কুমিলস্না

বধ্যভূমির মাটি খুঁড়লে এখনো বেরিয়ে আসে কঙ্কাল!

মহান মুক্তিযুদ্ধে কুমিলস্না সদরসহ বিভিন্ন উপজেলার চেনা-অচেনা অনেক বীর মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হয়েছেন। তাদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনা উজ্জীবিত রাখতে জেলার বিভিন্ন এলাকায় নির্মিত হয়েছে ভাস্কর্য ও স্মৃতিফলক। এছাড়া জেলাজুড়ে ছড়িয়ে আছে বধ্যভূমি-এ নিয়ে লিখেছেন আমাদের কুমিলস্নার স্টাফ রিপোর্টার

প্রকাশ | ০১ ডিসেম্বর ২০২০, ০০:০০ | আপডেট: ০১ ডিসেম্বর ২০২০, ১০:২৯

মো. আবদুল জলিল
কুমিলস্নার আলেখারচরে নির্মিত মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি ভাস্কর্য 'যুদ্ধ জয়'

কুমিলস্না সদরসহ জেলার বিভিন্ন উপজেলায় ছড়িয়ে আছে মহান মুক্তিযুদ্ধে শহীদ বীর যোদ্ধাদের ঐতিহাসিক বধ্যভূমি। এসব বধ্যভূমির অধিকাংশই বর্তমানে সংরক্ষণের অভাবে অযত্ন ও অবহেলায় পড়ে আছে। জানা যায়, মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে হত্যাপুরীতে পরিণত হয় জেলার লাকসামের একটি সিগারেট ফ্যাক্টরি। প্রতি রাতে জেলার বিভিন্ন এলাকা থেকে চোখ বেঁধে নিয়ে এসে পাক হানাদার বাহিনী ব্রাশফায়ারে নিরীহ লোকদের হত্যা করে মাটির নিচে পুঁতে রাখে। স্থানীয় বীর মুক্তিযোদ্ধারা জানান, ওইসব স্থানে মাটি খুঁড়লে এখনো বেরিয়ে আসে কঙ্কাল। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর কুমিলস্নার ময়নামতি ক্যান্টনমেন্টসহ বিভিন্ন স্থানে অসংখ্য গণকবর আবিষ্কৃত হয়েছে। এসব বধ্যভূমির মধ্যে রয়েছে চৌদ্দগ্রামের বেতিয়ারা, লাকসামের বেলতলী, সদরের ধনাঞ্জয়, দিশাবন্দ, ঘিলাতলা ও রসুলপুর বধ্যভূমি। এছাড়াও দাউদকান্দি, হোমনা, দেবিদ্বারসহ জেলার বিভিন্ন উপজেলায় আরও অনেক বধ্যভূমি রয়েছে। বীর মুক্তিযোদ্ধাদের অনেকে দাবি করেন, জেলায় আরও গণকবর অনাবিষ্কৃত রয়েছে। জানা যায়, ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় যৌথ গেরিলা বাহিনীর ৭৮ সদস্যের একটি দল ভারতের বিভিন্ন ক্যাম্পে প্রশিক্ষণ শেষে বিপুল পরিমাণ অস্ত্র-শস্ত্র নিয়ে ভারতীয় সীমান্ত অতিক্রম করে বাংলাদেশে প্রবেশের পরিকল্পনা নেয়। দেশে ফিরে যুদ্ধে অংশ নেওয়ার উদ্দেশ্যে ভারতের বাইকোয়া বেইজ ক্যাম্প থেকে একাত্তরের ১০ নভেম্বর রাত ৮টায় চৌদ্দগ্রাম সীমান্তবর্তী ভৈরব নগর সাব ক্যাম্পে (চৌত্তাখোলা ক্যাম্পের শাখা) পৌঁছেন। ভৈরবনগর সাব-ক্যাম্পের দুই মুক্তিযোদ্ধা আবু তাহের বিএসসি ও সামসুল আলম সেই রাতেই তাদের দেশে প্রবেশের নকশা প্রণয়ন করেন। প্রণীত নকশা অনুযায়ী সাব-ক্যাম্পের ৩৮ জন গেরিলা যোদ্ধাকে দুই ভাগে ভাগ করে বেতিয়ারা চৌধুরী বাড়ির দু-পাশে অ্যাম্বুশ পাতা হয়। ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক শত্রম্নমুক্ত কি না, তা পরীক্ষা করার জন্য স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা আবদুল কাদের ও আবদুল মান্নানকে ওই সড়কে পাঠানো হয়। সিগনালের দায়িত্বে থাকা কাদের ও মান্নান মহাসড়ক শত্রম্নমুক্ত বলে রাত ১২টার দিকে জানান। তাদের তথ্যের ভিত্তিতে যৌথ গেরিলা বাহিনীর ৩৮ জন মুক্তিযোদ্ধার দলটি ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক অতিক্রমের জন্য এগিয়ে যায়। এ সময় সড়কের অপরপাশে গাছের আড়ালে অ্যাম্বুশ পেতে লুকিয়ে থাকা পাক হানাদার বাহিনী মুক্তিযোদ্ধাদের ওপর অতর্কিতে ব্রাশ ফায়ার শুরু করলে গেরিলা যোদ্ধাদের ৯ জন ঘটনাস্থলেই শহীদ হন এবং বেশ কয়েকজন আহত হন। শহীদরা হলেন- সিরাজুম মনির, বশিরুল ইসলাম, নিজাম উদ্দিন আজাদ, মো. শহীদ উলস্নাহ, আওলাদ হোসেন, জহিরুল হক দুদু, আবদুল কাইয়ুম, কাদের মিয়া ও সফিউলস্নাহ। হানাদার বাহিনী এ সময় দুইজন মুক্তিযোদ্ধাকে বন্দি করে নিয়ে যায়। পরবর্তীতে তাদের আর কোনো সন্ধান বা লাশ পাওয়া যায়নি। পরে মুক্তিযোদ্ধারা ভারতীয় বিএসএফের সহযোগিতা নিয়েও শহীদদের লাশগুলো উদ্ধার করতে পারেননি। এ ঘটনার এক সপ্তাহ পর স্থানীয় লোকজন ধানক্ষেত থেকে শহীদদের গলিত লাশ উদ্ধার করে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের পাশে একটি গর্তে মাটি চাপা দিয়ে রাখেন। বীর মুক্তিযোদ্ধাদের প্রাণপণ লড়াইয়ে ২৮ নভেম্বর চৌদ্দগ্রামের জগন্নাথদিঘী অঞ্চল শত্রম্নমুক্ত হওয়ার পর স্থানীয় নেতা এবং মুক্তিযোদ্ধারা গর্ত থেকে লাশগুলো তুলে ইসলামি শরিয়ত মোতাবেক মাওলানা আব্দুল আলীর মাধ্যমে জানাজা দিয়ে মহাসড়কের পশ্চিম পাশে দ্বিতীয়বার দাফন করেন এবং শহীদদের গণকবরের উপর স্বাধীন বাংলার লাল-সবুজ পতাকা উত্তোলন করে পাশেই শহীদ স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করেন। পরবর্তীতে ১৯৯১ সালে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক পুনর্নির্মাণকালে ভারতীয় ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ইরকন কোম্পানি স্থানীয় লোকজনের অনুরোধে আধুনিক শৈলীতে গণকবরটি পাকাসহ এর পাশে একটি স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করে। পরবর্তীতে ফোরলেন প্রকল্পের কাজের সময় এ সমাধি সৌধটি মহাসড়কের পূর্বপাশে স্থানান্তর করা হয়। কুমিলস্না জেলা পরিষদের সাবেক প্রশাসক বীর মুক্তিযোদ্ধা আলহাজ ওমর ফারুক বলেন, বঙ্গবন্ধুর ডাকে দেশমাতৃকার স্বাধিকারের জন্য ঝাঁপিয়ে পড়েছিলাম রণাঙ্গনে। তবে পাক-হানাদারদের পরাস্ত করতে মুক্তিযুদ্ধের সেই দুঃসহ স্মৃতি কখনো ভোলার নয়। মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় যুদ্ধাপরাধী, জঙ্গিবাদ ও দুর্নীতিমুক্ত বাংলাদেশ কামনা করি। তিনি আরও বলেন, মুক্তিযুদ্ধের সময় জেলায় জানা-অজানা অনেক গণকবর (বধ্যভূমি) রয়েছে। ঐতিহাসিক প্রয়োজনে আগামী প্রজন্মের জানার জন্য এগুলো সংস্কার ও সংরক্ষণ প্রয়োজন এবং এজন্য স্থানীয় প্রশাসন, মুক্তিযোদ্ধা সংগঠনসহ দেশপ্রেমিক সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে।