বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১
করোনার প্রভাব

'সেশনজট' দোলাচলে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীরা

যাযাদি ডেস্ক
  ২০ সেপ্টেম্বর ২০২০, ০০:০০

দেশের বিভিন্ন সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা নির্বিঘ্ন শিক্ষা কার্যক্রম ও সেশনজট নিয়ে আশা-নিরাশার দোলাচলে দুলছে। মহামারির প্রথম দুই মাস দেশের সব অফিস, আদালত, দোকানপাট, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ও গণপরিবহণ বন্ধ থাকার পর ধীরে ধীরে সবই খুলে গেছে। তবে এখনো বিশ্ববিদ্যালয়সহ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার বিষয়ে কোনো সুস্পষ্ট ঘোষণা আসেনি। দেশের সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ভাইরাস সংকটের তিন মাস পর অনলাইনে ক্লাস শুরু করলেও তাতে সব শিক্ষার্থীর অংশগ্রহণ নিশ্চিত হয়নি। এভাবে ক্লাস চললেও পরীক্ষার বিষয়ে এখনো কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। দেশে করোনাভাইরাস সংক্রমণের শুরুর দিকে মার্চে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে সেমিস্টার পরীক্ষা শুরু হয়ে এক বা দুটি পরীক্ষার পর সেগুলো বন্ধ হয়ে গেছে। অনেক শিক্ষার্থীর এরইমধ্যে পরীক্ষা দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ চুকানোর কথা থাকলেও তারা পড়ে আছেন অনিশ্চয়তার মধ্যে। মহামারি কতদিন প্রলম্বিত হবে, আবার কবে উচ্চ শিক্ষাঙ্গনগুলো স্বাভাবিক শিক্ষা কার্যক্রমে ফিরে আসবে সে বিষয়ে কিছু বলতে পারছেন না দায়িত্বশীলরাও। এই পরিস্থিতিতে ছয় মাস থেকে এক বছর পিছিয়ে পড়ার আশঙ্কা করছেন শিক্ষার্থীরা। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ শিক্ষার্থীদের ক্ষতি পোষাতে নানা পরিকল্পনার ছক কষলেও প্রবীণ অধ্যাপকদের কেউ কেউ শিক্ষার্থীদের জীবন থেকে একটা বড় সময় চলে যাওয়া ছাড়া বিকল্প দেখছেন না। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিকতা ও গণমাধ্যম অধ্যয়ন বিভাগের স্নাতকের শিক্ষার্থী সাজিদুজ্জামান জানান, করোনাভাইরাসের কারণে নয়টি কোর্সের মধ্যে মাত্র একটির পরীক্ষা দিয়েই বসে আছেন তারা। বাকি পরীক্ষাগুলো কবে হবে, তার ঠিক নেই। তিনি বলেন, 'সাধারণত মার্চে আমাদের বার্ষিক পরীক্ষা শুরু হয়। গত মার্চের ১৬ তারিখে একটি পরীক্ষা দেওয়ার পর মহামারি শুরু হয়ে গেলে বাকি কোর্সগুলোর পরীক্ষা আর দিতে পারিনি। শুধু আমাদের বিভাগই নয়, অনেক বিভাগই পরীক্ষা শেষ করতে পারেনি।' এ বছর ডিসেম্বরে স্নাতকোত্তরের দ্বিতীয় সেমিস্টার পরীক্ষা দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ চুকানোর কথা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের শিক্ষার্থী মুহসীন আহমেদের। কিন্তু করোনাভাইরাসের কারণে এখনো জুন মাসের প্রথম সেমিস্টার পরীক্ষাও দিতে পারেননি তিনি। মুহসীন বলেন, 'অনলাইনে ক্লাস নিয়ে সিলেবাস শেষ করা হচ্ছে। কিন্তু ক্লাসের সবাই তো