শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১
লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে.

৪৯ বছরেও স্মৃতিস্তম্ভ নিয়ে 'বিতর্ক' কাটেনি

১৯৭১-এ মহান মুক্তিযুদ্ধে চেনা-অচেনা অনেকেই শহীদ হয়েছেন। তাদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনা উজ্জীবিত রাখতে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে নির্মিত হয়েছে ভাস্কর্য ও স্মৃতিফলক। এছাড়া প্রতিটি এলাকায় ছড়িয়ে আছে বধ্যভূমি। কক্সবাজার জেলার মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিস্তম্ভ ও বধ্যভূমি নিয়ে লিখেছেন আমাদের প্রতিনিধি জাবেদ আবেদীন শাহীন
নতুনধারা
  ০৩ ডিসেম্বর ২০২০, ০০:০০
শহরের শহীদ মিনারের পাশে নির্মিত মুক্তিযোদ্ধাদের নামাঙ্কিত স্মৃতিস্তম্ভ

স্বাধীনতার ৪৯ বছরেও সংরক্ষণ করা হয়নি কক্সবাজারের মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিস্তম্ভ। নির্মাণের ১৪ বছরেও কক্সবাজার শহীদ স্মৃতিস্তম্ভ নিয়ে বিতর্ক কাটেনি। বিশেষত জেলার প্রকৃত শহীদদের নাম অন্তর্ভুক্ত না করায় জন্ম নিয়েছে নানা বিতর্ক।

মুক্তিযোদ্ধারা বলেন, দেশ স্বাধীনের ৪৯ বছর পরেও জেলার বধ্যভূমি ও স্মৃতিসৌধ সংরক্ষণে বারবার আবেদন করা হলেও প্রশাসনের পক্ষ থেকে এখন পর্যন্ত কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়নি। শুধু শহীদদের স্মরণে ২৬ মার্চ ও ১৬ ডিসেম্বরে পুষ্পার্ঘ্য অর্পণ, বীর মুক্তিযোদ্ধাদের মৃতু্যর পর সম্মান দেখানো এবং স্মরণসভা ছাড়া আর তেমন কোনো কিছু করা হয় না। এমনকি শহীদ পরিবারগুলোর খোঁজ-খবর ও দেখভালও করা হয় না।

মুক্তিযোদ্ধারা আরও বলেন, তারা দেশের মায়ার টানে যুদ্ধ করেছেন, কোনো কিছু প্রাপ্তির জন্য নয়, শুধু দেশ মাতৃকার মুক্তির জন্য যুদ্ধ করেছেন। যা ছিল পাকিস্তানি শাসকদের শোষণ ও বঞ্চনার অবসানে সর্ববৃহৎ পদক্ষেপ। অথচ এত বছর পরও রাজাকারদের তালিকা হয়নি। বারবার দেশের মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা তৈরির নামে হয়রানি ও অসম্মান করা হয়েছে।

কক্সবাজার জেলা পরিষদ ও গণপূর্ত বিভাগ সূত্র জানায়, ২০০৬ সালের এপ্রিল মাসে প্রায় ১১ লাখ টাকা ব্যয়ে শহরের কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের পাশে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিস্তম্ভটি নির্মিত হয়। জেলা পরিষদের অধীনে এটির নির্মাণকাজ বাস্তবায়ন করে গণপূর্ত বিভাগ। মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা অনুযায়ী স্মৃতিস্তম্ভের কালো ফলকে উৎকীর্ণ করা হয় ১০ জন শহীদের নাম। তারা হলেন- শহীদ আব্দুল হামিদ, গোলাম কাদের, গোলাম সাত্তার, ক্যাপ্টেন মকবুল আহমদ, সিদ্দিক আহমদ, হাবিলদার আবুল কাশেম, এজাহার মিয়া, সিপাহি লাল মোহাম্মদ, শামসুল আলম ও এস এম জাহাঙ্গীর। এতে জেলার সব শহীদ মুক্তিযোদ্ধার নাম না থাকায় সে সময় থেকে চরম আপত্তি ওঠে। আন্দোলনে নামে জেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদসহ বিভিন্ন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন।

