বাধা পেরিয়ে স্বাবলম্বী রামগঞ্জের ৫ নারী

প্রকাশ | ০১ নভেম্বর ২০২০, ০০:০০

বেলায়েত হোসেন বাচ্চু, রামগঞ্জ (লক্ষ্ণীপুর)
নারীর অগ্রগতির পদে পদে এই সমাজের নানা প্রতিবন্ধকতা। কিন্তু সেসব মোকাবিলা করে শত ঘাত-প্রতিঘাতকে পেছনে ফেলে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করেছেন লক্ষ্ণীপুরের রামগঞ্জ উপজেলার পাঁচজন নারী। নিজের অদম্য ইচ্ছাশক্তিতে বলীয়ান হয়ে কঠোর পরিশ্রম, একাগ্রতা, আত্মবিশ্বাসের কারণে তারা আজ সম্মানের আসনে অধিষ্ঠিত হয়েছেন। কেউ দুর্বল অবস্থান থেকে পরিশ্রম করে নিজের পাশাপাশি সন্তানদেরও করেছেন প্রতিষ্ঠিত আর কেউ নির্যাতনের বিভীষিকা মুছে হয়েছেন স্বাবলম্বী। শাহিনা আক্তার : ভালোবেসে মাসিমপুর গ্রামের মুসলিম ছেলে রফিকুল ইসলামকে ১৯৮৫ সালে বিয়ে করে মঞ্জুমা রানী হয়েছিলেন শাহিনা আক্তার। কিন্তু সেই অপরাধে বাবা-মা, ভাইবোন থেকে বিচ্ছিন্ন হন তিনি। স্বামীর দায়িত্বশীলতার অনুপস্থিতিতে শিকার হন পরিবারের সদস্যদের বিভিন্ন প্রকার নির্যাতনের। কিন্তু সে নির্যাতনে দমে না গিয়ে ১৯৯৫ সালে একটি এনজিওতে চাকরি নিয়ে কর্মময় জীবন শুরু করেন। ১৯৯৮ সালে চন্ডিপুর ইউপির সংরক্ষিত মহিলা সদস্য নির্বাচিত হন। এরপর থেকে টানা চার বার এই দায়িত্ব পালন করেন তিনি। চাকরির বেতন ও ইউপি সদস্য হিসেবে পাওয়া সম্মানী দিয়ে জরাজীর্ণ বসতঘর থেকে নিজেকে সমাজে প্রতিষ্ঠিত করার পাশাপাশি তিনি সন্তানদেরও গড়ে তুলেছেন। তার এক মেয়ে স্নাতকোত্তর, অপর মেয়ে ফাজিল এবং এক ছেলে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করেছে। আছমা খানম : দরিদ্র পরিবারের সন্তান আছমা খানম টিউশনি করেই চালিয়ে যাচ্ছিলেন নিজের পড়াশোনা। অনার্সে অধ্যয়নরত অবস্থায় ২০১০ সালে বদরপুর গ্রামের জাহাঙ্গীর আলমের সঙ্গে তার বিয়ে হয়। কিন্তু বিয়ের পাঁচ বছরেই হারান স্বামীকে। দাম্পত্য জীবনে কোনো সন্তান না হওয়ায় স্বামীর বাড়িতে থাকার জায়গাটুকু হয়নি। ফলে দরিদ্র বাবার বাড়িতে ফিরে আবার শুরু করেন জীবনযুদ্ধ। টিউশনি করেই চালিয়ে যান পড়াশোনা। স্নাতকোত্তর পাস করে মহিলা-বিষয়ক অধিদপ্তরের আইজিএ প্রকল্পের ট্রেইনার পদে চাকরি পান। বর্তমানে তিনি রামগঞ্জ উপজেলা মহিলা-বিষয়ক অধিদপ্তরে কর্মরত আছেন। অদম্য ইচ্ছাশক্তিই তাকে নিজের অবস্থান প্রতিষ্ঠিত করতে সাহায্য করেছে। আমেনা বেগম : উপজেলার আলীপুর গ্রামের গৃহবধূ আমেনা বেগম। তার স্বামী আবদুর রশিদ লোকাল বাসের লাইনম্যান। স্বামীর বেতনের পাঁচ হাজার টাকা দিয়ে সংসার চালাতে হিমশিম খাচ্ছিলেন আমেনা। বৃষ্টি আসলেই পানিতে