মেরিন ড্রাইভ :পাহাড় আর সমুদ্রের মেলবন্ধন

লং ড্রাইভে এ স্বপ্নিল মেরিন ড্রাইভ অনেকটা নিরাপদ। পাহাড় ও সমুদ্রঘেঁষা এ মেরিন ড্রাইভটিকে আরও বেশি পর্যটকবান্ধব করে গড়তে যাচ্ছে সরকার

প্রকাশ | ২১ নভেম্বর ২০২০, ০০:০০ | আপডেট: ২১ নভেম্বর ২০২০, ১০:৩৯

ম জাবেদ আবেদীন শাহীন, কক্সবাজার
কক্সবাজারের কলাতলী থেকে টেকনাফ সাবরাং অর্থনৈতিক জোন পর্যন্ত ৮০ কিলোমিটার দীর্ঘ মেরিন ড্রাইভ -যাযাদি

একপাশে সবুজ পাহাড়, অন্যপাশে নীল সমুদ্র, মাঝে এঁকে-বেঁকে বয়ে গেছে দীর্ঘ পিচঢালা মসৃণ পথ। কক্সবাজার থেকে টেকনাফ সীমান্ত হয়ে সাবরাং জিরো পয়েন্ট পর্যন্ত বিস্তৃত পাহাড় আর সমুদ্রের মিতালি 'স্বপ্নিল মেরিন ড্রাইভ'। যে পথ দিয়ে চলায় সমুদ্রের ঢেউয়ের গর্জনের হুঙ্কার, মনে অদ্ভুত অনাবিল আনন্দের শিহরণ জাগে। লং ড্রাইভে এ স্বপ্নিল মেরিন ড্রাইভ অনেকটা নিরাপদ। পাহাড় ও সমুদ্রঘেঁষা এ মেরিন ড্রাইভটিকে আরও বেশি পর্যটকবান্ধব করে গড়তে যাচ্ছে সরকার। অভাবনীয় সৌন্দর্যে ভরপুর এই মেরিন ড্রাইভে প্রতিদিন হাজার হাজার পর্যটক আসা-যাওয়া করেন। মেরিন ড্রাইভ দিয়ে যেতে যেতে বিস্তৃত সাগরের সব সৌন্দর্য এবং জেলেদের সাগরে মাছ ধরার দৃশ্য অবলোকন অন্যরকম অভিজ্ঞতা। যেখানে দেখা মিলবে পাহাড়ের গা-বেয়ে ঝরনা হিমেল বারিধারা গড়িয়ে পড়ার দৃশ্য। চলার পথে উঁচু সবুজ পাহাড়গুলোকে দেখে মনে হবে আপনার দিকে তাকিয়ে রয়েছে। সে সঙ্গে টেকনাফ গর্জন ফরেস্ট খ্যাত চিরহরিৎ বন। পাশে রেজু খাল আর সমুদ্রের মিলনস্থলের এক পাশে সারি সারি সুপারি গাছ, অন্যপাশে ঝাউবীথি। সন্ধ্যার রূপটা অন্যরকম। বদলে যায় সাগরের রূপ। সাগর তীরে মেরিন ড্রাইভের নিরাপদ জায়গায় বসে ভরা পূর্ণিমায় রুপালি চাঁদের সৌন্দর্য উপভোগ করার সুবর্ণ সুযোগ রয়েছে ভ্রমণপিপাসুদের। কলাতলী থেকে টেকনাফ সাবরাং অর্থনৈতিক জোন পর্যন্ত দীর্ঘ ৮০ কিলোমিটারের এই সড়কের রোমাঞ্চকর ভ্রমণ প্রকৃতিপ্রেমীদের আকর্ষণ করবে। সড়কের সাগরের পাশে দেখা যাবে সাগরলতা ফুল, নুড়িপাথর, শামুক, ঝিনুক আর সড়কের পাহাড় ভিউতে দেখা যাবে নারিকেল গাছ, সুপারি গাছ, শিমুল গাছ, পলাশ গাছ, কৃষ্ণচূড়া উলদ, বনজ গাছপালা ও বিভিন্ন লতাপাতা। সে সঙ্গে জেলেদের মাছ শিকার, সূর্যাস্ত অবলোকন, লোনা বাতাসের ঝাপটা গায়ে লেগে কখনোবা শিউরে ওঠা। যানজট, কালো ধোঁয়া, ধুলো-মলিন শহর নগরজীবনে ইট-পাথরের যন্ত্রণায় মুক্তির খোঁজে ছুটে চলা দেশ-বিদেশের লাখো ভ্রমণপ্রিয় পর্যটকের জন্য অনাবিল আনন্দ উজাড় করে দেবে কক্সবাজার এই মেরিন ড্রাইভ, যা সমুদ্র আর পাহাড়ের মিতালির মাঝে দাঁড়িয়ে পর্যটকদের এই ভ্রমণ হয়ে উঠে রোমাঞ্চকর। সওজ বিভাগ সূত্রে প্রকাশ, মেরিন ড্রাইভে চলাচল নির্বিঘ্ন করতে আরও ১ দশমিক ৭০ কিলোমিটার দীর্ঘ ফ্লাইওভার নির্মাণ করবে সরকার। এছাড়া কলাতলী থেকে লাবনী পয়েন্ট পর্যন্ত সাইকেলওয়ে-ওয়াকওয়ে মেরিন ড্রাইভের সঙ্গে সংযুক্ত করা হবে। চলতি সময় থেকে ২০২১ সালের জুনেই ৪৬৬ কোটি ২২ লাখ টাকা ব্যয়ে এ কাজগুলো বাস্তবায়ন করবে সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তর (সওজ)। মেরিন ড্রাইভ সড়কের দু'পাশে থাকবে ওয়াকওয়ে, পর্যটকদের সুবিধার্থে থাকবে সড়কজুড়ে ফ্লেক্সিবল পেভম্যান, শেড, গাড়ি পার্কিং ও মহিলা পর্যটকদের চেঞ্জিং রুমসহ অনেক সুবিধা। ৮০ কিলোমিটার সড়কজুড়ে তিনটি বড় আরসিসি সেতু, ৪২টি কালভার্ট, তিন হাজার মিটার সসার ড্রেন, ৫০ হাজার মিটার সিসি বস্নক এবং জিও ট্যাক্সটাইল থাকছে। পর্যটন বিশেষজ্ঞদের অভিমত, কক্সবাজার পৃথিবীর দীর্ঘতম মেরিন মহাসড়কটির পুরো কাজ শেষ হলে আধুনিক পর্যটন, শিল্পায়ন, বিনিয়োগ, সামুদ্রিক সম্পদ ব্যবহারসহ কর্মসংস্থানের নতুন দুয়ার খুলে যাবে। মেরিন মহাসড়ক এনে দেবে সমৃদ্ধ ও উন্নত অনন্য এক বাংলাদেশ। এ প্রকল্পের সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের জন্য সরকার ১২ কোটি ৮২ লাখ টাকা বরাদ্দ দিয়েছে। প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে এটি হবে বিশ্বের সবচেয়ে দীর্ঘতম মেরিন ড্রাইভ বা সমুদ্রঘেঁষা সড়ক। অর্থনীতির মোড় ঘুরিয়ে দিতে এটি ব্যাপক ভূমিকা রাখবে। এই মেরিন ড্রাইভকে ঘিরে শুধু পর্যটন শিল্প থেকেই বছরে আয় করা সম্ভব হবে হাজার কোটি টাকা। এর সঙ্গে যুক্ত হবে কাঁচা পণ্যের ব্যবসা। সমুদ্র থেকে যে পরিমাণ মৎস্যসম্পদ আহরণ করা হয় সেটি দ্রম্নততম সময়ে দেশের যেকোনো প্রান্তে পৌঁছে দেওয়া সম্ভব হবে বলে অভিমত তাদের। কলাতলী থেকে টেকনাফের সাবরাং অর্থনৈতিক জোন পর্যন্ত দীর্ঘ ৮০ কিলোমিটারের মেরিন ড্রাইভ সড়কটি নির্মাণে সময় লেগেছে ২৪ বছর। ১৯৯৩ সালে শুরু হওয়া মেরিন ড্রাইভ সড়ক প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করেছে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর নির্মাণ প্রকৌশল ব্যাটালিয়ন। প্রকল্পে ব্যয় হয়েছে এক হাজার ৪০ কোটি টাকা। এ পুরো সড়ক যেতে লাগবে প্রায় ৫ ঘণ্টা। অটোরিকশা, সিএনজি দিয়ে পুরো রোড ঘুরতে সময় লাগবে আরও বেশি। বিভিন্ন জায়গায় আছে সেনাবাহিনীর চেকপোস্ট। মেরিন ড্রাইভ যাবেন কীভাবে মেরিন ড্রাইভ রোডে ভ্রমণ করতে হলে আপনাকে কক্সবাজার আসতেই হবে। ঢাকা থেকে সড়ক ও আকাশ পথে সরাসরি কক্সবাজার যাওয়া যায়। ঢাকার ফকিরাপুল, কমলাপুর ও সায়েদাবাদ থেকে কক্সবাজার বিভিন্ন পরিবহণ লাইনসহ আরও কিছু পরিবহণের এসি পরিবহণ। তারপর কলাতলী ও সুগন্ধা পয়েন্টে মেরিন ড্রাইভ রোড যাওয়ার খোলা জিপ, মাইক্রোবাস, সিএনজিও টমটম রয়েছে। যে যার মতো গাড়ি ভাড়া করে নিতে পারেন। দিনে গিয়ে দিনে ফিরে আসার জন্য খোলা জিপগাড়ি ভাড়া করা যায়। মেরিন ড্রাইভ সম্পূর্ণ ঘুরে আসতে প্রায় ৪/৫ ঘণ্টা সময় লাগবে। কলাতলী মোড় থেকে জিপে যাওয়া যায় শামলাপুর বিচ। ভাড়া জনপ্রতি ৮০ টাকা। আপনি যদি সিএনজিতে যেতে চান সেক্ষেত্রে ভাড়া জনপ্রতি ১০০ টাকা। আর সবখানে ঘুরতে গাড়ি রিজার্ভও করা যায়। তাছাড়া ঢাকা থেকে কক্সবাজার আকাশপথেও আসা যায়। বাংলাদেশ বিমান, নভোএয়ার, ইউএস বাংলা এবং রিজেন্ট এয়ারওয়েজ ঢাকা থেকে সরাসরি কক্সবাজার ফ্লাইট চলাচলা করে থাকে। বিভিন্ন এয়ারলাইন্সের কিন্তু ভাড়া বিভিন্ন রকম। এছাড়া ঢাকা থেকে ট্রেনে যাওয়া যায় চট্টগ্রাম। সেখান থেকে বাসে যাওয়া যায় কক্সবাজার, ভাড়া ২৫০/৫৫০ টাকা। সবচেয়ে আরামদায়ক ও রোমাঞ্চকর কক্সবাজারের কলাতলী মোড় থেকে মেরিন ড্রাইভ সড়ক পথ দিয়ে সিএনজি, মিনি-কার এবং নীল দরিয়া সার্ভিস দিয়ে যাতায়াত করা যায়।