সাক্ষাৎকার

মাঠ থেকে প্রণোদনার টাকা তুলে আনাই বড় চ্যালেঞ্জ

এমএ হালিম চৌধুরী। দেশের একজন প্রথিতযশা ব্যাংকার। পূবালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানে স্নাতক এই ব্যাংকার ১৯৮৫ সালে সিনিয়র অফিসার হিসেবে ক্যারিয়ার শুরু করেন। ১৯৮৮ সালে পূবালী ব্যাংকে প্রিন্সিপাল অফিসার হিসেবে যোগ দেন। তিন দশকের বেশি সময়ের ক্যারিয়ারে মহাব্যবস্থাপক, উপব্যবস্থাপনা পরিচালক, অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে এ ব্যাংকে দায়িত্ব পালন করেছেন। তার নেতৃত্বে শুধু মুনাফায় উচ্চ প্রবৃদ্ধি নয়, মানবসম্পদ উন্নয়ন, পণ্য বহুমুখীকরণ নানাদিক দিয়ে সেরাদের আসনে উঠে এসেছে পূবালী ব্যাংক। সম্প্রতি যায়যায়দিনকে দেওয়া একান্ত সাক্ষাৎকারে দেশের সার্বিক ব্যাংক খাত ও পূবালী ব্যাংকের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কথা বলেছেন তিনি। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক আহমেদ তোফায়েল

প্রকাশ | ২২ নভেম্বর ২০২০, ০০:০০ | আপডেট: ২২ নভেম্বর ২০২০, ১০:২২

অনলাইন ডেস্ক
পূবালী ব্যাংকের এমডি ও সিইও এমএ হালিম চৌধুরী

যাযাদি : বর্তমান পরিচালনা পর্ষদে কেমন চলছে পূবালী ব্যাংক? হালিম চৌধুরী: আমরা তো বরাবরই পূবালী ব্যাংকের বোর্ড নিয়ে গর্ব করি। কারণ পর্ষদে প্রত্যেক পরিচালকের ভালো সমন্বয় রয়েছে। বোর্ডে জ্যেষ্ঠরা যেমন আছেন, তেমনি সেকেন্ড জেনারেশনের তরুণরাও আছেন। আমাদের বোর্ডে করপোরেট কালচারটা আছে। বিনিয়োগ কোথায় করব, কাকে করব, আর করব না- বোর্ড এ নিয়ে কোনো হস্তক্ষেপ করে না। এটি ম্যানেজমেন্ট লেভেল থেকে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। পর্ষদ কেবল নীতিগত সিদ্ধান্তের বিষয়টি দেখেন। যাযাদি: কারোনাকালে কেমন চলছে পূবালী ব্যাংক? হালিম চৌধুরী:ব্যবসায়ী ও উদ্যোক্তাদের জন্য সরকারের প্রণোদনা দেওয়ার সিদ্ধান্তটি খুবই ভালো হয়েছে। ব্যাংকিং খাত নির্ভর করছে পোশাকের রপ্তানি আর প্রবাসী আয়ের উপরে। পোশাক খাতের প্রধানমন্ত্রীর প্রণোদনা প্যাকেজ অর্থনীতিকে বাঁচিয়ে দিয়েছে। গার্মেন্টের চাকা ঘোরা শুরু হয়ে গেছে। এপ্রিল-মে মাসে দেশে লকডাউন ছিল। করোনার আঘাত ও সুদের হার কমিয়ে দেয়ায় আমরা পেছনে পড়ে গিয়েছিলাম। এখন আমানতের সুদের হার কমছে। ৯ শতাংশ সুদের ঋণ দিতে পারছি। আমাদের নেট ইন্টারেস্ট মার্জিন কমে গিয়েছিল। এটা ঠিক হতে মনে হচ্ছে আরো দুই থেকে তিন মাস সময় লাগবে। যদিও গত বছরের মতো কোনো ব্যাংকই প্রফিট করতে পারবে না। এ মার্জিন ২০ থেকে ৩০ শতাংশ পেছনে থাকবে। আশা করছি, আগামী বছরে এটি ঠিক হয়ে যাবে। যাযাদি: আপনার ব্যাংকের রিটার্ন অন ইকুইটি ও রিটার্ন অন অ্যাসেট কোন অবস্থায় আছে? হালিম চৌধুরী :বিনিয়োগের বিপরীতে আয় এবং সম্পদের বিপরীতে আয় এ দুটোতেই আমাদের ব্যাংক গত বছরের তুলনায় একটু পেছনে আছে। কারণ হচ্ছে- ঋণের সুদের বিপরীতে আয় কমে গেছে। এবং ব্যাংকের ব্যয়ও আমরা এখনো সেভাবে কমাতে পারিনি। এটা আস্তে আস্তে কমছে। আশা করছি জানুয়ারিতে আমরা গত বছরের ফিগারে চলে যাবো। গত বছরের তুলনায় আমাদের আয় ২০ শতাংশ কমেছে। আমরা মনে করি, বর্তমান পরিস্থিতিতে এটাই ঠিক আছে। আমাদের প্রবাসী আয় ভালো আসছে। এটা হয়েছে সরকারের ২ শতাংশ হারে প্রণোদনা দেয়ার কারণে। সবাই অফিসিয়াল চ্যানেলে এখন টাকা পাঠাচ্ছে। যার ফলে এ দুর্যোগের মধ্যেও আমাদের রেমিট্যান্স বাড়ছে। পূবালী ব্যাংকের খেলাপি ঋণ তিন শতাংশের নিচে। তবে এটা নিয়ে আমাদের খুশি হওয়ার কিছু নেই। কারণ ডিসেম্বর পর্যন্ত বাংলাদেশ ব্যাংকের সার্কুলার অনুসারে কোনো ঋণ খেলাপি করা যাবে না। এটির প্রকৃত চিত্র বোঝা যাবে আগামী মার্চ নাগাদ। যাযাদি: বর্তমান পরিস্থিতিতে ঋণ আদায়ের ক্ষেত্রে কোনো সমস্যা হচ্ছে কি? হালিম চৌধুরী :কিছুটা তো সমস্যা হচ্ছে। ছোট ছোট ঋণ গ্রহীতারা কিছু দিচ্ছেন। কিন্তু বড়রা তাদের সামর্থ থাকা সত্ত্বেও দিচ্ছেন না। তারা ভাবছেন, পরে দেবেন। এটি আমার কাছে সমস্যা মনে হচ্ছে। প্রত্যেক ব্যাংকের নিয়ম হলো কিস্তি আদায় না হলে বিশেষ করে টার্ম লোন'র ক্ষেত্রে আমরা ইনকাম নিতে পারি না। ফলে মুনাফায় প্রভাব পড়ছে। তবে যারা নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের ব্যবসা করেন তারা করোনায় বাম্পার ব্যবসা করেছেন। একটি কোম্পানির কথা বলি। গত বছরের তুলনায় তারা এ বছর রপ্তানি ২শ' কোটি টাকা বেশি করেছে। সমস্য হলো অন্য জায়গায়। সরকার খেলাপি বিষয়ে যে সার্কুলার দিয়েছে তাতে তার বিপরীতে প্রভিশন সংরক্ষণ কম লাগছে। এর ফলে ব্যাংকের নেট ইনকাম বেড়ে গেছে। খেলাপি হলে আমাদের কিছু প্রভিশন রাখতে হয়। যেহেতু প্রভিশন রাখতে হচ্ছে না, সে কারণে নেট আয় বেড়ে গেছে। এ ইনকাম বেড়ে যাওয়ায় মালিকরা হয়তো ডিভিডেন্ট বেশি চাইবেন। যদিও আমাদের ডিভিডেন্ট পলিসি কনজারভেটিভ। মিনিমাম যা আছে তাই দিয়ে থাকে। কিন্তু সব ব্যাংক তো আর এক রকম না। খুব সম্ভবত বাংলাদেশ ব্যাংক এ বিষয়ে নীতিগত কোনো পরিবর্তন আনতে পারে। যাযাদি: সার্বিক ব্যাংক খাত এখন কেমন চলছে? হালিম চৌধুরী :প্রণোদনায় ব্যাংকগুলোর অনেক টাকা মাঠে চলে গেছে। এখন মাথা ব্যথার বড় কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে এ টাকা তুলে আনা। কেউ প্রণোদনার টাকার অপব্যবহার করলে বড় বিপদ হয়ে যাবে। যদিও আমরা সঠিক ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে দেয়ার চেষ্টা করছি। এ বিষয়ে আমরা মনিটরিং বাড়িয়েছি। এখন সরকার ছোট ছোট ঋণ দিতে বলছে। একটু ধীরগতিতে হলে ও এসব ঋণ অনেককে দেয়া হচ্ছে। যাযাদি: অর্থনীতি কি ঘুরে দাঁড়াচ্ছে? হালিম চৌধুরী:আমি কয়েকদিন আগে রাজশাহী, দিনাজপুর ও রংপুর এলাকা ঘুরে এলাম। দেখেছি ব্যাপক অর্থনৈতিক কর্মযজ্ঞ চলছে। ব্রিজের কাজ চলছে। উন্নয়নমুখী নির্মাণ কাজ চলছে। মূলধনী যন্ত্রপাতির আমদানি বাড়ছে। নতুন নতুন কারখানার মেশিনারিজ আমদানির এলসি হচ্ছে। তাতে মনে হচ্ছে অর্থনীতির চাকা ঘোরা শুরু হয়ে গেছে। পুরো গতি আসতে হয়তো আরও এক দুই মাস সময় লাগবে। মোদ্দা কথা, বাংলাদেশকে কেউ আটকে রাখতে পারবে না। যাযাদি:বলা হচ্ছে করোনায় এসএমই খাত সবচেয়ে বেশি অবহেলিত। বড়দেরই বেশি সুবিধা দিয়েছে ব্যাংকগুলো। আপনার মূল্যায়ন কি? হালিম চৌধুরী: ঢালাওভাবে এ অভিযোগ সত্যি নয়। ঋণ দিতে গেলে কিছু শ্রেণি বিন্যাস মানতে হয়। নিয়ম-কানুন মেনে ঋণ দিতে হয়। বড়রা ঋণের জন্য প্রস্তুত থাকে। দেখা যায়, একজনকে ঋণ দিলেই ৫ থেকে ১০ কোটি টাকা দেয়া হয়ে গেছে। কিন্তুত্ম ছোটদের বেলায় গুছিয়ে আসতে অনেক সময় লাগে। আসলে প্রথমেই বড়দের ঋণ দেয়া হয়ে গেছে। এখন কিন্তু এসএমই খাতেই দেয়া হচ্ছে। এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক মনিটরিং ব্যবস্থা জোরদার করেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের গর্ভনর নিজে এমডিদের নিয়ে বৈঠক করেছেন। এসএমই হলো বাংলাদেশের অর্থনীতির মূল শক্তি। এ খাতে ঋণ দেয়া হচ্ছে না কথাটা একদম ঠিক না। তবে দেয়ার আগে চিন্তাভাবনা করা হচ্ছে টাকাটা ফেরত আসবে কি না। যাযাদি : ৪০ বিলিয়ন ডলারের রিজার্ভ শক্তিশালী অর্থনীতির চিত্র, নাকি দুর্বলতা? হালিম চৌধুরী:মোটেই না। বাংলাদেশকে যে 'ইর্মাজিং কান্ট্রি' বলা হয় এটি কথার কথা নয়। এটি বাস্তবতা। কারোনাকালীন সারা দুনিয়া যখন পেছনে যাচ্ছিল আমরা কিন্তু পেছনে পড়িনি। আমাদের রেমিট্যান্স বেড়েছে। রপ্তানি আয় বেড়েছে। দেশে নতুন নতুন উদ্যোক্তা তৈরি হচ্ছে। তারা সাহস করে নতুন নতুন প্রকল্প করছে। ইপিজেডগুলো চালু হয়ে গেলে বাংলাদেশের অর্থনীতির চিত্রই বদলে যাবে। ৪০ বিলিয়ন ডলারের রিজার্ভই সাক্ষ্য দিচ্ছে বাংলাদেশ শক্তিশালী অর্থনীতির চিত্রটা কতদূর যাবে। যাযাদি:আগামীতে ব্যাংক খাতে কি সমস্যা দেখছেন? হালিম চৌধুরী:আগামীতে ব্যাংক খাতের বড় মাথা ব্যথা হবে খেলাপি ঋণ সামলানো। ইচ্ছাকৃত খেলাপিদের নিয়ন্ত্রণ করাটা হবে বড় চ্যালেঞ্জ। এ বিষয়ে অনেক আইন আছে। কিন্তু আইনের বাস্তবায়ন হচ্ছে কম। মামলার জট লেগেই আছে। আমি মনে করি, এসব জায়গায় সংস্কার করা খুব জরুরি। যাযাদি : সময় দেয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ। হালিম চৌধুরী:যায়যায়দিনকেও ধন্যবাদ।