লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে.

অবহেলা ও উপেক্ষায় বধ্যভূমি-গণকবর

১৯৭১-এ মহান মুক্তিযুদ্ধে চেনা-অচেনা অনেকেই শহীদ হয়েছেন। তাদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনা উজ্জীবিত রাখতে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে নির্মিত হয়েছে ভাস্কর্য ও স্মৃতিফলক। এছাড়া প্রতিটি এলাকায় ছড়িয়ে আছে বধ্যভূমি। কক্সবাজার জেলার মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিস্তম্ভ ও বধ্যভূমি নিয়ে লিখেছেন আমাদের প্রতিনিধি জাবেদ আবেদীন শাহীন

প্রকাশ | ০৩ ডিসেম্বর ২০২০, ০০:০০

অনলাইন ডেস্ক
মুক্তিকামীদের হত্যা করে টেকনাফের নাইট্যং পাহাড়ে ফেলে দিত হানাদার বাহিনী -যাযাদি
চরম অবহেলা ও উপেক্ষায় পড়ে আছে কক্সবাজার জেলার বধ্যভূমি ও গণকবর। স্বাধীনতার ৪৯ বছর পেরিয়ে গেলেও সংরক্ষণ করা হয়নি জেলার মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিবিজড়িত স্থানগুলো। অযত্ন, অবহেলা ও রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে সময়ের আবর্তে ইতিহাস থেকে মুছে যেতে বসেছে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিবিজড়িত জেলার বধ্যভূমিটি। এতে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী মানুষ। এ অবস্থার জন্য প্রশাসনের উদাসীনতা ও দায়িত্বহীনতাকে দায়ী করেছেন তারা। '৭১-এর বীর মুক্তিযোদ্ধাদের দাবি, বধ্যভূমি সংরক্ষণের উদ্যোগ দ্রম্নত বাস্তবায়ন এবং সব বধ্যভূমি সর্বসাধারণের শ্রদ্ধার জন্য উন্মুক্ত করা হোক। কক্সবাজার জেলায় চিহ্নিত বধ্যভূমি ১২টি হলেও প্রকৃত সংখ্যা ১৭। ২০০২ সালে জেলার তিন উপজেলায় বিভিন্ন স্থানে ১২টি বধ্যভূমি চিহ্নিত করা হয়। এর মধ্যে কক্সবাজার শহরের কবিতা চত্বরসংলগ্ন একটি, টেকনাফে একটি, মহেশখালীতে ১০টি বধ্যভূমি চিহ্নিত করা হয়েছে। তবে শহরের রাডার স্টেশন পাহাড়ের নিচে একটি, খুরুশকূলে একটি, নুনিয়াছটা ফিশারিঘাট ও উত্তর নুনিয়াছটায় আরও দুটি বধ্যভূমি চিহ্নিত হয়নি। কালের বিবর্তনে বধ্যভূমি বেদখল হয়ে গেছে। কয়েকটি বধ্যভূমির স্মৃতিচিহ্নও নেই। ইতোমধ্যে প্রভাবশালীচক্র শহরের বধ্যভূমি দখল করে তৈরি করেছে অবৈধ স্থাপনা। অন্য বধ্যভূমিগুলোতেও দখলবাজদের রাজত্ব চলছে। কক্সবাজার জেলা মুক্তিযোদ্ধা সাবেক জেলা কমান্ডার মো. আলী বাহারছড়া বধ্যভূমির বর্ণনা দিতে গিয়ে জানান, ১৯৭১ সালের ১২ মে কক্সবাজার শহরে কবিতা চত্বর সড়কে পুরনো সিভিল রেস্ট হাউসে (১৬ ইসিবি দপ্তর) পাকিস্তানি বাহিনী ক্যাম্প স্থাপন করে। এরপর থেকেই সেখানে চলে ধর্ষণ, নির্যাতন আর খুন। প্রতিদিন রাত পোহালেই দেখা যেত শেয়াল-কুকুর অসংখ্য নারী পুরুষের লাশ নিয়ে টানাটানি করছে। মুক্তিযুদ্ধকালীন কক্সবাজার সদরে পাকিস্তানি সেনাদের প্রধান ক্যাম্প ছিল এটি। ক্যাম্পের পশ্চিম ও উত্তর পাশের ছয় একর জমিতে অবস্থিত। ওই বধ্যভূমিতে কমপক্ষে দুই হাজার নারী-পুরুষকে হত্যা করা হয়েছিল। এখানে সাধারণ মানুষ, হমুক্তিযোদ্ধা, নারীদের নির্যাতন করা হতো। মুক্তিযুদ্ধের পর এই বধ্যভূমি থেকে উদ্ধার হওয়া অধিকাংশ কঙ্কালই ছিল নারীর। স্বাধীনতার পরে সেখান থেকে উদ্ধার করা মাথার খুলির সঙ্গে লম্বা চুল আর কাপড় জড়ানো ছিল। জেলার বিভিন্ন স্থান থেকে ধরে আনা হতো নারীদের, নির্যাতনের পর হত্যা করা হতো। মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের স্মরণে সেখানে রয়েছে একটি স্মৃতিস্তম্ভ। বর্তমানে স্মৃতিস্তম্ভের কাছেই সে সময় গুলি করে নিরীহ বাঙালিদের হত্যা করা হতো। আরও রয়েছে গণহত্যার সেই ঐতিহাসিক দুটি পাতকুয়া। এখন ময়লা আবর্জনায় কালের সাক্ষীর কুয়া দুটি ভরাট হয়ে গেছে। '৭১-এর সেই ভয়াল দিনগুলোর কথা মনে এলে এখানকার বয়সি মানুষের চোখের সামনে ভেসে ওঠে সেদিনের স্মৃতি। সেই ভয়াল স্মৃতি আজও আতঙ্ক হয়ে আছে। শুধু এই একটি নয়, কক্সবাজারের বিভিন্ন স্থানে আরও কয়েকটি বধ্যভূমির সন্ধান মিলেছে। সেসব স্থানের নানা ঘটনা আজও কাঁদায় স্বজনদের। টেকনাফের নাইট্যং পাড়ায় একটি বধ্যভূমি রয়েছে। যুদ্ধ শেষে এই বধ্যভূমি থেকেই কমপক্ষে শতাধিক মানুষের হাড় ও মাথার খুলি উদ্ধার করা হয়। ওখানে পাহাড়ে হত্যা, নারী ধর্ষণের ঘটনা ঘটে। ওই লাশগুলো সমাহিত করা হয় গণকবরে। টেকনাফের বধ্যভূমিটি ছিল উপজেলা পরিষদের পশ্চিমের পাহাড়ে। বর্তমানে এ বধ্যভূমিটির কোনো চিহ্ন খুঁজে পাওয়া যায় না। কক্সবাজারের মহেশখালী উপজেলায় তিনটি বধ্যভূমি রয়েছে। এগুলো হচ্ছে মহেশখালী আদিনাথ মন্দিরসংলগ্ন পাহাড়ের তিনটি স্থান। এছাড়া গোরকঘাটা মাছবাজার বধ্যভূমি, গোরকঘাটা মাতারবাড়ী বধ্যভূমি, ঠাকুরতলা আদিনাথ মোঠির দক্ষিণ পাশের বধ্যভূমি, পুটিবিলা কায়স্থপাড়া বধ্যভূমি, পুটিবিলা পালপাড়া বধ্যভূমি, দেবাঙ্গাপাড়া বধ্যভূমি, বড় মহশেখালী হিন্দুপাড়া বধ্যভূমি, হোয়ানক পুঁইছড়া বধ্যভূমি, কালারমারছড়া বাজার বধ্যভূমি। তবে আদিনাথ পাহাড়ের মইজ্ঞার ঘোনা, মহন্ত ঘোনা ও মোতঘোনায় পাক বাহিনী হত্যাকান্ড চালায়। ওখানে নারী-পুরুষদের ধরে নিয়ে গিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করে নরপশুরা। এই হত্যাকান্ডের সাক্ষ্য আজও বহন করছে মহেশখালীর প্রত্যন্ত অঞ্চল। কক্সবাজারে ছাত্র ইউনিয়নের সাবেক সভাপতি কলিম উলস্নাহ বলেন, সৈকতে পাশে বাহারছড়া বধ্যভূমিতে তারা প্রতিটি জাতীয় দিবসে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানান। কিন্তু সত্যিকার অর্থে (১৬ ইসিবি দপ্তর থাকায়) আসা যাওয়াতে অনেক সমস্যায় পড়তে হয়। বছরের কিছু বিশেষ দিন ছাড়া সেই বধ্যভূমি থাকে অবহেলিত এবং ময়লা আবর্জনায় ভরা। তাই স্থায়ীভাবে এখানে একটি স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ হলে খুবই ভালো হবে। এতে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী তরুণ প্রজন্ম সঠিক ইতিহাস জানতে পারবে। শহীদ পরিবারের সন্তান সাইফুর রাহিম, আবু সুফিয়ান, উৎপল, হুমায়ুন, আবু জাফরসহ অনেকে ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, স্বাধীনতার ৪৯ বছরেও শহীদ পরিবারের কোনো খবর নেওয়া হয় না। জেলায় মুক্তিযুদ্ধের অনেক স্মৃতিচিহ্ন রয়েছে। যা দ্রম্নত সময়ে সরকারিভাবে সংরক্ষণ করা দরকার। না হয় ইতিহাস বিকৃত হবে অতীতের মতো, তাতে সন্দেহ নেই। তাছাড়া জমির দাম বেড়ে যাওয়ায় প্রভাবশালী ব্যক্তিরা বধ্যভূমির জমি দখলে মরিয়া হয়ে উঠেছেন। কক্সবাজার জেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের দপ্তর সম্পাদক সুনিল বড়ুয়া জানান, একটি মহল মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিচিহ্নকে ধ্বংস করার জন্য সেখানে গড়ে তুলেছে নানান স্থাপনা। কিন্তু জেলার আলোচিত মুক্তিযুদ্ধের সময় হানাদারদের ব্যবহৃত পাতকুয়াটি তাদের কাছে মৃতু্যকূপ হিসেবে এখনো পরিচিত। তবে এটিও সংরক্ষণের অভাবে ধীরে ধীরে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাচ্ছে। এ প্রসঙ্গে কক্সবাজার জেলা প্রশাসক মো. কামাল হোসেন বলেন, মহান মুক্তিযুদ্ধের শহীদের প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা রেখে সরকার সারাদেশের বধ্যভূমিগুলো সংরক্ষণের চেষ্টা চলছে। এতে মুক্তিযুদ্ধের সময়কার কথা আগামী প্রজন্ম সহজে জানতে পারবে বলে জানান তিনি।