পুঁজি সংকটে টাঙ্গাইলের তাঁতশিল্প

লক্ষাধিক শ্রমিক বেকার হ পেশা পরিবর্তনের ঝোঁক হ নেই ঋণ সহযোগিতা

প্রকাশ | ২৪ অক্টোবর ২০২০, ০০:০০

মু. জোবায়েদ মলিস্নক বুলবুল, টাঙ্গাইল
তাঁতশিল্পের একটি কারখানা -ফাইল ছবি
করোনাভাইরাস ও বন্যার ধকল কাটিয়ে ঘুরে দাঁড়াতে পারছে না টাঙ্গাইলের ঐতিহ্যবাহী তাঁতশিল্প। দুর্যোগকালীন সরকারি প্রণোদনা না পাওয়ায় লক্ষাধিক তাঁত শ্রমিক ও চার হাজারেরও বেশি তাঁত মালিক বেকার হয়ে পড়েছে। বাংলাদেশ তাঁত বোর্ড (বাতাঁবো) ঋণ সহযোগিতা না করায় দেখা দিয়েছে পুঁজি সংকট। এতে করে ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক তাঁত মালিকরা শাড়ি উৎপাদনে যেতে পারছেন না। অনেকেই বাধ্য হয়ে ঝুঁকে পড়ছেন ভিন্ন পেশায়। জানা গেছে, জেলায় তাঁত শিল্প ও তাঁতিদের উন্নয়নের জন্য বাংলাদেশ তাঁত বোর্ডের (বাতাঁবো) দুটি বেসিক সেন্টার রয়েছে। এর মধ্যে কালিহাতী, ভূঞাপুর, ঘাটাইল, গোপালপুর, মধুপুর ও ধনবাড়ী উপজেলার জন্য কালিহাতীর বলস্নায় একটি এবং টাঙ্গাইল সদর, দেলদুয়ার, নাগরপুর, বাসাইল, সখীপুর ও মির্জাপুর উপজেলার জন্য টাঙ্গাইল শহরের বাজিতপুরে একটি বেসিক সেন্টার। টাঙ্গাইলের ঐতিহ্যবাহী তাঁত শাড়ির পরিচিতি বিশ্বজুড়ে। একসময় বাংলাদেশের খ্যাতি ও গৌরব ছিল মসলিন এবং জামদানির জন্য। এর মধ্যে জামদানি টিকে থাকলেও মসলিন ইতিহাসের পাতায় বন্দি। তবে মসলিন ও জামদানির পর দেশীয় বস্ত্র খাতে টাঙ্গাইল শাড়ি নতুন মাত্রা যোগ করতে সক্ষম হয়। টাঙ্গাইল শাড়ির নকশা, বুনন ও রঙের ক্ষেত্রে ব্যাপক বৈচিত্র্য রয়েছে। সাধ্যের মধ্যে দাম আর বাহারি কারুকাজ খচিত হওয়ায় টাঙ্গাইল শাড়ি সব সময় নারীদের পছন্দের শীর্ষে। ফলে টাঙ্গাইল শাড়ি দেশের সীমানা পেরিয়ে দক্ষিণ এশিয়ার বিভিন্ন দেশ এমনকি ইউরোপ, আমেরিকা এবং জাপানেও জনপ্রিয়তা লাভ করেছে। সংশ্লিষ্টদের মতে, তাঁতশিল্প একটি সম্ভাবনাময় শিল্প। স্থানীয় অর্থনীতিতে ব্যাপক অবদান রাখা এ শিল্পের মূল সমস্যা পুঁজি বা মূলধন ও বাজারজাতকরণ পদ্ধতি। এছাড়া পৃথক তাঁতশিল্প এলাকা ও তাঁতিদের প্রশিক্ষণ কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা জরুরি। তাঁত বোর্ডের কালিহাতী বেসিক সেন্টারে ১৭টি প্রাথমিক তাঁতি সমিতির এক হাজার ৮৮৪ জন ক্ষুদ্র তাঁত মালিকের ২১ হাজার ৯৭৩টি তাঁত রয়েছে। টাঙ্গাইল সদর (বাজিতপুর) বেসিক সেন্টারে ৩২টি প্রাথমিক তাঁতি সমিতির দুই হাজার ২৬৭ জন ক্ষুদ্র তাঁত মালিকের ১২ হাজার ৪২৯টি তাঁত রয়েছে। এসব