সয়লাব হয়ে যায় ভাঙা বসতঘর। স্থানীয় একটি আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে কিছু টাকা ঋণ নিয়ে পৈতৃক ৫ শতাংশ এবং স্বামীর ৪ শতাংশ সম্পত্তিতে শুরু করেন হাঁস-মুরগি ও কবুতর পালন। শুরু করেন নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার যুদ্ধ। কঠোর পরিশ্রম করে সন্তানদের পড়াশোনা, সাংসারিক কাজ সামলে হাঁস-মুরগি, কবুতর পালনে মাত্র কয়েক বছরে আমেনা স্বাবলম্বী নারী হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেন। বর্তমানে সুন্দর একটি বসতঘরে হাঁস-মুরগি ও কবুতরের পাশাপাশি তিনি এখন চারটি গাভী, একটি ষাড় ও তিনটি বাছুর এবং ১৭টি ছাগলের মালিক। রায়হান আক্তার : নবম শ্রেণির ছাত্রী থাকাবস্থায় ১৯৭৯ সালে রামগঞ্জ পৌর আঙ্গারপাড়া গ্রামের দেলোয়ার হোসেনের সঙ্গে বিয়ে হয় রায়হান আক্তারের। বিয়ের পর স্বামীর পরিবার নববধূর পড়াশোনা করার পক্ষে না থাকলেও নিজের প্রবল ইচ্ছাশক্তিতে তিনি পড়াশোনা অব্যাহত রাখেন। ১৯৮২ সালে এইচএসসি পাস করার পর প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সহকারী শিক্ষক হিসেবে চাকরি পান। কিন্তু এতে তিনি থেমে থাকেননি। স্বামী সংসার সামলে লক্ষ্ণীপুর সরকারি কলেজ থেকে বিএড ও এমএসএস পাস করার পর ২০০১ সালে প্রধান শিক্ষক হিসেবে পদোন্নতি লাভ করেন। নিজের অদম্য শক্তি তিনি সঞ্চারিত করেছেন সন্তানদের মধ্যেও। তার ছেলেমেয়ে দুইজনেই রসায়ন বিষয়ে স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করে ছেলে বেসরকারি ব্যাংকে এবং মেয়ে সরকারি ব্যাংকে সিনিয়র অফিসার হিসেবে কর্মরত আছেন। পারভিন আক্তার : রামগঞ্জ পৌর কাজিরখিল গ্রামের লুৎফর রহমান চট্টগ্রামে বিমানবাহিনীর সৈনিক হিসেবে কর্মরত থাকায় স্ত্রী পারভিন আক্তারকে কর্মস্থলে নিয়ে যান। স্বামীর বেতনের টাকায় সংসারে নুন আনতে পান্তা ফুরায় দেখে গৃহবধূ পারভিন নিজের এক আত্মীয়র সহযোগিতায় সেলাই কাজ শিখেন। ঘরে থেকেই প্রতিবেশী নারীদের পোশাক সেলাইসহ বিভিন্ন ধরনের কাজ করতে থাকেন। ২০১১ সালে ভারতের গুজরাটে গান্ধী আশ্রম ট্রাস্টের মাধ্যমে ২১ দিনব্যাপী নারীদের দক্ষতা উন্নয়ন প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। নিজে সাতটি প্রশিক্ষণ নিয়ে তিনি প্রশিক্ষণ দিয়েছেন ৩০০ নারীকে এবং প্রতিকূলতা অতিক্রম করে বর্তমানে রামগঞ্জ পৌরসভার সংরক্ষিত কাউন্সিলর হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। মাত্র কয়েক বছরের কঠোর পরিশ্রমে গৃহবধূ পারভিন আক্তার আজ সমাজের প্রতিষ্ঠিত নারী হিসেবে সম্মানিত।