মুক্তিযোদ্ধা সংসদ সূত্র জানায়, শহীদ হ পৃষ্ঠা ১৫ কলাম ১

স্মৃতিস্তম্ভে স্থান পায়নি কক্সবাজারের প্রথম শহীদ মোহাম্মদ শরীফ চেয়াম্যান, শহীদ বুদ্ধিজীবী শহীদ সাবের, ঢাবির ইকবাল হলের শহীদ এটিএম জাফর আলম চৌধুরী, চট্টগ্রাম বন্দরের অস্ত্র খালাসের প্রতিবাদকারী বাঙালি সৈনিক শহীদ সিপাহি আকতার হোসাইন, এনামুল হক, শহীদ আমির হামজা, শহীদ সুভাষ, ফরহাদ, ইলিয়াছ মাস্টার, হাবিলদার রহিম বখশ, মেছের আহমদ, জোনাব আলী, ভট্ট মহাজন, সিপাহী আবুল হোসেন, মাস্টার শাহ আলম, মাস্টার আহমদ বশির, কবির আহমদ, অজিত পাল, নির্মল ধর, মোহাম্মদ আলী, পিয়ারী মহাজন, স্বপন ভট্টাচার্য, মনিন্দ্র নাথ দে, নুরুচ্ছফা চৌধুরী, জ্ঞানেন্দ্র লাল চৌধুরী, সতীশ মহাজন দে, মোহাম্মদ শামসুল ইসলাম, আবদুস সাত্তার, অনিল কান্তি দাশ, শশাংক বড়ুয়াসহ অনেক শহীদ মুক্তিযোদ্ধার নাম। ১৯৯৯ সালে কক্সবাজারে প্রথম মুক্তিযোদ্ধার তালিকায় ছিলেন ১৪৭ জন। পরে ২০০৪ সালে যাচাই-বাছাইয়ের নামে ওই তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হয় আরও অন্তত ৬০ জনকে। ২০০৫ সালের ৪ জুন প্রকাশিত গেজেটে কক্সবাজারের মুক্তিযোদ্ধা দেখানো হয়েছে ৩৩২ জন।

এ প্রসঙ্গে সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট কক্সবাজারের সভাপতি সত্যপ্রিয় চৌধুরী দোলন বলেন, স্মৃতিস্তম্ভটি এক দশকের বেশি সময় ধরে নির্মিত হলেও মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী আওয়ামী লীগ সরকারের আমলেও নামফলকে বাদ পড়া শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের নাম অন্তর্ভুক্ত না হওয়া দুঃখজনক। তিনি আরও বলেন, বাদ পড়া শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের নাম অন্তর্ভুক্তির দাবিতে শহরে প্রতিবাদও হয়েছে, কিন্তু এখনো পর্যন্ত পূর্ণাঙ্গ তালিকা বাস্তবায়ন আলোর মুখ দেখেনি। তবে অবাক করার বিষয়, অসম্পূর্ণ নামের তালিকাটাও এখনো রাখা হয়েছে বির্তকিতভাবে।

শহীদ মুক্তিযোদ্ধার সন্তান আবু সুফিয়ান রুমি বলেন, বিজয়ের মাস ডিসেম্বর এলেই প্রতিবারই কথা উঠে অথবা স্মৃতিস্তম্ভ থেকে বাদ পড়া শহীদদের নিয়ে আলোচনা হয়। নতুন প্রজন্মের কাছে মুক্তিযোদ্ধাদের সঠিক ইতিহাস তুলে ধরতে স্মৃতিস্তম্ভে পূর্ণাঙ্গ তালিকা দরকার। তাই দ্রম্নত সময়ের মধ্যে বাদ পড়া শহীদদের নাম অন্তর্ভুক্ত করার জোরালো দাবি জানান তিনি।

জয় বাংলা বাহিনী '৭১-এর প্রধান ও জেলার প্রথম সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক কামাল হোসেন চৌধুরী বলেন, শহীদ স্মৃতিস্তম্ভে কারও নাম থাকবে কারও নাম থাকবে না, এটা হলে ইতিহাস কখনো আমাদের ক্ষমা করবে না। এখনো অযত্ন-অবহেলায় পড়ে আছে শহীদ স্মৃতিস্তম্ভটি। এ ব্যাপারে প্রসাশনের সহযোগিতা কামনা করেন তিনি।

কক্সবাজার জেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদ ইউনিট কমান্ডের প্রতিষ্ঠাতা কমান্ডার ও সেক্টর কমান্ডারস ফোরাম জেলার সভাপতি মোহাম্মদ আলী বলেন, মুক্তিযোদ্ধা সংসদের পক্ষ থেকে বাদ পড়া শহীদদের নামের একটি তালিকা প্রশাসনের সংশ্লিষ্টদের কাছে জমা দেওয়া হয়। এ ব্যাপারে এ বিজয়ের মাসে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য জেলা প্রশাসনকে আবারও তাগাদা দেওয়া হবে বলে জানান তিনি।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে