শিবগঞ্জে বিলুপ্তির পথে ঐতিহ্যবাহী ঘানিশিল্প

প্রকাশ | ২৪ নভেম্বর ২০২০, ০০:০০

সোহেল আক্তার মিঠু, শিবগঞ্জ (বগুড়া)
গরুচালিত কাঠের ঘানি -যাযাদি
আধুনিক সভ্যতার ক্রমবিকাশে ঘানিশিল্প প্রায় বিলুপ্তির পথে। গ্রামে গঞ্জে আর চোখে পড়ে না গরু দ্বারা চালিত কাঠের ঘানির তেল। আশির দশকে বগুড়ার শিবগঞ্জের বাজারগুলোতে সে সময় পাওয়া যেত দেশি জাতের সরিষা দিয়ে ঘানিতে ভাঙা খাঁটি সরিষার তেল। বগুড়ার শিবগঞ্জে ঘানিশিল্পের ব্যাপক প্রচলন ছিল। এখন উপজেলার কলু সম্প্রদায় প্রায় বিলুপ্তির পথে। ফলে আগের মতো খাঁটি সরিষার তেলের সেই স্বাদ আর পাওয়া যাচ্ছে না। আগে দিনরাত গরু দিয়ে কাঠের ঘানির সাহায্যে ফোঁটায় ফোঁটায় নিংড়ানো খাঁটি সরিষার তেল বিভিন্ন গ্রাম-গঞ্জের হাটেবাজারে মাটির হাঁড়িতে করে বিক্রি করা হতো। এ তেল বিক্রি করেই জীবন-জীবিকা নির্বাহ করতেন এক শ্রেণির কলু সম্প্রদায়। যুগের পরিবর্তনে উপজেলায় দু-এক জন ছাড়া কালের গর্ভে বিলীন হয়ে গেছে এ শিল্পটি। দিন বদলের সঙ্গে সঙ্গে আধুনিকতার ছোঁয়ায় নতুন নতুন প্রযুক্তির মাধ্যমে গড়ে উঠেছে সরিষার তেলের বৈদু্যতিক মোটরচালিত লোহার ঘানির কারখানা। বগুড়ার শিবগঞ্জের পৌর এলাকার কলুমগাড়ি গ্রামে এখনো শিল্পটি বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন মো. আবু জাফর সিদ্দিক। বংশ পরম্পরায় দেড়শ' বছর ধরে তারা এ পেশায় আছেন। উপজেলার ময়দানহাট্টা, মোকামতলা, কিচক, আটমুল, বুড়িগঞ্জ বিহারহাটসহ এলাকার বিভিন্ন এলাকায় এক সময় ঘানিশিল্পের প্রচলন ছিল। এখন আর উপজেলার এসব এলাকায় শিল্পটি চোখে পড়ে না। আবু জাফর তার বংশের তিন পুরুষের এ পেশায় নিয়োজিত আছেন। তার দাদা মৃত মানিক উলস্নাহ ঘানির খাঁটি সরিষার তেল বিক্রি করতেন। দাদার পর বাবা মৃত হোসেন আলীও একই পেশার জীবিকা নির্বাহ করেছেন। বর্তমানে সত্তর বছর বয়সে এসেও মো. আবু জাফর সিদ্দিক কলু সম্প্রদায়ের এখন প্রায় বিলুপ্তির পথে শিল্পটি টিকিয়ে রাখার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। বর্তমানে ২ ছেলে, ৫ মেয়ে ও স্ত্রী রোকেয়া বেগমকে নিয়ে তার সংসার। বাপ-দাদার পেশা ছাড়তে পারেননি তিনি। এখনো আঁকড়ে ধরে আছেন পেশাটিকে। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত ঘানিতে তেল ভাঙার কাজ করছেন আবু জাফর সিদ্দিক। এ পেশার সঙ্গে ছেলেমেয়ে কেউই জড়িত হতে চায় না। তবে স্ত্রী রোকেয়া বেগম ৪৮ বছর ধরে প্রতিনিয়তই স্বামীকে ঘানিতে সারিষা মাড়ায়ে সহযোগিতা করছেন। কলু আবু জাফর সাংসারিক অন্য কাজে ব্যস্ত থাকলে তার অবর্তমানে স্ত্রী ঘানিতে তেল ভাঙার কাজ করে থাকেন। তার ঘানিতে এক মন সরিষা থেকে ১৫ থেকে ১৬ লিটার তেল পাওয়া যায়। তিনি প্রতিদিন ২৭ কেজি সরিষা ঘানিতে ভাঙেন এবং তা থেকে গড়ে প্রায় ৮ থেকে ৯ লিটার তেল বের হয়। কলু আবু জাফরের বাড়িতে গিয়ে দেখা গেছে, ঘানির সঙ্গে একটি গরুর চোখ বেঁধে কাঁধে জোয়াল লাগিয়ে দেওয়া হয়েছে। আর গরুটি দিনভর ঘানির চারপাশে আপন মনে ঘুরতে থাকে। তখন ঘানির নল দিয়ে টিপটিপ করে তেল বের হতে থাকে। ওই তেল মাটির কলসি করে মহাস্থান ও শিবগঞ্জ হাট বারে বিক্রি করতে নিয়ে যায়। বাজারে মেশিনে ভাঙানো সরিষা তেলের চেয়ে তার তেলের চাহিদা অনেক বেশি। তিনি প্রতি লিটার তেল বিক্রি করেন ১৮০ টাকা দরে। কলু জাফরের পরিচিত কিছু ক্রেতা আছেন তারাই প্রতিনিয়ত তার এই খাঁটি তেল কিনে থাকেন। ভেজালযুক্ত সরিষার তেল বাজার দখল করলেও শিবগঞ্জ উপজেলার কলু আবু জাফরের তেলের কদর একটুকুনও কমেনি। ফলে খাঁটি সরিষা তেলের স্বাদ পাচ্ছেন এলাকার সাধারণ মানুষ। শিবগঞ্জের মহাস্থান হাটে তেল কিনতে আসা ক্রেতা তৈয়ুব আলী বলেন, আমি কলু জাফরের কাছ থেকে প্রায় ৪০ বছর ধরে সরিষার তেল কিনছি। খুব ভালো তেল, বাজারে প্রচলিত সরিষার তেলের চেয়ে দাম একটু বেশি হলেও আমি এই তেলই ক্রয় করি। আমার পরিবার এই তেল পছন্দ করে। তবে অনেকের মতে এখনো খাঁটি সরিষার তেল বলতে ঘানির তেলকেই বুঝিয়ে থাকেন। ঘানির তেলের এই ব্যাপক চাহিদার পরও আধুনিক প্রযুক্তির প্রসারের কারণে বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে ঐতিহ্যবাহী ঘানিশিল্প।