আর এখানে জয়েন করতে পারছে না। দুটি সেমিস্টার চার মাস করে শেষ করলেও আট মাস সময় লেগে যাবে। বিশ্ববিদ্যালয় যদি বিকল্প উপায়ে পরীক্ষা না নেয় তাহলে সেজনজট ছাড়া উপায় নাই। সে ক্ষেত্রে আমাদের একটা বছর পিছিয়ে যাবে।' চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের যোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী তাসনুবা তাহসিন বলেন, 'বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ থাকার কারণে অলরেডি সেশনজটে পড়ে গেছি। নভেম্বর মাসে অনার্স ফাইনাল ইয়ার পরীক্ষা হওয়ার কথা ছিল। ছয় মাস তো বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ ছিল। কোর্সগুলো করা হয়নি। এখন অনলাইনে ক্লাস হচ্ছে, ক্লাসের গতিও ভালো। ক্যাম্পাস খুললে পরীক্ষা শুরু হবে। কিন্তু খোলার সঙ্গে সঙ্গেই পরীক্ষা নেওয়ার পক্ষে আমরা নই। পরীক্ষা না হলে আবার সেশনজটে পড়ে থাকব। সব কিছু মিলিয়ে একটা অনিশ্চয়তার মধ্যে দিন যাচ্ছে।' এদিকে করোনাভাইরাস সংক্রমণ রোধে গত ২৩ মার্চ সরকার সারাদেশে সাধারণ ছুটি ঘোষণা করে। এর আগেই দেশের সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যায়। সেশনজট রোধে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো অনলাইনে শিক্ষা কার্যক্রম চালালেও নানা সীমাবদ্ধতার কারণে প্রায় তিন মাস পর থেকে সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো অনলাইনে ক্লাস শুরু করে। কিন্তু ক্যাম্পাস ও আবাসিক হল বন্ধ থাকায় শিক্ষার্থীদের অনেকে প্রত্যন্ত অঞ্চলে থেকে ইন্টারনেটের ধীরগতি, ইন্টারনেট ডেটা প্যাকের সমস্যা, ডিজিটাল ডিভাইসের অভাবসহ নানা কারণে অনলাইন ক্লাসে অংশ নিতে পারছেন না। কর্তৃপক্ষ যা ভাবছে প্রায় ছয় মাস ধরে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বন্ধের ফলে উচ্চশিক্ষায় যে ক্ষতি হয়েছে বা মহামারি প্রলম্বিত হলে কী করণীয়, তা নিয়ে ভাবছেন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিরা। তারা বলছেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে সেশনজট অনিবার্য হয়ে পড়েছে। তবে বিভিন্ন উপায় ও কৌশল অবলম্বন করে ক্ষতি পুষিয়ে নেওয়ার সুযোগও রয়েছে। এ ক্ষেত্রে সেমিস্টার বা বার্ষিক শিক্ষাপঞ্জির সময় ও সাপ্তাহিক ছুটি কমিয়ে এবং অতিরিক্ত ক্লাস নিয়ে ক্ষতি পুষিয়ে নেওয়া যেতে পারে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপউপাচার্য (শিক্ষা) অধ্যাপক এএসএম মাকসুদ কামাল বলেন, 'আশা করি শিক্ষার্থীরা বড় ধরনের সেশনজটে পড়বে না। যারা অনার্স ডিগ্রি বা মাস্টার্স ডিগ্রির টার্মিনালে আছে, তারা হয়তো কিছু দিনের জন্য সেশনজটে পড়তে পারে। তবে যারা ফার্স্ট ইয়ার বা সেকেন্ড ইয়ারে আছে তাদের সেশনজটে পড়ার কোনো আশঙ্কা নেই। ইয়ারলি সিস্টেমে যাদের পরীক্ষা হয়, আমরা হয়তো ১২ মাসের মধ্যে ৮-৯ মাস ক্লাস নিয়ে পরীক্ষা নিতে পারব, যাতে তাদের শিক্ষাজীবনে কোনো ছেদ না পড়ে। সেমিস্টার পদ্ধতিতে যাদের পরীক্ষা, ষষ্ঠ থেকে অষ্টম সেমিস্টার পর্যন্ত তাদের কিছুটা অসুবিধা হতে পারে। তবে তাদের এই সেশনজট নিরসনেও নানা পরামর্শ রয়েছে।' সব শিক্ষার্থী যাতে অনলাইন ক্লাসে যোগ দিতে পারে সেই ব্যবস্থা করতে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে জানিয়ে অধ্যাপক মাকসুদ কামাল বলেন, 'যেসব শিক্ষার্থীর ডিভাইস নাই বা ডেটা প্যাক কিনতে সমস্যা, তাদের আমরা আর্থিক সাপোর্ট দেওয়ার জন্য বিভিন্ন বিভাগে চাহিদাপত্র পাঠিয়েছি। শিগগিরই অনলাইন শিক্ষা কার্যক্রমের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের অবকাঠামো উন্নয়নসহ শিক্ষার্থীদের অসুবিধা দূর হবে। প্যানডেমিক প্রলম্বিত হলে বিকল্প উপায়েও শিক্ষার্থীদের মূল্যায়নের চিন্তা আছে। তবে আগে শিক্ষার্থীদের সুযোগ-সুবিধা দিয়ে অনলাইনে অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে।' এদিকে করোনাভাইরাসের এই সময়টা জীবন থেকে হারিয়ে গেছে বলে মেনে নিয়ে সেভাবে পরিস্থিতি মোকাবিলার পরামর্শ দিয়েছেন প্রবীণ অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী। তিনি বলেন, ১৯৭১ সালেও আমরা এ রকম পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়েছিলাম। তখন স্কুল-কলেজে অটোপ্রমোশন দিলেও বিশ্ববিদ্যালয়ে কিন্তু সেটা সম্ভব হয়নি। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের আগে পরে যেসব পরীক্ষা হয়েছিল, ১৯৭২ সালে সেগুলোর ফল বাতিল করে আবার নতুন করে পরীক্ষা নেওয়া হয়েছিল। স্বাধীনতার পর প্রিলিতে (স্নাতকোত্তরে) অটোপ্রমোশন দিতে শিক্ষার্থীরা আন্দোলন করেছিল। কিন্তু সেটা দেওয়া হয়নি, পরীক্ষা নেওয়া হয়েছিল। কোভিড-১৯ মহামারি পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে কীভাবে সেশনজট নিরসন করা যায়, সে প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমার মনে হয় এ বছরটা বাদই দিতে হবে। এছাড়া আমি কোনো উপায় দেখছি না। এটা মেনে নিতে হবে। এটা শুধু আমাদেরই ক্ষতি হয়েছে, এমনটা তো না। বিশ্বজুড়ে এ মহামারি, সব দেশেই ক্ষতি হচ্ছে। এতবড় একটা দুর্যোগ ক্ষতি ছাড়া কাটিয়ে ওঠা সম্ভব নয়। আমাদের মনে করতে হবে, এই সময়টা আমাদের থেকে হারিয়ে গেছে। অন্যদিকে কোভিড-১৯ মহামারির কারণে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকলেও আধুনিক তথ্য-প্রযুক্তির সদ্ব্যবহার করে সমস্যার উত্তরণ সম্ভব বলে মনে করছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক এ কে আজাদ চৌধুরীও। তিনি বলেন, সমস্যা থেকে উত্তরণের পথ আছে। আমাদের দেশে প্রাইভেট ইউনিভার্সিটিগুলো অনলাইনে একাডেমিক সকল কাজ করছে। পাবলিক ইউনিভার্সিটির স্টুডেন্টেদের সীমাবদ্ধতা আছে, এটা ঠিক। কিন্তু সেই সংখ্যাটা বেশি না। সরকার বা বিশ্ববিদ্যালয় চাইলে এসব শিক্ষার্থীদের সুযোগ-সুবিধা দিয়ে অনলাইনে নিয়ে আসতে পারে। অনলাইন সিস্টেমে পরীক্ষাও নিতে পারে।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে