বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১
সাফল্যগাথা

শারমিনার ভাগ্যের চাকা ঘুরিয়েছে ছাগল

আলতাব হোসেন
  ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২০, ০০:০০
ছাগলের পরিচর্যা করছেন শারমিনা -যাযাদি

মাছ বিক্রেতা বাবার সংসারে খেয়ে-না খেয়ে অনেক কষ্টে বেড়ে ওঠেন শারমিনা বেগম। স্কুলে যাওয়ার সৌভাগ্য হয়নি তার। ১২ বছর বয়সেই বিয়ে হয়। স্বামী হারুন মিয়া দিনমজুরের কাজ করেন। একদিন কাজ করলে দুদিন বসে থাকে তিনি। স্বামীর সংসারেও সুখ জোটেনি শারমিনার। দুই ছেলে ও এক মেয়ে নিয়ে অভাবের সংসার তার। 'নুন আনতে পান্তা ফুরায়' অবস্থা। অভাবের সংসার অশান্তিতে ভরপুর। রোজ স্বামীর নির্যাতন ছিল শারমিনার নিয়তি। একদিন ত্যাক্তবিরক্ত হয়ে রাগের মাথায় শারমিনা বেগম বাপের বাড়ি চট্টগ্রামের ফটিকছড়ির মধ্যখিরাম গ্রামে চলে আসেন। সঙ্গে নিয়ে আসেন তিন ছেলেমেয়ে আর সন্তানের মতোই যত্ন করে বড় করা একটি ছাগল। বাবার বাড়িতে ফিরে আসার পর চারদিকে অন্ধকার দেখছিলেন শারমিনা বেগম। বাবা অসুস্থ, সংসারে আয়-রোজগার নেই। অন্য ভাইবোনরাও আর্থিক দৈন্যদশায় পতিত। তারা বাবা-মার খোঁজ নিতে পারে না। সেখানে তার খোঁজ নেওয়া তো অনেক দূরের কথা। একটু সুখ-শান্তির আশায় বাপের বাড়িতে এসে শারমিনার অভাব যেন আরও বেড়ে যায়। অভাব থাকবেই, তাই বলে হাত গুটিয়ে বসে থাকেননি শারমিনা বেগম। অভাবের সংসারে সামান্য আয়ও যেন তার কাছে সোনার হরিণের মতো দামি। শারমিনা বেগম মাটি কাটার কাজ থেকে শুরু করে গৃহকর্মীর কাজও করেছেন। এর মধ্যে সঙ্গে আনা ছাগলটি একদিন চারটি বাচ্চা দেয়। শীতের এক সকালে একটু বড় হওয়া ছাগলের কুচকুচে কালো রঙের বাচ্চাগুলোর তিড়িং বিড়িং নাচ দেখে মলিন মুখে হাসি ফুটে শারমিনার। এরপর মনে মনে সাত-পাঁচ ভেবে ছাগলের পেছনে সময় দিতে শুরু করেন শারমিনা। প্রতিবেশীদের কাছে শুনে স্থানীয় একটি এনজিও থেকে মাচা পদ্ধতিতে ছাগল পালন বিষয়ে প্রশিক্ষণ নেন। প্রশিক্ষণের মাধ্যমে মনের জোর বাড়ে তার। ছাগলের জন্য মাচাঘর তৈরি করেন টিন দিয়ে। আর নিজেরা থাকেন পলিথিনের ডেরায়। কাকডাকা ভোরে ঘুম ভাঙতেই ছুটেন ছাগল দেখাশোনায়। খাবারের যোগান দেওয়া ও গোসল করানো সবই করতে হয় একা। এরপর ছাগলের দুটি বাচ্চা থেকে চারটি, চার থেকে ছয়...। একটু একটু করে পাল্টে যেতে থাকে শারমিনার অভাবের গল্প। গত সপ্তাহে ব্যাপারীরা তার কাছ থেকে দুটি ছাগল ১৩ হাজার টাকায় কিনে নিয়েছেন বলে জানান। হাটে যেতে হয় না, বাড়িতেই নিয়মিতই কেনাবেচা চলে ছাগল। তার এখন ২৩টি ছাগল, দুটি গরু ও শতাধিক হাঁস-মুরগি আছে। পাহাড়ি এলাকায় উন্মুক্ত পরিবেশে ছেড়ে দিয়ে তিনি ছাগল লালন-পালন করেন। উন্নতমানের নেপিয়ার ঘাস ও খাবার কিনেন। প্রায় ষাট হাজার টাকার ঋণ পরিশোধ করেছেন। শারমীনার স্বামী ও বৃদ্ধ মা এখন তার সঙ্গে টুকটাক কাজে হাত লাগান। স্বামী হারুন মিয়া এখন তার পরামর্শে চলেন। শারমিনা বেগম এখন সচ্ছল। তার দুই ছেলে এখন স্কুলে পড়াশোনা করছে। মেয়েটি স্থানীয় মাদ্রাসায় পড়ছে। ১৮ বছরের আগে মেয়ের বিয়ে দিবেন না শারমিনা বেগম। বাপের বাড়ির পাশেই চার শতাংশ জমি কিনেছেন। ছোট মাটির ঘর ভেঙে বড় পরিসরে ইটের বাড়ি তৈরি করেছেন শারমিনা বেগম। নিয়েছেন বিদু্যৎ সংযোগ। ঘরে আছে সিলিং ফ্যান। অভাবের সংসারে জৌলুস ফিরেছে শারমিনার। শারমিনা বেগমের মতো সাহসী ও উদ্যমী নারীরা ধীরে ধীরে পাল্টে দিচ্ছেন বাংলাদেশের গ্রাম ও শহরের সনাতন অভাবী মুখের ছবিগুলো। এক সময় শ্বশুরবাড়ির লোকজন মুখ ফিরিয়ে নিলেও এখন তারা শারমিনার কাছে আসেন সাহায্যের জন্য। সহায়-সম্বলহীন শারমিনা বেগমের মতো সাহসী, উদ্যমী ও পরিশ্রমী নারীরা ধীরে ধীরে পাল্টে দিচ্ছেন বাংলাদেশ। বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে উন্নত বিশ্বের কাতারে। শারমিনা বেগম এক উদ্যমী নারীর নাম। শত ঘাত-প্রতিঘাতও দমিয়ে রাখতে পারেনি জীবন সংগ্রামে সফল এ নারীকে। নারী উদ্যোক্তা শারমিনা বেগমের স্বপ্ন, ছাগলের পাশাপাশি ভেড়া ও মহিষের খামার গড়ে তোলা। শারমিনা বেগম মুক্তিপথ উন্নয়ন কেন্দ্রের কর্মীদের ধান্যবাদ জানিয়েছে বলেন, তারা নিয়মিত তদারকি করে। সব ধরনের সহায়তা করে। নিয়মিত ছাগলের ডাক্তার নিয়ে আসে। আপদে-বিপদে তারা পাশে থাকে। এখন তার আর অভাব-অনটন নেই। হাতে টাকা-পয়সাও থাকে ভালো। তাই বেশ সুখে-সাচ্ছন্দ্যে দিন কাটছে তার। কারও ওপর নিভর্রশীল না হয়ে বরং এখন তিনি স্বাবলম্বী, জানালেন শারমিনা বেগম।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে