মঙ্গলবার, ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

দুর্ভোগের ভেলায় ৫০ বছর পারাপার

বিশ্বের বৃহত্তম গ্রাম হবিগঞ্জের বানিয়াচং। এর অভ্যন্তরের দক্ষিণ-পূর্ব ইউনিয়নে ছোট ২১টি পাড়ায় প্রায় ২০ হাজার লোকের বাস। প্রতিদিন প্রায় দুই কিলোমিটার পথ হেঁটে যেতে হয়। মাঝপথে শুঁটকি নদীতে সেতু না থাকায় বাঁশের তৈরি ভেলা দিয়ে পারাপার হতে হয়
মো. নূরুর হক কবির, হবিগঞ্জ
  ০৩ ডিসেম্বর ২০২০, ০০:০০

দেও টান হেঁইয়া, আরও জোরো হেঁইয়া, শাবাশ জোয়ান হেঁইয়া- এমন করে বাঁশের ভেলায় শুঁটকি নদী পারাপার চলছে পঞ্চাশ বছরেরও বেশি সময় ধরে। যদিও আধুনিক যুগে এই বাহন অনেকের কাছে শখের বস্তু। কিন্তু শুঁটকিপারের জনপদে এটি দুর্ভোগের প্রতীক।

বিশ্বের বৃহত্তম গ্রাম হবিগঞ্জের বানিয়াচং। এর অভ্যন্তরের দক্ষিণ-পূর্ব ইউনিয়নে ছোট ২১টি পাড়ায় প্রায় ২০ হাজার লোকের বাস। যাদের অধিকাংশেরই পেশা কৃষি। প্রতিদিন প্রায় দুই কিলোমিটার পথ হেঁটে যেতে হয় ফসলি জমিতে। মাঝপথে শুঁটকি নদীতে সেতু না থাকায় বাঁশের তৈরি ভেলা দিয়ে পারাপার হতে হয়।

সরেজমিনে দেখা যায়, উপজেলা সদরের বড় বান্দ নামক এলাকায় শুঁটকি নদীতে প্রায় ২৫টি এক সাইজের বাঁশ সমান করে বসিয়ে অনেকগুলো ছিপ দিয়ে বাঁধা হয়েছে। আর ছিপের মধ্যে প্রায় ৫ ইঞ্চি পরপর শক্ত করে বাঁধা। এতে ব্যবহার হয়েছে বাঁশের দড়ি। ভেলার দুই পাশে বাঁধা দীর্ঘ মজবুত পাটের রশি। দুদিকে রশি টেনে ভেলা নিয়ে যাওয়া যায় এপার থেকে ওপারে।

নামটা বিদঘুটে হলেও শুঁটকি নদীর শীর্ণ ধারা দেখতে দারুণ লাগে। শুকনো মৌসুমে এ নদীর পানি যত কমে, এর রূপ আর গুণ ততই বাড়ে। গৃহস্থের হাতের গবাদি পশুই হোক বা জেলেদের হাতে মাছ ধরা; প্রতিদিনের জীবনধারায় এ নদী জড়িয়ে আছে নিবিড় মমতায়।

ভরা বর্ষায় তলিয়ে গিয়ে নদীর অবস্থান ঠিক করাও কঠিন হয়ে পড়ে। তলিয়ে যাওয়া হাওড়ে চলে নৌকা। কিন্তু বোরো মৌসুমে শুঁটকি মিশে যায় কৃষকের জীবনের সঙ্গে। নদীর তলদেশে পানি থাকলেও পুরো হাওড় শুকনো থাকে। প্রতিদিন কমপক্ষে দুইবার নদী পার হতে হয় তাদের।

ফারুক আহমেদ নামে একজন জানান, সেতু নির্মাণ না হওয়ায় স্থানীয়রা প্রতি বছর একটি করে বাঁশের ভেলা তৈরি করে নদী পারাপার হয়। কৃষকদের ফসলি জমিতে যাওয়া-আসার পথে এ দুর্ভোগ চলছে প্রায় পঞ্চাশ বছর ধরে।

রাখাল আক্তার মিয়া বলেন, গরুর দল নদীতে নামিয়ে ভেলা দিয়ে পার হতে হয় তাদের। কিন্তু মানুষ ওপারে পৌঁছার আগেই গরুগুলো পার হয়ে গিয়ে জমির ধান খাওয়া শুরু করে। যে কারণে প্রতিদিনই ধানী জমির মালিকদের সঙ্গে রাখাল ছেলেদের বাগ্‌বিতন্ডা হয়।

বয়োবৃদ্ধ আব্দুর রহমানসহ ভেলা দিয়ে পার হতে আশা ৭-৮ জন জানান, স্বাধীনতা সংগ্রামের পর থেকে এ পর্যন্ত কয়েক হাজার কৃষক দুর্ভোগ পোহাচ্ছেন শুঁটকি নদীতে একটি সেতুর অভাবে। গত প্রায় পঞ্চাশ বছরে উপজেলাজুড়ে ব্যাপক পরিমাণে ব্রিজ-কালভার্ট হলেও এখানে একটি সেতু নির্মাণ করা হচ্ছে না।

ভেলা তৈরির সঙ্গে জড়িতরা জানান, এটি বানাতে তাদের ব্যয় হয় প্রতি বছর প্রায় পঞ্চাশ হাজার টাকা। যা স্থানীয় কৃষকদের সমিতি থেকে দেওয়া হচ্ছে। তবে কাউকে কোনো মজুরি দিতে হয় না। প্রতি ঘর থেকে একজন করে গিয়ে দুদিন ধরে উৎসবমুখর পরিবেশে কাজ করেন তারা। ভেলায় একেকবার পার হতে ১৫ থেকে ২০ জন উঠতে পারেন। সঙ্গে কিছু মালামালও। রশি টানের মাধ্যমে এপার-ওপার দিনরাত আসা-যাওয়া করতে থাকে ভেলা।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে