বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

শরিফা ফলে দোল খাচ্ছে বাহাউদ্দীনের স্বপ্ন

মজনুর রহমান আকাশ, গাংনী (মেহেরপুর)
  ৩০ সেপ্টেম্বর ২০২০, ০০:০০
আপডেট  : ৩০ সেপ্টেম্বর ২০২০, ০০:০৬
মেহেরপুরের বাহাউদ্দীনের (ইনসেটে) বাগানের শরিফা বিক্রয়ের জন্য সংরক্ষণ করা হচ্ছে -যাযাদি

ব্যতিক্রমী কিছু করার চিন্তা থেকেই বিলুপ্তপ্রায় শরিফা ফল চাষে বেশ সফলতা পেয়েছেন মেহেরপুরের গাংনী উপজেলার চেংগাড়া গ্রামের ব্যাংকার বাহাউদ্দীন। তার বাগানে থোকায় থোকায় শোভা পাচ্ছে শরিফা ফল। বাতাসে দোল খাচ্ছে শরিফা, সেই সঙ্গে দোল খাচ্ছে বাগানমালিকের স্বপ্ন। সুস্বাদু ও বেহেস্তি ফল হিসেবে পরিচিত শরিফা চাষে বেশ লাভবান হয়েছেন তিনি। ৮ বিঘা জমিতে বাগান করে প্রতি বছর কয়েক লাখ টাকা আয় করছেন তিনি। তার এই সফলতা এলাকার তরুণ-যুবকদের শরিফা বাগান করার অনুপ্রেরণা জোগাচ্ছে। মেহেরপুরের গাংনী উপজেলার বিশিষ্ট ব্যাংকার বাহাউদ্দীন। শখের বশে আর ব্যতিক্রমী কিছু করার চিন্তা নিয়েই বছর চারেক আগে মাত্র দুই বিঘা জমিতে শরিফা ফলের বাগান করেন। স্থানীয়ভাবে বীজ সংগ্রহ করে তা রোপণ করেন তিনি। প্রথম বছরে খরচ হয় মাত্র ২০ হাজার টাকা। পরের বছর আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি। সে বছর শরিফা ফল স্থানীয় ফল বিক্রেতাদের কাছে বিক্রি করে পান ৪০ হাজার টাকা। স্বল্প পুঁজি বিনিয়োগ করে বেশি লাভ হওয়ায় আরও ৬ বিঘা জমিতে শরিফা বাগান করেন। এ বছর তিনি ৫০ হাজার টাকা খরচ করে পেয়েছেন তিন লাখ টাকা। বাগান মালিক বাহাউদ্দীন জানান, আগে প্রায় প্রতিটি বাড়িতেই পাওয়া যেত সুস্বাদু ফল শরিফা। এখন কালের বিবর্তনে হারিয়ে যেতে বসেছে সেই ফল। বিলুপ্তপ্রায় এ ফলের গাছ ধরে রাখা ও বাণিজ্যিকভাবে এ বাগান করার প্রয়াস নিয়েই তিনি বাগান করেছেন। স্বল্প খরচ আর অল্প পরিশ্রমে বেশি লাভবান হওয়ায় স্থানীয় চাষি ও তরুণরা শরিফা বাগানের প্রতি আগ্রহী হয়ে উঠেছে। স্থানীয়রা পরামর্শ নিচ্ছেন বাগান করার জন্য। গাংনীর ভিটাপাড়ার কলেজ শিক্ষক রফিকুল আলম জানান, তিনি এ শরিফা চাষে সফলতার গল্প শুনেই পরামর্শ নিচ্ছেন বাগান করার। ইতোমধ্যে দুই বিঘা জমি প্রস্তুত করেছেন। বীজ সংগ্রহ করছেন তিনি। রফিকুল আলমের মতো অনেকেই বাহাউদ্দীন ও কৃষি অফিসে পরামর্শ নিচ্ছেন শরিফা বাগান করার জন্য। স্থানীয় ফল ব্যবসায়ী আ. রহমান জানান, মেওয়া বা শরিফা ফল সুস্বাদু ও পুষ্টিকর হওয়ায় এর চাহিদা রয়েছে। নিজের হাতে বাগান থেকে ফল সংগ্রহ করে স্থানীয় বাজার ও ঢাকাতে পাঠানো হয়। অনলাইনেও এর বেচাকেনা হয়। বাগান থেকে ২৫০ টাকা দরে কিনে সাড়ে চারশ টাকা দরে বিক্রি করা হয়। গাংনী উপজেলা কৃষি অফিসার কে এম সাহাবুদ্দীন আহমেদ জানান, শরিফা একটি বিলুপ্তপ্রায় সুস্বাদু ও পুষ্টিগুণে ভরপুর ফল। এ ফল আবাদে খরচ কম। রোগবালাই একেবারই নেই। অথচ লাভ অনেক বেশি। কৃষি অফিস সব সময় চাষিদের পরামর্শ দিচ্ছেন। এ ফল আবাদের সম্প্রসারণ ঘটলে পুষ্টির চাহিদা অনেকখানি পূর্ণ হবে। শরিফা (মেওয়া) ফলের ৩২ বিঘার বিশাল বাগান করে সফল হয়েছেন পাবনার কৃষক শাহজাহান আলী বাদশা। বাণিজ্যিকভাবে শরিফা চাষ করে লাভবান হওয়ার সফলতায় সবাইকে অবাক করে দিয়েছেন। বিলুপ্তপ্রায় এই শরিফার বাগানে অসময়েও প্রতিটি গাছে প্রচুর পরিমাণ ফল ধরেছে। ৭ বছর আগে রোপণকৃত গাছ ২ বছর ধরে ফল আহরণ শুরু হয়েছে। বাদশার বাগানের শরিফা ফল রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন অভিজাত ফলের দোকানে ৫০০ থেকে ৬০০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে। বাগান পরিচর্যা ও ফল আহরণে প্রতিদিন ২৫ জন শ্রমিক কাজ করছেন। গত বছর ৬৫ লাখ টাকার ফল বিক্রি হয়েছে। এবার বিক্রির পরিমাণ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে বলে বাগান মালিক আশা করছেন। সরেজমিনে ঈশ্বরদীর ছলিমপুর ইউনিয়নের বক্তারপুর গ্রামের মা-মণি কৃষি খামার পরিদর্শনে দেখা যায়, ৩২ বিঘা জমির বিশাল এই বাগানের প্রতিটি গাছেই প্রচুর পরিমাণ ফল ধরেছে। খামারের শ্রমিকরা গাছ থেকে ফল পেড়ে বিক্রির জন্য প্রস্তুত করছেন। বাগান মালিক বাদশা জানান, ব্যতিক্রমী কিছু করার চিন্তা থেকেই বিলুপ্তপ্রায় শরিফা ফল চাষের প্রতি আমার আগ্রহ সৃষ্টি হয়। ২০০৪ সালে ঢাকা থেকে থাইল্যান্ড জাতের কিছু শরিফা ফল কিনে বীজ থেকে চারা উৎপাদন করে ২০০৬ সালে ৩২ বিঘা জমিতে রোপণ করে বাগান গড়ে তুলি। দীর্ঘ ৮ বছর পরিচর্যা করার পর গত দুই বছর ধরে বাগানের ফল বাণিজ্যিক ভিত্তিতে উৎপাদন শুরু হয়েছে। বিশাল ওই জমিতে অন্য ফসল উৎপাদন করলে কম সময়ে ব্যাপকভাবে অর্থিক লাভবান হওয়া যেত। কিন্তু সবুরে যে মেওয়া ফলে, কথাটি প্রমাণের আশায় বুক বেঁধে ছিলাম। এখন তা সত্যি প্রমাণ হয়েছে। ঢাকার অভিজাত ফলের দোকানে ৫০০ থেকে ৬০০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে। বছরে একটি গাছে দুবার ফল ধরে। এ ব্যাপারে ঈশ্বরদী উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা কৃষিবিদ ড. হাসানুল কবীর কামাল বলেন, কৃষক শাহজাহান আলী বাদশা শরিফা ফলের বাণিজ্যিক চাষে যে বিস্ময় সৃষ্টি করেছেন তা সত্যিই দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে। বাংলাদেশের কোথাও এত বড় শরিফা ফলের বাগান আছে বলে আমার জানা নেই। এই ফলের মধ্যে ঔষধি গুণ রয়েছে, শরিফা ফল শরীরে শক্তি জোগায়, রক্তশূন্যতা দূর করে। কৃষি বিভাগ তার যেকোনো সহযোগিতায় প্রস্তুত আছে। তিনি বেকার যুবকদের ঘরে বসে না থেকে কৃষিকাজে মনোযোগী হওয়ার আহ্বান জানান। জীবননগর উপজেলার প্রত্যন্ত অঞ্চলে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে শরিফা (মেওয়া ফল) চাষ হচ্ছে। চুয়াডাঙ্গা জেলার জীবননগর উপজেলার রায়পুর গ্রামে শরিফা থাই বারোমাসি ফল চাষ করে জাদুকরী সাফল্য পেয়েছেন তরুণ এই উদ্যোক্তা। ২০১৫ সালে লাগানো বাগানে এখন থোকায় থোকায় ঝুলছে সুন্দর, সবুজ ও সোনালি রঙের সুমিষ্ট শরিফা ফল। বাণিজ্যিকভাবে লাভজনক হওয়ায় শরিফা ফল চাষে আগ্রহী হয়েছে অনেকে। জীবননগর উপজেলার মাটি সব ফসলের জন্য উপযোগী হলেও এই প্রথম একজন শিক্ষিত উদ্যমী শরিফা ফলচাষি রায়পুর গ্রামের রুহুল কুদ্দুসের ছেলে সাদ্দাম হোসেন শরিফা ফল চাষ করে সফল হয়েছেন। জানা গেছে, ২০১৫ সালের জানুয়ারি মাসে চুয়াডাঙ্গা জেলার জীবননগর উপজেলার রায়পুর গ্রামে সাড়ে ৩ বিঘা জমিতে পরীক্ষামূলকভাবে শরিফা ফল বারোমাসি জাতের ৪শটি চারা রোপণ করেন কৃষক সাদ্দাম হোসেন। চারা লাগানোর পর নিবিড় পরিচর্যা ও জৈব প্রযুক্তি (কেঁচো সার) ব্যবহার করে মাত্র এক বছর বয়সে সামান্য পরিমাণ ফলন এলেও এবার প্রতিটি গাছে ৩৫ থেকে ৪০ কেজি ফল ধরছে। রায়পুর বাজারের পাশে সাদ্দামের স্বপ্নের শরিফা ফলের বাগানে গিয়ে দেখা যায়, ছোট ছোট শরিফা ফল গাছে ঝুলছে থোকায় থোকায় ফল। তিনি জানান, প্রথম দিকে একটু খরচ হলেও পরবর্তী বছরে গাছে ফল ধরা শুরু হয়। প্রতিটি গাছে ৩৫ থেকে ৪০ কেজি করে ফল ধরেছে। প্রতি বিঘা জমিতে বছরে খরচ হয় ১৫ থেকে ১৮ হাজার টাকা। প্রতি কেজি ফল বিক্রয় করা হয় সাড়ে ৩শ থেকে ৪শ টাকা কেজি দরে। এ ফলনে দারুণ খুশি চাষি সাদ্দাম হোসেন। তার বাগানে উৎপাদিত শরিফা ফল বিদেশ হতে আমদানিকৃত যেকোনো ফলের চেয়ে রসালো, সুস্বাদু এবং বেশি মিষ্টি। তার সাফল্য দেখে অনেকে শরিফা ফল চাষ করছেন এবং তার বাগানে আসছেন মানসম্মত চারা সংগ্রহের জন্য। চলতি বছরে প্রায় ১৬ বিঘা জমিতে লাগানো চারা সরবরাহ করছেন বলে তিনি জানান।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে