শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

বিশ্বভ্রমণের রেকর্ড ছুঁয়েছেন বাংলার ফ্ল্যাগ গার্ল নাজমুন

আলতাব হোসেন
  ২৪ অক্টোবর ২০২০, ০০:০০
বাংলাদেশের পতাকা হাতে নাজমুন নাহার -যাযাদি

মৃতু্যভয়কে জয় করে বন্ধুরপথ পাড়ি দিয়েছেন শত শত মাইল একা একা। ইতিমধ্যে বিশ্বভ্রমণের রেকর্ড ছুঁয়েছেন নাজমুন নাহার। লাল-সবুজের পতাকা হাতে নিয়ে ফেব্রম্নয়ারিতে ব্রম্ননাইয়ে তিনি বিশ্বের ১৪০টি দেশ ভ্রমণ শেষ করেছেন। বিশ্বজয়ের স্বপ্নপূরণ হতে চলেছে তার। বিশ্বের ১৫০ দেশ ভ্রমণের মাইলফলক ছুঁতে যাচ্ছেন বাংলার ফ্ল্যাগ গার্ল নাজমুন।

আগামীর অভিযাত্রার পথ নকশা (রোড ম্যাপ) চূড়ান্ত করেছেন নাজমুন। এবার তার যাত্রা শুরু হবে মধ্য আফ্রিকার দেশ ক্যামেরুন, গ্যাবন, গিনি, বুরুন্দি, কঙ্গো, সুদান, নামিবিয়া, অ্যাঙ্গোলা, জিবুতি, ইরিত্রিয়া পর্যন্ত। এই ভ্রমণের মধ্য দিয়ে শেষ হবে পুরো আফ্রিকা সফর। এর মধ্য দিয়ে বাঙালি এ নারী পৃথিবীর ১৫০ দেশে পৌঁছবেন লাল-সবুজের পতাকা হাতে। যা হবে নাজমুনের এক অবিস্মরণীয় মাইলফলক। এখানেই থেমে যাবেন না নাজমুন। লাল-সবুজের পতাকাবাহী পরিব্রাজক

\হপা রাখবেন পৃথিবীর প্রতিটি দেশে।

বিশ্বভ্রমণের প্রথম যাত্রায় ভারতের পাচামরিতে ইন্টারন্যাশনাল অ্যাডভেঞ্চার প্রোগ্রাম-এ অংশগ্রহণের মাধ্যমে তিনি তার জীবনের প্রথম বিদেশ ভ্রমণ করেন। সেই থেকে বাংলাদেশের পতাকা হাতে তার বিশ্বযাত্রার শুরু। ধারাবাহিকতায় ২০১৯ সালে সুইডেন থেকে আটলান্টিক মহাসাগরের দ্বীপ গ্র্যান্ড ক্যানবেরিয়া হয়ে সেনেগাল, গাম্বিয়া, মালি, গিনি বিসাউ, গিনি কোনাক্রি, সিয়েরালিওন, লাইবেরিয়া, আইভরিকোস্ট, বুরকিনা ফাসো, ঘানা, টগো, বেনিন, নাইজার ও নাইজেরিয়া ভ্রমণের পর যাত্রা করেন পশ্চিম আফ্রিকার দেশ মৌরিতানিয়ার রাজধানী নোয়াকচট থেকে। আর শেষ করেন নাইজেরিয়ার লাগোস শহরে। এর মাধ্যমে তার শেষ হয় পশ্চিম আফ্রিকার সাহারা মরুভূমি ও গোল্ড কোস্ট লাইনের প্রতিটি দেশ ভ্রমণ। নাজমুন তার মাকে নিয়ে আল্পস পর্বতমালা থেকে শুরু করে ইউরোপ ও আমেরিকার ১৪টি দেশ ভ্রমণ করেন। ইতিহাসে তার শততম দেশভ্রমণের সাক্ষী হয়ে আছে ভিক্টোরিয়া জলপ্রপাত। পৃথিবীর ইতিহাসে নাজমুনের মতো এমন নারী বিরল, যিনি এক দেশ থেকে আরেক দেশে হাজার হাজার মাইল বাইরোডে একা একা ভ্রমণ করছেন দেশের পতাকা হাতে। দিন-রাতের অন্ধকারকে একাকার করে পর্বতে, সমুদ্রের তলদেশে, দুর্গম জঙ্গলে, বন্যপ্রাণীর পাহাড়ে, অজানা আদিবাসীদের এলাকা- কোথাও যেতে ভয় পাননি নাজমুন। বুকে তার লাল-সবুজের দীপ্ত শিহরণ, দু'চোখে তার বিশ্ব। অন্তত পাঁচবার মৃতু্যর মুখ থেকে ফিরে এসেছেন নাজমুন নাহার।

লাল-সবুজের পতাকাকন্যা তিনি। গাম্বিয়া সরকার সম্মাননা হিসেবে তাকে দিয়েছে ফ্ল্যাগ গার্ল উপাধি। তিনি বহু সম্মাননা উপাধিতে ভূষিত হয়েছেন। কখনো তিনি হয়েছেন পিচ টর্চ বিয়ারার, কখনো আর্থ কুইন কখনো ডটার অব দ্য আর্থ, কখনো বা গেম চেঞ্জার অব বাংলাদেশ। দেশে পেয়েছেন অনন্যা শীর্ষ দশ অ্যাওয়ার্ড। বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্নপত্রে এবং বিসিএস পরীক্ষার প্রশ্নপত্রে তার নাম স্থান পেয়েছে।

অনেক দ্বীপে রাতের অন্ধকারে তিনি হারিয়ে গেছেন, আফ্রিকার গিনি কোনাক্রিতে ২৬ ঘণ্টা জঙ্গলে আটকা পড়েন রাতের অন্ধকারে। জর্জিয়ার সনেটি প্রদেশ যাওয়ার সময় পথে গুলির মুখোমুখি হয়েছেন। সাহারা মরুভূমিতে ভয়ঙ্কর মরুঝড়ের মুখোমুখি হয়েছেন, গুয়াতেমালায় ছিনতাইকারীর গুলি আর চুরির মুখোমুখি হয়েও ফিরে এসেছেন কৌশলে, শুধু কি তাই তিনি কিরগিস্তানের আলা আরচা পর্বত সামিটে ওঠার সময় পা পিছলে পড়ে ছোট্ট একটা বুনো গাছের সাথে ঝুলে ছিলেন- উঁচু পর্বত থেকে ঝুলে যাওয়া শরীরের নিচে ছিল গহিন ফাঁকা।

নাজমুনকে ইথিওপিয়ার জঙ্গলে হামার আদিবাসীদের সঙ্গে গরুর কাঁচা মাংস খেয়ে বেঁচে থাকতে হয়েছে। আফ্রিকাতে তিন মাস আলু খেয়ে ছিলেন। সর্বোচ্চ আড়াই দিন না খেয়ে থাকার রেকর্ড আছে তার। পথে গাছ থেকে গাছের লতাপাতা খেয়ে থেকেছেন দুইদিন। তিনি উঠেছেন পেরুর রেইনবো সামিটের মতো পৃথিবীর বহু পর্বত সামিটে- যেখানে প্রচন্ড আল্টিচুডের কারণে মৃতু্যমুখে পড়েন। চিলির আতাকামা যেখানে ১০০ বছরে বৃষ্টি হয়নি এমন আশ্চর্যজনক জায়গাতেও পা পড়েছে তার।

দুরূহ ভ্রমণের পথকে সহজসাধ্য করেছেন নাজমুন। বলা চলে, হার না মেনেই এগিয়ে গিয়েছেন স্বপ্ন পূরণের পথে বাংলার সাহসী এই নারী। যায়যায়দিনের সঙ্গে আলাপচারিতায় নাজমুন নাহার বলেন, বাংলাদেশের লাল-সবুজের এই পতাকা আমার সবচেয়ে বড় শক্তি। এই পতাকা আমাকে ছায়া দিয়েছে। তিনি বলেন, পশ্চিম আফ্রিকা ভ্রমণ না করলে আমার দেখা হতো না মানুষের বেঁচে থাকার কঠিন বাস্তবতা। অনেক দুর্গম জায়গায় দেখেছি শিশুর শরীর ধুলোমাখা, পরনে কাপড় নেই, খাবারের অভাব, কিশোরীর শরীরে এক টুকরো কাপড়- ওই দৃশ্য আমাকে কাঁদিয়েছে। মনে পড়ে সেই উগান্ডা থেকে রুয়ান্ডার বর্ডার হেঁটে অতিক্রম করার স্মৃতি। আবার কেনিয়ার নাইরোবি শহরে ভোররাতের গাড়ি দুর্ঘটনার হাত থেকে বেঁচে যাওয়ার স্মৃতি।

নাজমুন সাহার বলেন, আমরা সবাই এক পৃথিবীর মানুষ, সবাই একই সূত্রে গাঁথা। একই শিকড় থেকে আমাদের জন্ম। একটাই সূর্যের আলো পাই, একই আকাশের নিচে বসবাস করি। বিশ্বভ্রমণের উদ্দীপনার পাশাপাশি দেশাত্মবোধ ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় দেশের প্রতিটি তরুণকে জাগিয়ে তুলতে চাই আমি।

বাংলাদেশের নারী এ পরিব্রাজকের জন্ম ১৯৭৯ সালের ১২ ডিসেম্বর লক্ষ্ণীপুর সদর উপজেলার এক পরিবারে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জনের পর কিছুদিন সাংবাদিকতা করেন। ২০০৬ সালে শিক্ষাবৃত্তি নিয়ে উচ্চতর পড়াশোনার জন্য যান সুইডেনে। সুইডেনের লুন্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে এশিয়ান স্টাডিজ বিষয়ে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন তিনি। এরপর দক্ষিণ কোরিয়ার সিউল ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটিতে 'হিউমান রাইটস অ্যান্ড এশিয়া' বিষয়ে স্কলারশিপ পেয়ে আরেকটি ডিগ্রি অর্জন করেন। সুইডেনের একটি প্রতিষ্ঠানে গবেষক হিসেবে তিনি কাজ করেছেন। ছুটির দিনগুলোতে তিনি বেরিয়ে পড়েন দেশভ্রমণে। এভাবেই দেশ থেকে দেশে ঘুরে বেড়াচ্ছেন বাংলার সাহসী নারী নাজমুন নাহার।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<116352 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1