তাঁতের চার হাজার ১৫১ জন ক্ষুদ্র তাঁত মালিকের অধীনে এক লাখ তিন হাজার ২০৬জন তাঁত শ্রমিক জীবিকা নির্বাহ করে থাকেন। এর মধ্যে ৩৪ হাজার ৪০২ জন নারী এবং ৬৮ হাজার ৮০৪ জন পুরুষ রয়েছেন। বাতাঁবো নিয়ন্ত্রিত জেলার দুটি বেসিক সেন্টার সূত্র এ তথ্য নিশ্চিত করলেও টাঙ্গাইল সেন্ট্রাল কো-অপারেটিভ আর্টিজেন্স ওয়েল ফেয়ার অ্যাসোসিয়েশন লিমিটেডের কর্মকর্তারা জানান, জেলায় তাঁতের সংখ্যা দেড় লক্ষাধিক। বাতাঁবোর বেসিক সেন্টার শুধু তাদের সমিতির সদস্য ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক তাঁতি ও তাঁত সংখ্যার পরিসংখ্যান দিয়ে থাকে তাদের সমিতির বাইরেও তাঁত ও তাঁতি রয়েছে। কালিহাতী উপজেলার বলস্না, রামপুর, মমিননগর, কোকডহড়া, দত্তগ্রাম, বেহেলাবাড়ী, ভরবাড়ী, টেঙ্গুরিয়া, ঘোনাবাড়ী, ছাতিহাটি, দড়িখশিলস্নলস্না, তেজপুর, কাজীবাড়ী, দত্তগ্রাম, সহদেবপুর; দেলদুয়ার উপজেলার চন্ডি, পাথরাইল, পুটিয়াজানী, রূপসী; টাঙ্গাইল সদর উপজেলার কাকুয়া, চরকাকুয়া, চরপৌলী, হুগড়া ইত্যাদি এলাকায় তাঁতিদের সংখ্যা বেশি। বাতাঁবোর স্থানীয় বেসিক সেন্টারের কর্মকর্তা, তাঁত মালিক, তাঁত শ্রমিক ও সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, একটি তাঁতে ন্যূনতম তিনজন নারী-পুরুষ প্রত্যক্ষভাবে শ্রম দিয়ে থাকেন। একজন তাঁতে কাপড় বুনে, একজন চড়কায় কাপড় বুননের সুতা (নলি বা ছিটা) কাটেন, একজন কাপড়ের নকশার সুতা কটেন (ড্রপ কাটা)। এছাড়া সুতা রঙ করা, শুকানো, পাটিকরা, তানার সুতা কাটা, ড্রাম থেকে ভিমে সুতা পেঁচানো, তানা সাজানো, মালা বা নকশার ডিজাইন তোলা, কাপড় ভাঁজ করা, পেটি করা এবং বাজারজাত ও আনা-নেওয়ার জন্যও শ্রমিকের প্রয়োজন হয়। অধিকাংশ ক্ষুদ্র তাঁত মালিক নিজেরা প্রয়োজন অনুযায়ী শ্রম দিয়ে থাকেন। কেউ কেউ পরিবারের সদস্যদের নিয়ে শ্রম দেন। তাঁত শিল্পের শ্রমিকদের প্রতি সপ্তাহের একটি নির্দিষ্ট দিনে মজুরি দেওয়া হয়। তাদের সঙ্গে কথা বলে আরও জানা গেছে, টাঙ্গাইলের তাঁত শিল্পে শ্রম দেওয়া তাঁতিদের মধ্যে প্রায় ৫০ শতাংশ সিরাজগঞ্জ, পাবনা, কুড়িগ্রাম ইত্যাদি জেলার বাসিন্দা। করোনার কারণে চলতি বছরের ২৬ মার্চ থেকে সরকারি ঘোষণায় জেলার সকল তাঁত ফ্যাক্টরি বন্ধ করে দেওয়া হয়। বাধ্য হয়ে এক লাখ তিন হাজার ২০৬ তাঁত শ্রমিক এবং চার হাজার ১৫১ জন ক্ষুদ্র তাঁত মালিক বেকার হয়ে পড়েন। এরই মাঝে দীর্ঘস্থায়ী বন্যা তাঁতশিল্পকে ভাসিয়ে দিয়ে গেছে। সেই বেকারত্ব এখনো বিদ্যমান। করোনার ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে সরকার প্রণোদনার ঘোষণা দিলেও তাঁতিরা তা পাননি। কোনো কোনো তাঁত মালিক চড়াসুদে টাকা নিয়ে সীমিত আকারে তাঁত ফ্যাক্টরি চালু করার চেষ্টা করলেও ঘুরে দাঁড়াতে পারছেন না। একদিকে মহাজনের চড়া সুদ, অন্যদিকে উৎপাদিত শাড়ি বিক্রি করতে না পারায় তারা মারাত্মক ক্রান্তিকাল পাড় করছেন। তার মধ্যে 'মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা' হিসেবে গত সেপ্টেম্বর থেকে বেসিক সেন্টারের ক্ষুদ্র ঋণের কিস্তি পরিশোধ করতে চাপ দেওয়া হচ্ছে। টাঙ্গাইলের ঐতিহ্যবাহী তাঁত শিল্প স্থানীয় অর্থনীতিতে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখলেও এখানে পৃথক কোন তাঁতপলস্নী বা তাঁতশিল্প এলাকা নেই। তাঁতিরা যার যার বাড়ি বা বাড়ির আশপাশে ছোট ছোট ফ্যাক্টরি করে শাড়ি উৎপাদন করছে। টাঙ্গাইল শাড়ির বাজারজাতকরণে তাঁতিদের বড় সমস্যা। জেলা শহরের বাজিতপুর, করটিয়া ও বঙ্গবন্ধু সেতুর পূর্বপাড়ে কালিহাতী উপজেলার জোকারচরে কাপড়ের হাট রয়েছে। এসব হাট করোনাকালে বন্ধ হওয়ার পর এখনো পর্যন্ত পুরোপুরি খোলা হয়নি। তাঁতশিল্পে উৎপাদন শুরু না হওয়ায় করোনা মহামারি শুরুর আগে উৎপাদিত শাড়ি নিয়ে বর্তমানে স্বল্প পরিসরে ওইসব হাট চলছে। সংশ্লিষ্ট দপ্তরে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বাতাঁবোর তাঁতিদের আর্থ-সামাজিক অবস্থার উন্নয়নে 'চলতি মূলধন সরবরাহ ও তাঁতের আধুনিকায়ন' শীর্ষক প্রকল্পের অধীনে কালিহাতী বেসিক সেন্টারের আওতায় মাত্র ২৫ জন তাঁতির মাঝে ৬১ লাখ ৫০ হাজার টাকা ঋণ হিসেবে দেওয়া হয়েছে। ইতোমধ্যে ওই ঋণের দুই লাখ ১৯ হাজার টাকা তাঁতিরা পরিশোধ করেছে। এছাড়া 'ক্ষুদ্রঋণ' প্রকল্পের আওতায় এক হাজার ৬৯৫ জন তাঁতির মাঝে তিন কোটি ৮৯ লাখ তিন হাজার টাকা ঋণ দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে এক হাজার ৬৬ জন তাঁতি তিন কোটি ১৩ লাখ ৯০ হাজার টাকা ক্ষুদ্রঋণ পরিশোধ করেছে। টাঙ্গাইল সদর বেসিক সেন্টারের আওতায় 'চলতি মূলধন সরবরাহ ও তাঁতের আধুনিকায়ন' প্রকল্পে ১২৩ জন তাঁতির মাঝে এক কোটি ৬৭ লাখ ৫০ হাজার টাকা ঋণ বিতরণ করা হয়েছে। এর মধ্যে চার লাখ ৭ হাজার টাকা আদায় হয়েছে। ক্ষুদ্রঋণ প্রকল্পে দুই হাজার ১২৮ জন তাঁতির মাঝে চার কোটি ৭৯ লাখ ৫৯ হাজার টাকা ঋণ বিতরণ করা হয়েছে। এর মধ্যে চার কোটি ৭ হাজার টাকা আদায় হয়েছে। করোনায় নিষেধাজ্ঞা ও বন্যার পর 'চলতি মূলধন সরবরাহ ও তাঁতের আধুনিকায়ন' প্রকল্পটি চালু রেখে 'ক্ষুদ্রঋণ' প্রকল্পটি বর্তমানে বন্ধ রাখা হয়েছে। 'চলতি মূলধন সরবরাহ ও তাঁতের আধুনিকায়ন' প্রকল্পের অর্থ ব্যাংকে জমা থাকলেও সমিতিভিত্তিক ক্ষুদ্রঋণ আদায়ে প্রত্যাশিত হার ৬০% পুরানো না হওয়ায় তাঁতিদের মাঝে ঋণ বিতরণ এক প্রকার আটকে আছে। ফলে তাঁতিরা মহাজনের কাছ থেকে চড়া সুদে টাকা নিয়ে ব্যবসা চালু করার চেষ্টা করলেও ঘুরে দাঁড়ানো সম্ভব হচ্ছে না। কালিহাতীর নাগবাড়ী ইউনিয়নের ভরবাড়ি গ্রামের মরহুম আমজাদ হোসেনের ছেলে মো. সাখাওয়াত হোসেন করোনা শুরু হওয়ার আগে ৩৫টি তাঁতের মালিক ছিলেন। তিনি জানান, করোনাকালে জমাকৃত শাড়ি কমদামে বিক্রি করে শ্রমিকদের খরচ মিটিয়েছেন। পরে তাঁত বিক্রি করে মহাজনের ঋণ পরিশোধ করেছেন। তাঁত বোর্ডের ঋণ সুবিধা না পাওয়ায় তিনি বাপ-দাদার পেশা ছেড়ে বর্তমানে বলস্না বাজারে কাঁচামালের (শাকসবজি) ব্যবসা করছেন। একই এলাকার মৃত আব্দুল হাইয়ের ছেলে তাঁত শ্রমিক আব্দুল গফুর জানান, করোনাকালে তাঁত ফ্যাক্টরী বন্ধ হয়ে যাওয়ায় তারা কর্মহীন হয়ে পড়েন। তাঁত মালিক কিছুদিন ধারদেনা দিয়েছেন এখন তারই অবস্থা শোচনীয়। বাধ্য হয়ে শাড়ি বুনন ছেড়ে তিনিও কাঁচামালের (শাকসবজি) ব্যবসা করে সংসার চালাচ্ছেন। একই অবস্থা বলস্না গ্রামের মৃত আব্দুর রশীদের ছেলে আলমগীর হোসেনের। তিনি ১৬টি তাঁতের মালিক ছিলেন এখন বেকার। কালিহাতী উপজেলার বলস্না ১নং প্রাথমিক তাঁতী সমিতির সাধারণ সম্পাদক মো. দুলাল হোসেন জানান, ফ্যাক্টরি বন্ধ রাখায় তাঁতি প্রতি তাঁতে সপ্তাহে চার হাজার টাকা ক্ষতি হয়েছে। বর্তমানে পুঁজির অভাবে তাঁত মালিকরা ফ্যাক্টরি চালু করতে পারছেন না। টাঙ্গাইল শাড়ির রাজধানী পাথরাইল শাড়ি ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি রঘুনাথ বসাক জানান, তাঁত শিল্পে কোনো প্রণোদনা দেওয়া হয়নি। সংকট কাটাতে চলতি মূলধন সরবরাহ করলে ক্ষুদ্র ও মাঝারি ফ্যাক্টরি মালিকরা ঘুরে দাঁড়ানোর সুযোগ পাবে। বাতাঁবোর কালিহাতী বেসিক সেন্টারের ভারপ্রাপ্ত লিয়াজোঁ অফিসার ইমরানুল হক জানান, করোনা ও বন্যার প্রভাবে তাঁত শিল্পে ধস নেমেছে। তাঁতিরা ঘুরে দাঁড়াতে পারছেনা। ফ্যাক্টরির মালকরা কর্মহীন হয়ে পড়েছে। তবে যেসব সমিতিতে দেয় ক্ষুদ্রঋণের টাকা ৬০ শতাংশ আদায় হয়নি সেসব সমিতিতে ঋণ দেওয়ার কোনো সুযোগ নেই। যারা ঋণ পরিশোধ করেছেন তাদের ঋণ দেওয়ার বিষয়টি বিবেচনার জন্য তিনি বাতাঁবো কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছেন।