বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

বধ্যভূমি থেকে বের হলো হাড় ও দাঁতের পাটি

মুক্তিযুদ্ধ আমাদের অহঙ্কার। ১৯৭১-এ মহান মুক্তিযুদ্ধে লাখো বাঙালি অকাতরে প্রাণ বিলিয়েছে দেশের জন্য। দেশের বিভিন্ন প্রান্তে লড়াই করতে গিয়ে শহীদ হয়েছেন অনেকেই। তাদের কেউ আমাদের চেনা, কেউবা অচেনা। বাঙালির শ্রেষ্ঠ এই সন্তানদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনা উজ্জীবিত রাখতে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে নির্মিত হয়েছে ভাস্কর্য ও স্মৃতিফলক। এছাড়া প্রতিটি এলাকায় ছড়িয়ে আছে বধ্যভূমি।
আবেদুল হাফিজ
  ০৪ ডিসেম্বর ২০২০, ০০:০০
পাক হানাদার বাহিনী টাউন হল ব্যবহার করত টর্চারসেল হিসেবে -যাযাদি

রংপুরে টাউন হলের বধ্যভূমিতে নির্মাণাধীন স্মৃতিসৌধ খোঁড়াখুঁড়ি করতে গিয়ে ঐতিহাসিক ইন্দারা থেকে বেরিয়ে এলো নরকংকালের হাড় ও দাঁতের পাটি। চলতি বছরের ১ ডিসেম্বর (মঙ্গলবার) বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন মেহেদী এন্টাপ্রাইজের ঠিকাদার শাহীনুর রহমান লিটন ও মাসুম মিয়া। তারা জানান, রংপুর জেলা সেক্টর কমান্ডার ফোরামের সভাপতি শাহাদৎ হোসেন তা সংরক্ষণের জন্য নিয়ে গেছেন। এদিকে, ঐতিহাসিক ইন্দারার অংশের কাজ সাময়িক বন্ধের নির্দেশ দিয়েছেন জেলা প্রশাসক আসিব আহসান। '৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে পাক হানাদার বাহিনী অসংখ্য বাঙালি নরনারীকে ধরে নিয়ে এসে পাশবিক নির্যাতন চালিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা করে লাশ ওই ইন্দারায় ফেলে দিয়েছিল।

এদিকে, মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে গণহত্যার নীরব সাক্ষী রংপুরের অধিকাংশ বধ্যভূমি অযত্ন অবহেলায় পড়ে আছে। এগুলোতে স্মৃতিস্তম্ভ নির্মিত না হওয়ায় সংরক্ষণের অভাবে এমন চিত্র ফুটে উঠেছে।

রংপুর জেলা সংসদের মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার বীর মুক্তিযোদ্ধা মোছাদ্দেক হোসেন বাবলু যায়যায়দিনকে জানিয়েছেন, রংপুরে জানা অজানা অসংখ্য বধ্যভূমি রয়েছে। এর মধ্যে এখন পর্যন্ত ১৫টি বধ্যভূমি চিহ্নিত করা গেছে। বাকিগুলোর অনুসন্ধান চলছে। এসব বধ্যভূমিতে পাক হানাদার বাহিনী ও রাজাকার আলবদররা নৃশংসভাবে নির্বিচারে বাঙালি নিধনে গণহত্যা চালিয়েছিল।

এদিকে, অযত্ন-অবহেলায় পড়ে আছে রংপুরের কাউনিয়া উপজেলার শহীদবাগ ইউনিয়নের ভূতছাড়া বধ্যভূমি, বদরগঞ্জের রামনাথপুর ইউনিয়নের ঝাপপাড়া বধ্যভূমি, তারাগঞ্জের আলমপুর ইউনিয়নের মধুরাপমপুর বধ্যভূমি, গঙ্গাচড়ার তিস্তার চর বধ্যভূমি, নগরীর হাজীরহাট ব্রিজসংলগ্ন বধ্যভূমি, নব্দীগঞ্জ বধ্যভূমি, দখিগঞ্জ শ্মশান, মিঠাপুকুরের পায়রাবন্দ ইউনিয়নের জয়রাম আনোয়ার ও বদরগঞ্জের রামনাথপুর ইউনিয়নের পদ্মপুকুর বধ্যভূমি। এসব বধ্যভূমিতে দ্রম্নত স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণের দাবি তুলেছেন মুক্তিযোদ্ধারা।

প্রসঙ্গত, মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে রংপুর টাউন হলকে জলস্নাদখানা বানিয়েছিল পাক হানাদার বাহিনী। রাজাকার আলবদর ও আলশামস বাহিনীর সদস্যরা বাঙালি নারী-পুরুষকে সেখানে ধরে নিয়ে এসে রাতভর পাশবিক নির্যাতন চালাত। তাদের বিবস্ত্র করে গাছে বেঁধে রাখা হতো। তাদের চাকু দিয়ে খুঁচিয়ে খঁচিয়ে মেরে পাশের ইন্দারায় ফেলে দেওয়া হতো। এভাবে সেখানে শত শত নারী-পুরুষকে মেরে ফেলেছিল পাক হানাদার বাহিনী। স্বাধীনতা লাভের পর ওই জলস্নাদখানা থেকে ৫০ জন বিবস্ত্র নারীকে উদ্ধার করেন মুক্তিযোদ্ধারা। নারীদের ধরে এনে ধর্ষণ করার অভিযোগ রয়েছে তৎকালীন ইসলামী ছাত্র সংঘের রংপুর জেলা সভাপতি যুদ্ধাপরাধের দায়ে মৃতু্যদন্ডপ্রাপ্ত এটিএম আজহারুল ইসলামের বিরুদ্ধে। এটি রংপুরের সবচেয়ে বড় বধ্যভূমি হিসেবে পরিচিত।

'৭১ সালের ৩ এপ্রিল বাড়ি থেকে ধরে এনে নগরীর দখিগঞ্জ শ্মশানে ১১ জন বাঙালিকে চোখ বেঁধে এনে হত্যাযজ্ঞ চালায় পাক হানাদার বাহিনী। এদের মধ্যে রয়েছেন, এ ওয়াই এম মাহফুজ আলী জররেজ, মোহাম্মদ আলী, গোপাল চন্দ্র, দুর্গাদাস অধিকারী, উত্তম কুমার অধিকারী, দুলাল মিয়া, রফিক আলী, ক্ষীতিশ হাওলাদার প্রমুখ।

'৭১ সালের ২৮ মার্চ শত শত বাঙালি নারী-পুরুষ সাঁওতাল তীর ধনুক নিয়ে রংপুর ক্যান্টনমেন্ট ঘেরাওয়ের সময় পাক হানাদার বাহিনী মধ্যযুগীয় কায়দায় নির্বিচারে গুলি করে হত্যা করে তাদের নিসবেতগঞ্জের ঘাঘট নদীতে ভাসিয়ে দিয়েছিল।

১২ এপ্রিল নিসবেতগঞ্জ বালারখাল এলাকায় আওয়ামী লীগের ডা. জিকরুল হক এমপিসহ ৮৪ জনকে পাক হানাদার বাহিনী হত্যা করে। ১৭ এপ্রিল বদরগঞ্জের রামনাথপুর ইউনিয়নের ঝাড়য়ারবিল ও পদ্মপুকুর এলাকায় নির্বিচারে গণহত্যা চালিয়েছিল পাক হানাদার বাহিনী। এ দুটি এলাকায় প্রায় দেড় সহস্রাধিক নারী-পুরুষ বাঙালিকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। তাদের হাতে ৫ বছরের শিশু পর্যন্ত রেহাই পায়নি। ২২ এপ্রিল মিঠাপুকুর উপজেলার পায়রাবন্দ ইউনিয়নের জয়রাম আনোয়ার এলাকায় হত্যাকান্ড চালায় পাক হানাদার বাহিনী। সেখানে ২৬ জন বাঙালিকে হত্যা করা হয়। '৭১ সালে ১ মে নগরীর সাহেবগঞ্জ বাহারকাচনা এলাকায় ১৯ জন বাঙালি সৈনিককে গুলি করে হত্যা করে পাক হানাদার বাহিনী। তাদের মধ্যে ছিলেন ময়মনসিংহের মেজর আকবর।

রংপুর সদরের চন্দনপাট ইউনিয়নের লাহেড়ীরহাটে ৩২ জন বাঙালি মুসলিমকে হত্যা করা হয়। তাদের মধ্যে ছিলেন নগরীর রাধাবলস্নভ এলাকার মনোয়ার হোসেন বেনু, সাতগাড়া মিস্ত্রিপাড়ার নওয়াব আলী বাপাত, পীরজাবাদের আব্দুল করিম।

১৪ মে রংপুর ক্যান্টনমেন্টের পশ্চিত সীমানায় নিসবেতগঞ্জের ঘাঘট নদীর তীরে অসংখ্য বাঙালি ইপিআর বাহিনীর সদস্যদের গুলি করে হত্যা করা হয়।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে