পস্নাজমা থেরাপি রিকমেন্ড করেনি। কিন্তু তারপরও কিছু কিছু বিজ্ঞানী বলছেন, এটা কাজ করে। অভিযোগ উঠেছে, পস্নাজমার ওভার ইউজ হচ্ছে দেশে। কিন্তু চিকিৎসকদের কোনো অধিকার নেই প্রেসক্রাইব করার আগে সেটা ব্যবহার করা, যা কি না দীর্ঘমেয়াদে গিয়ে কোনো মারাত্মক ক্ষতির কারণ হতে পারে। তবে মারা যেতে পারেন বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে এবং আর কোনো অপশন হাতে নেই এমন রোগীকে পস্নাজমা দিয়ে দেখা যেতে পারে। একে বলা হয় 'কমপেসনেট গ্রাউন্ড বা রিজন'। আর সেটা কোনোভাবেই ভিত্তিহীন হওয়া যাবে না। শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগের সাবেক প্রধান অধ্যাপক ডা. রিদওয়ানুর রহমান বলেন, দুই রকমের অ্যান্টিবডি তৈরি হয় শরীরে। পস্নাজমা দিতে হবে করোনা থেকে সেরে ওঠার চার থেকে ছয় সপ্তাহ পর। তবে এর সঙ্গে আরও অনেক বিষয় জড়িত মন্তব্য করে অধ্যাপক রিদওয়ানুর রহমান বলেন, কিন্তু এতে 'এক্সপেকটেড বেনিফিট' পাওয়ার সুযোগ নেই যদি সব ক্রাইটেরিয়া ফুলফিল করে না দেখা হয়। আর এজন্য আমাদের দেশে বাইন্ডিং অ্যান্টিবডির ওপর নির্ভর করে যে পস্নাজমা থেরাপি দেওয়া হচ্ছে, এতে রোগীর কোনো উপকার নাও হতে পারে। এমনকি এটা তার জন্য ক্ষতিকরও হতে পারে। তার মতে, এখন ক্ষতিটা বোঝা না গেলেও হয়তো এক বছর পর কিংবা আরও বেশি হলে পাঁচ বছর পর বোঝা যাবে। তিনি বলেন, আর এসব কারণেই বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা রিকমেন্ড করতে পারছে না। তাই এটা একটা 'ডাউটফুল' বিষয়। একে কোনোভাবেই ওভার ইউজ করা যাবে না, একে রেস্ট্রিকটেড ইউজ করতে হবে, গাইড লাইন রিকমেন্ডেড হতে হবে। অধ্যাপক রিদওয়ানুর বলেন, দুনিয়ার কোথাওর্ যান্ডমলি পস্নাজমা ব্যবহার হচ্ছে না যেটা বাংলাদেশে হচ্ছে। সেটা কোনো না কোনো কারণে হচ্ছে। কিন্তু কোনো নিশ্চয়তা নেই যে এটা রোগীকে ভালো করবে, আর যদি নিশ্চয়তা থাকত আমেরিকাতে দুই লাখ মানুষ মারা যেত না। শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন অ্যান্ড পস্নাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের বস্নাড ট্রান্সফিউশন বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. আশরাফুল হক বলেন, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে মানুষ খুব সক্রিয়। একইসঙ্গে যারা করোনা থেকে সুস্থ হয়েছেন তারা অনেকেই পস্নাজমা দিতে আগ্রহী হয়েছেন। ফেসবুকে পস্নাজমা দেওয়ার বিষয়ে অনেক গ্রম্নপ হয়েছে। দেশের বড় বড় বেসরকারি করপোরেট হাসপাতাল থেকে যখন পস্নাজমার জন্য ডিমান্ড আসে, তখন ফেসবুকের সেসব পেজ থেকে তথ্য সংগ্রহ করে পস্নাজমা দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু করোনাতে আক্রান্ত হয়ে যাদের মাইল্ড সিম্পটম থাকে তাদের শরীরে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই অ্যান্টিবডি হয় না এবং হলেও পরিমাণ খুব কম, যেটা দিয়ে আসলে আরেকজনের কোনো উপকারের সম্ভাবনা থাকে না। যে কারণে যারা মডারেট টু সিভিয়ার রয়েছেন, তাদেরকে দেখে নিতে হয় যে অ্যান্টিবডি কতটুকু রয়েছে। কিন্তু সেটা না করে পস্নাজমা দেওয়ার বিধান কোথাও নেই। কিন্তু অত্যন্ত দুঃখজনক, রাজধানীর প্রথম সারির বেসরকারি করপোরেট হাসপাতালগুলোতে এক দিনের জন্য অ্যান্টিবডি টেস্ট করে নাই, তারা পস্নাজমা দিয়ে দিচ্ছে রোগীদের থেকের্ যান্ডমলি নিয়ে। তিনি আরও বলেন, এমনকি দুই ব্যাগ পস্নাজমা দেওয়ার দরকার না হলেও হাসপাতাল থেকে পাঁচ ব্যাগ পস্নাজমা দিচ্ছেন- এর আদৌ কোনো ভিত্তি নেই, সম্পূর্ণ ব্যবসার উদ্দেশে এটা করা হচ্ছে। একেক ব্যাগ পস্নাজমার দাম নেওয়া হচ্ছে ২০ হাজার টাকা কমপক্ষে, পাঁচ ব্যাগ পস্নাজমা থেকে নিদেনপক্ষে এক লাখ টাকা ব্যবসার সুযোগ রয়েছে। অথচ দুই ব্যাগের বেশি পস্নাজমা সারাবিশ্বে কোথাও ব্যবহারের কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি, তাই এটা বাংলাদেশের কোভিড বিষয়ক গাইডলাইনেও থাকা উচিত। শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিক্যাল কলেজের ভাইরোলজি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. জাহিদুর রহমান বলেন, অ্যান্টিবডি টেস্ট না করে পস্নাজমা দেওয়ার কোনো সুযোগ নেই। তাছাড়া এক্ষেত্রে শুধু অ্যান্টিবডি আছে কি না সেটা দেখলে হবে না, কী পরিমাণ আছে সেটাও দেখতে হবে। শরীরে একটা নির্দিষ্ট পরিমাণ অ্যান্টিবডি তৈরি না হলে পস্নাজমা দিয়েও কোনো ফল পাওয়া যাবে না। বাংলা ট্রিবিউন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে