গাড়ি পার্কিং নীতিমালা না থাকায় ট্রাফিকের ইচ্ছে মাফিক মামলা

প্রকাশ | ১০ সেপ্টেম্বর ২০১৮, ০০:০০ | আপডেট: ১০ সেপ্টেম্বর ২০১৮, ০৯:২৮

সাখাওয়াত হোসেন
রাজধানীর রাস্তাজুড়ে পাকির্ং করা গাড়ি Ñফাইল ছবি

ব্যস্ততম সড়কের যত্রতত্র অবাধে গাড়ি পার্কিংয়ের কারণে গোটা ঢাকা যানজটের নগরীতে পরিণত হলেও এ সংকট সমাধানে দীঘির্দনেও তৈরি হয়নি কোনো পূণার্ঙ্গ নীতিমালা। এ সুযোগে ট্রাফিক পুলিশের ইচ্ছে মাফিক রুজু হচ্ছে ‘রং পাকির্ং’ মামলা। এতে গাড়ির মালিক-চালকদের হয়রানি যেমন বেড়েছে, তেমনি ট্রাফিক পুলিশের দুনীির্তবাজ কমর্কতাের্দর উপরি আয়ের পথও অনেকটা প্রশস্ত হয়েছে। অথচ অবৈধ পার্কিংয়ের কারণে নগরীর পরিবহন ব্যবস্থা আগের মতোই হ-য-ব-র-ল রয়ে গেছে। নগর পরিকল্পনাবিদরা বলছেন, পাকির্ং নীতিমালা ছাড়া ট্রাফিক পুলিশের পক্ষে কোনোভাবেই নগরীর ব্যস্ততম এলাকার যানজট পরিস্থিতি সামাল দেয়া সম্ভব হবে না। এমনকি জরিমানা আদায় করেও তা নিয়ন্ত্রণ করা দুষ্কর। গাড়ি পার্কিংয়ের সুনিদির্ষ্ট স্থান নিধার্রণ না করে গাড়ির মালিক-চালকদের ঘাড়ে আইনি খড়গ তুলে দিলে এ সমস্যা আরও প্রকট হবে বলে মনে করেন পরিকল্পনাবিদরা। এ ব্যাপারে সহমত পোষণ করে পরিবহন-সংশ্লিষ্টরা বলেন, গাড়ির মালিক-চালকদের অনেকেই খুব সহজে আইন ভাঙতে চান না। বিশেষ করে গাড়ি পাকির্ংয়ের ক্ষেত্রে ব্যক্তিগত যানবাহনের মালিক-চালকরা যথেষ্ট সচেতন। অথচ এ ব্যাপারে সুনিদির্ষ্ট কোনো দিকনিদের্শনা না থাকায় তারা অনেক সময় কোথায় গাড়ি পাকর্ করতে হবে কিংবা কোথায় তা পাকর্ করা যাবে না তা বুঝে উঠতে পারেন না। ফলে প্রায়ই তাদের আইনি ফঁাদে পড়ে মোটা অংকের অথর্দÐ দিতে হয়। যা তাদের ক্রমেই আইনের প্রতি আস্থাহীন করে তোলে। পাশাপাশি ট্রাফিক পুলিশকে ঘুষ দিয়ে মামলার ফঁাদ এড়াতে উদ্বুদ্ধ হন অনেকেই। এদিকে পাকির্ং নীতিমালা না থাকার সুযোগে ট্রাফিক পুলিশের ইচ্ছে মাফিক ‘রং পাকির্ং’ মামলা করার কথা সংশ্লিষ্ট প্রশাসন অস্বীকার করলেও সরেজমিনে অনুসন্ধানে এ অভিযোগের সত্যতা পাওয়া গেছে। বুধবার সকালে বিশ্বরোড-সংলগ্ন মালিবাগ কঁাচাবাজারের সামনের রাস্তায় ট্রাফিক পুলিশকে বেশ কয়েকটি প্রাইভেট কারের বিরুদ্ধে রং পাকির্ংয়ের অভিযোগ এনে এর মালিকদের কাছ থেকে রেকার বিল আদায় করতে দেখা গেছে। অথচ এর মাত্র ৫০ গজ দূরেই সোহাগ পরিবহনের পঁাচটি বিলাসবহুল বাস রাস্তার পাশে ডাবল লাইন করে দীঘর্ সময় দঁাড় করানো থাকলেও তাদের বিরুদ্ধে ট্রাফিক পুলিশ কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। এ ব্যাপারে জানতে চাইলে সংশ্লিষ্ট জোনের টিআই (ট্রাফিক ইন্সপেক্টর) মনিরুজ্জামান কোনো সদুত্তর দিতে পারেননি। এদিকে বেইলি রোডের সুইস বেকারি ও ব্যাম্বো ক্যাসলসহ প্রতিটি ফাস্টফুডের দোকানের সামনে একাধিক গাড়ি ঘণ্টার পর ঘণ্টা দঁাড় করিয়ে রাখা হলেও ট্রাফিক পুলিশ এসব যানবাহনের মালিক-চালকদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছে না। অথচ সেখান থেকে মাত্র একশ’ গজ দূরত্বে মহিলা সমিতির মিলনায়তনের সামনের রাস্তায় সিঙ্গেল লাইনে গাড়ি পাকর্ করা মাত্র ট্রাফিক পুলিশ ছুটে এসে রং পাকির্ং মামলা করছে। তবে একই সড়কে আইনের দুই ধরনের প্রয়োগের ব্যাপারে সেখানে কতর্ব্যরত ট্রাফিক পুলিশ কোনো সদুত্তর দিচ্ছে না। যা গাড়ির মালিক-চালকদের বিভ্রান্ত করছে। ভিকারুননিসা নূন স্কুলে তৃতীয় শ্রেণিতে পড়–য়া সন্তানকে নিতে এসে রং পাকির্ং মামলার শিকার হওয়া অভিভাবক শাহীন আলম বলেন, স্কুল নিধাির্রত সময় ছুটি হলেও বাচ্চাদের ক্লাস থেকে বের হতে অনেক সময় ৫-১০ মিনিট বিলম্ব হয়। এ সময় গাড়ি স্কুলের আশপাশের সড়কের যে কোনো জায়গায় পাকর্ করলেই ট্রাফিক পুলিশ মামলা ঠুকে দেয়। অথচ স্কুলের আশপাশে দুই হাজার গজের মধ্যেও কোথাও নিধাির্রত কার পাকিং নেই। এ অবস্থায় অভিভাবকরা তাদের সন্তানদের কীভাবে গাড়িতে তুলবেন সে প্রশ্ন তোলেন শাহীন আলম। ওই স্কুলের আরও বেশ কজন অভিভাবক একই অভিযোগ তুলে বলেন, পুলিশ তাদের ইচ্ছে মাফিক ‘রং পাকির্ং’ মামলা দিচ্ছে। কখনো বা গাড়ি রেকারিংয়ের ভয় দেখিয়ে দেড়-দুই হাজার টাকা আদায় করছে। অথচ অভিভাবকরা কোথায় গাড়ি পাকর্ করে তাদের সন্তানদের গাড়িতে তুলবেন তা বলছেন না। এটি ট্রাফিক পুলিশের উৎকোচ আদায়ের বিশেষ ফঁাদ বলে ক্ষুব্ধ মন্তব্য করেন ভিকারুননিসা নূন স্কুলের অনেক অভিভাবক। রাজধানীর শহীদ বাকী সড়ক-সংলগ্ন বাড়ির মালিকরা অভিযোগ করে বলেন, এই সড়কের দুই পাশে অবৈধভাবে গড়ে ওঠা শ দেড়েক রেস্তোরঁা ও ফাস্টফুডের দোকানের সামনে দিনভর দুই-তিন লাইনে গাড়ি পাকর্ করা থাকলেও পুলিশ এসব যানবাহনের বিরুদ্ধে কোনো আইনি ব্যবস্থা নিচ্ছে না। অথচ অনেক সময় সাবলেনে গাড়ি পাকর্ করামাত্রই পুলিশ রং পাকির্ং মামলার ভয় দেখিয়ে রেকার বিল আদায় করছে। যা রীতিমতো অনাচার এবং আইনের অপব্যবহার বলে ক্ষোভ প্রকাশ করেন অনেকে। এদিকে দীঘির্দনে গাড়ি পাকির্ংয়ের পূণার্ঙ্গ নীতিমালা না হওয়ার কোনো সদুত্তর দিতে পারেনি সংশ্লিষ্ট প্রশাসনের ঊধ্বর্তন কমর্কতার্রা। তবে ঢাকা পরিবহন সমন্বয় কতৃর্পক্ষের (ডিটিসিএ) দাবি, রাজধানীর বিভিন্ন সড়কে গাড়ি সুষ্ঠুভাবে পাকির্ংয়ে নীতিমালা প্রণয়নের জোরালো উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। শিগগিরই তা চূড়ান্ত করা হচ্ছে। এ কাজে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন ও রাজধানী উন্নয়ন কতৃর্পক্ষ (রাজউক) সহায়তা করবে। পাকির্ং নীতিমালা-২০১৮-এর চূড়ান্ত খসড়ায় বলা হয়েছে, ঢাকা শহরের ট্রাফিক ব্যবস্থাপনার উন্নয়ন, পদ্ধতির আধুনিকায়ন ও যুগোপযোগীকরণ, সমন্বিত বাস্তবায়ন ও পাকির্ং চাজের্র মাধ্যমে সরকারের নন-ট্যাক্স রাজস্ব আদায় বৃদ্ধির লক্ষ্যে এ নীতিমালা প্রণয়ন করা হয়েছে। শিগগিরই তা মতামত গ্রহণের জন্য সংশ্লিষ্ট সব পক্ষের কাছে পাঠানো হবে। নীতিমালায় ১৪টি বিধান যুক্ত করা হয়েছে। এর মধ্যে পাকির্ং ব্যবস্থাপনা উন্নয়নে সহায়ক আইন প্রণয়ন, পাকির্ং ব্যবস্থাপনা পরিচালনা ও রক্ষণাবেক্ষণ এবং এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর উন্নয়ন ও শক্তিশালীকরণের তাগিদ দেয়া হয়েছে। এক্ষেত্রে পাকির্ং চাহিদা নিরূপণ ও তা পূরণে পৃথক চাহিদা এবং জোগান নীতিমালা সংযুক্ত করা হয়েছে। পাকির্ং চাহিদা নীতিমালায় বলা হয়েছে, যেসব আবাসিক এলাকায় পাকির্ংয়ের চাহিদা এর জোগানের চেয়ে কম, সেসব এলাকায় পাকির্ংয়ের জন্য স্থান চিহ্নিত করে অবাধ পাকির্ংয়ের ব্যবস্থা গ্রহণ করা যেতে পারে। এক্ষেত্রে স্থানীয় সড়ক বা শাখা সড়ক ব্যবহার করা যেতে পারে। আর যেসব এলাকায় পাকির্ংয়ের চাহিদার চেয়ে জোগান কম, সেসব স্থানে নিয়ন্ত্রিত পাকির্ং ব্যবস্থা প্রবতর্ন করা দরকার। এজন্য পাকির্ং ব্যবস্থার ওপর প্রাইসিং বা যথাযথ ফি আদায়ের ব্যবস্থা থাকবে, যাতে পাকির্ং নিয়ন্ত্রণ করা যায়। নিয়ন্ত্রিত পাকির্ং স্থানগুলোর ক্ষেত্রে দুই ধরনের মাশুল বা ফি থাকতে পারে। এর মধ্যে যেসব স্থানে পাকির্ং যানবাহন চলাচলে বিঘœ সৃষ্টি করে না, সেসব স্থানে স্বাভাবিক মাশুল আদায় করতে হবে। তবে যেসব স্থানে পাকির্ং যান চলাচলে বিঘœ সৃষ্টি করে, সেখানে আলাদা হারে পাকির্ং মাশুল নিধার্রণ করতে হবে, যা স্বাভাবিক পাকির্ং মাশুলের চেয়ে বেশি হবে। রাজউক ও দুই সিটি করপোরেশন জরিপের মাধ্যমে পাকির্ংয়ে চাহিদা নিরূপণ করবে এবং সে অনুযায়ী অবাধ ও নিয়ন্ত্রিত পাকির্ংয়ের স্থান চিহ্নিত করবে। এক্ষেত্রে সিটি করপোরেশন রাস্তার জরিপ ও রাজউক ভূমি ব্যবহার জরিপের দায়িত্ব পালন করবে। এছাড়া নিদির্ষ্ট বা সব যানবাহনের ক্ষেত্রে দিনের কোনো সময়ে বা নিদির্ষ্ট উদ্দেশ্যে ভ্রমণ বা যানবাহনের ধারণক্ষমতার চেয়ে কম যাত্রী বহন বা স্থানবিশেষে পাকির্ংয়ে বিধিনিষেধ প্রদানের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ করা হবে। পাকির্ং জোগান নীতিমালার ক্ষেত্রে পঁাচ বছর পরপর আদশর্ বা গুণগত মানের পযাের্লাচনা করতে হবে এবং সে অনুযায়ী প্রয়োজনীয় সংশোধন ইমারত বিধিমালায় অন্তভুর্ক্ত করতে হবে। পাশাপাশি রাজউক পাকির্ংয়ের জন্য নতুন নতুন জায়গা অনুসন্ধান করবে। এছাড়া প্রত্যেক ভবনের পাকির্ং সংস্থানগুলোর উপযোগিতা নিয়মিত পযের্বক্ষণ করতে হবে। যেসব ভবনে পাকির্ং সুবিধার ঘাটতি রয়েছে, তাদের ক্ষেত্রে পাকির্ং ফি আরোপের ব্যবস্থা করা যেতে পারে। যেসব অঞ্চলে পাকির্ং সুবিধার ঘাটতি রয়েছে, সেসব স্থানে পাকির্ং পরিষেবা নিমার্ণ ও পরিচালনায় বেসরকারি খাতকে সংযুক্ত করা যেতে পারে। মহানগরের সব গণপরিবহন ইন্টারচেঞ্জ স্থানে পাকর্ অ্যান্ড রাইড সুবিধার প্রবতর্ন করা যেতে পারে। ফিডার সড়ক বা শাখা সড়কে ‘অনস্ট্রিট পাকির্ং’ সুবিধার সংস্থান করা যেতে পারে। পাশাপাশি ট্রাক টামির্নাল ও বাস ডিপো নিমাের্ণর জন্য সুবিধাজনক স্থান চিহ্নিত করতে হবে। এদিকে বড় বড় বাণিজ্যিক এলাকা, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, বিপণিবিতান, হাসপাতাল, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান, কারখানা, প্রশাসনিক এলাকা প্রভৃতির জন্য পাকির্ং লটের সংস্থান রাখতে হবে। এজন্য স্থানীয় নগর নিয়ন্ত্রণকারী কতৃর্পক্ষ উপযুক্ত জায়গা চিহ্নিত করে পাকির্ং লট নিমাের্ণর উদ্যোগ গ্রহণ করবে। আর পাকির্ং লট নিমাের্ণ সমতল, বহুতল ও আন্ডারগ্রাউন্ডÑএ তিন ধরনের ব্যবস্থাই বিবেচনা করতে হবে। আন্ডারগ্রাউন্ড ব্যবস্থার ক্ষেত্রে সুবিধাজনক স্থানে খেলার মাঠ, পাকর্ প্রভৃতির বতর্মান সুবিধা বজায় রেখে পাকির্ং লট হিসেবে পুননির্র্মাণের ব্যবস্থা গ্রহণ করা যেতে পারে। নীতিমালার আওতায় স্থানীয় আইন প্রয়োগকারী সংস্থা পাকির্ংয়ে প্রবিধানমালায় নিদেির্শত বিধিনিষেধ প্রয়োগ করবে। তারাই পাকির্ং ফি আদায় করবে। এক্ষেত্রে অনুমোদিত রোড সাইন ও মাকির্ং দিয়ে পাকির্ংয়ের জন্য নিধাির্রত স্থান বা সম্পূণর্ নিষিদ্ধ এলাকা চিহ্নিত করবে। এছাড়া ধাযর্কৃত ফি ও পাকির্ং বিধান লঙ্ঘনের শাস্তি প্রবিধানমালা দ্বারা নিধাির্রত থাকবে। জানতে চাইলে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ড. শামছুল হক বলেন, রাজধানীতে যানজটের অন্যতম কারণ যত্রতত্র পাকির্ং। তবে এ শহরে গাড়ি পাকির্ংয়ের জন্য নিধাির্রত জায়গা কখনোই রাখা হয়নি। আর নীতিমালা না থাকায় এটি নিয়ন্ত্রণও করা যাচ্ছে না। তিনি আরও বলেন, বিশ্বের বিভিন্ন উন্নত ও মেগা শহরে এ ধরনের নীতিমালা রয়েছে। এতে শহরের ভেতরে পাকির্ংয়ের জন্য গুণিতক হারে চাজর্ আরোপ করা হয়। ঢাকা শহরেও চাজর্ আরোপের ক্ষেত্রে বিষয়টি মাথায় রাখতে হবে। নামমাত্র চাজর্ ধাযর্ করা হলে নীতিমালা নিয়ে পাকির্ং নিয়ন্ত্রণ করা যাবে না।