বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১
সাক্ষাৎকার

মাটি পরীক্ষায় ফসল উৎপাদন বাড়ছে :বিধান কুমার ভান্ডার

আলতাব হোসেন
  ০৪ ডিসেম্বর ২০২০, ০০:০০
বিধান কুমার ভান্ডার

মাটি হচ্ছে কৃষির মূল ভিত্তি। উর্বর মাটি না হলে ভালো ফসল পাওয়া যায় না। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে প্রাকৃতিকভাবেই মাটিতে জৈব পদার্থের ঘাটতি তৈরি হচ্ছে। এর মধ্যে দেশের মোট আবাদি জমির ৬১ ভাগেই মারাত্মক জৈবঘাটতি তৈরি হয়েছে। মাটিতেই পাঁচ শতাংশ জৈব পদার্থ থাকার কথা থাকলেও তা এক শতাংশেরও নিচে নেমে গেছে। মাটির স্বাস্থ্য ফিরিয়ে আনতে কাজ করছে কৃষি মন্ত্রণালয়ের গবেষণা প্রতিষ্ঠান মৃত্তিকা সম্পদ উন্নয়ন ইনস্টিটিউট (এসআরডিআই)। মাটির গুণাগুণ সম্পর্কে চলমান গবেষণা কার্যক্রম নিয়ে দৈনিক যায়যায়দিনকে এসব তথ্য জানান সংস্থাটির মহাপরিচালক বিধান কুমার ভান্ডার।

যায়যায়দিন :৫ ডিসেম্বর বিশ্ব মৃত্তিকা দিবস। দিবসটির প্রতিপাদ্য হচ্ছে 'মাটিকে সজীব রাখুন, মাটির জীববৈচিত্র্য রক্ষা করুন'। মাটির গুণাগুণ বাড়াতে কী ধরনের গবেষণা কার্যক্রম গ্রহণ চলছে, তা নিয়ে কিছু বলেন।

বিধান কুমার ভান্ডার :আমাদের কাজ হলো মাটি ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে প্রযুক্তির উন্নয়ন করা। কৃষি উৎপাদন অব্যাহত রাখতে মাটির স্বাস্থ্য ঠিক রাখা। মাটি পরীক্ষায় কৃষকদের ফসল উৎপাদনে সহায়ক হচ্ছে। লবণাক্ত ও জলবায়ু সহিষ্ণু মাটিতে কী ধরনের ফসল ফলানো যায় তা মাটি পরীক্ষা করে জানিয়ে দেওয়া হচ্ছে। তবে জমির উর্বরাশক্তি কমে যাওয়ার মূল কারণ হচ্ছে- একই জমিতে বছরে একাধিকবার ফসল চাষ এবং মাত্রাতিরিক্ত রাসায়নিক সার ব্যবহারে ভেঙে পড়েছে মাটির স্বাস্থ্য। বেশি ফলন পাওয়ার আশায় বেশি বেশি রাসায়নিক সার ও কীটনাশক ব্যবহার করেন কৃষকরা। এতে জমির জৈব পদার্থ কমে যাচ্ছে। হারিয়ে যাচ্ছে জমির উর্বরাশক্তি। জমির উর্বরাশক্তি ঠিক রাখতে প্রয়োজন নানা ধরনের ফসল চাষ। উচ্চফলনশীল ও হাইব্রিড জাতের ফসল চাষও জমির উর্বরা কমার কারণ। এসআরডিআই-এর মাটি পরীক্ষার মাধ্যমে সুষম সার ব্যবস্থাপনায় সুফল পাচ্ছে দেশের কৃষকরা। সেই সাথে ভূমি জরিপের মাধ্যমে বিভিন্ন কলাকৌশল উদ্ভাবনের মাধ্যমে অনাবাদি জমি আসছে চাষাবাদের আওতায়। উৎপন্ন হচ্ছে অধিক ফসলও।

যায়যায়দিন :ভেজাল সারের কারণেও মাটির উর্বরাশক্তি কমে যাওয়ার কথা শোনা যায়। ফসল উৎপাদন বাড়াতে মাটির উর্বরাশক্তি বাড়াতে আপনাদের উদ্যোগ নিয়ে কিছু বলেন।

বিধান কুমার ভান্ডার :প্রতি বছর সংস্থাটির গবেষণাগারে ৪০ হাজার মৃত্তিকা পানি নমুনা বিশ্লেষণ করে সুষম সার দেওয়ার সুপারিশ করছে। প্রকাশ করা হয়েছে ভূমি ব্যবহারের মানচিত্রও। নিত্যনতুন কৌশল হিসেবে অনলাইন সার সুপারিশ প্রযুক্তির মাধ্যমেও কৃষকদের সেবা দেওয়া হচ্ছে। সাধারণত ৪৫ শতাংশ খনিজ বা মাটির কণা, ৫ শতাংশ জৈব এবং ২৫ শতাংশ করে পানি ও বাতাস থাকা মাটিকে সুষম মাটি বলা হয়। একটি আদর্শ জমিতে জৈব পদার্থের মাত্রা ৩.৫ শতাংশ থাকা অতি প্রয়োজনীয় হলেও এ দেশের বেশির ভাগ জমিতে জৈব পদার্থের পরিমাণ এক দশমিক ১৭ শতাংশ এবং কিছু কিছু জমিতে এর পরিমাণ ১ শতাংশের চেয়েও কম। এর মধ্যে ৫৪ লাখ হেক্টর জমিতে ফসফরাস, ২৬ দশমিক ৩০ লাখ হেক্টর জমিতে পটাশিয়াম, ৩৩ দশমিক ৩০ লাখ আট হাজার হেক্টর জমিতে গন্ধক, ২৭ দশমিক ৭ লাখ হেক্টর জমিতে দস্তা সার, ২৩ দশমিক ৯ লাখ হেক্টর জমিতে বোরন সারের অভাব রয়েছে। এছাড়া অনেক জমিতে রয়েছে ক্যালসিয়াম ও ম্যাগনেসিয়ামের অভাব।

যায়যায়দিন: ভেজাল সারে মাটির গুণাগুণ নষ্ট ও নতুন নতুন রোগবালাইয়ের কথা বলছেন কৃষি গবেষকরা। মানসম্মত সারের ব্যবহারে আপনারা কৃষককে কীভাবে সাহায্য করছেন?

বিধান কুমার ভান্ডার: সারের গুণগতমান নিশ্চিত করার স্বার্থে ৭টি বিভাগীয় গবেষণাগারের মাধ্যমে বছরে প্রায় ৩০ হাজারটি সার পরীক্ষা করা হয়। ১০টি ভ্রাম্যমাণ মৃত্তিকা পরীক্ষাগারের মাধ্যমে প্রতি বছর ১১২টি উপজেলার প্রায় পাঁচ হাজার ৬০০ কৃষকের মাটি পরীক্ষা করে তাৎক্ষণিক বিভিন্ন ফসলের জন্য সুষম সার সুপারিশ প্রদান করা হচ্ছে। নতুন ১৯টি আঞ্চলিক কার্যালয় এবং নতুন করে ৬টি ল্যাব স্থাপনের মাধ্যমে এসআরডিআই মোট ৪০টি আঞ্চলিক অফিস ও ২৬টি ল্যাবের মাধ্যমে সেবা দিচ্ছে কৃষকদের। উপজেলা ভূমি ও মৃত্তিকা সম্পদ ব্যবহার নির্দেশিকা ব্যবহার করে কৃষককে সুষম সার সুপারিশ প্রদান করা হয়। সারা দেশের ভূমি ব্যবহার মানচিত্র প্রকাশ করা হয়েছে। মৃত্তিকা সম্পদ উন্নয়ন ইনস্টিটিউট 'অন-লাইন সার সুপারিশ' প্রযুক্তির উদ্ভাবন করেছে। যার মাধ্যমে দেশের যেকোনো প্রান্ত থেকে অনলাইনের মাধ্যমে কৃষক তার জমির জন্য প্রয়োজনীয় সারের মাত্রা নিরূপণ করতে পারেন। সাম্প্রতিক গবেষণায় দস্তা ও বোরন সারে ৭০ শতাংশ ভেজাল পাওয়া যাচ্ছে। সরকার ইউরিয়া সারের দাম কমানো ও সরবরাহব্যবস্থা স্বাভাবিক রাখায় ইউরিয়া সারে ভেজাল কমেছে।

যায়যায়দিন: উপকূলীয় অঞ্চল, পাহাড়ি এবং বরেন্দ্র অঞ্চলে কৃষি উৎপাদন বাড়াতে আপনাদের সুপারিশগুলো সম্পর্কে জানতে চাই। মাটির স্বাস্থ্য রক্ষায় আপনারা কী ভাবছেন?

বিধান কুমার ভান্ডার: পার্বত্য অঞ্চলে ফসল চাষাবাদে ভূমিক্ষয় একটি বড় সমস্যা। এই সমস্যা সামনে রেখে এসআরডিআই বান্দরবানে বিভিন্ন প্রযুক্তি উদ্ভাবন করছে। ইতোমধ্যে পাহাড়ি এলাকার ভূমি ক্ষয়রোধে কয়েকটি প্রযুক্তি উদ্ভাবন করা হয়েছে। দক্ষিণাঞ্চলের উপকূলে ১০ লাখ ৫৬ হাজার জমি লবণাক্ত। লবণাক্ত মাটিতে ফসল চাষের জন্য খুলনার বটিয়াঘাটাতে 'লবণাক্ততা ব্যবস্থাপনা ও গবেষণা কেন্দ্র' করা হয়েছে। এখান থেকে বেশ কয়েকটি প্রযুক্তি উদ্ভাবন করা হয়েছে। তার মধ্যে উলেস্নখযোগ্য- খামার পুকুর প্রযুক্তি, কলস সেচ প্রযুক্তি, দ্বি-স্তর মালচিং, ভুট্টার ডিবলিং ও ট্রান্সপস্নানটিং পদ্ধতি, পলিব্যাগের চারা রোপণ পদ্ধতিতে তরমুজ চাষ, পলিবেডে শাকজাতীয় ফসল চাষ ইত্যাদি। ইতোমধ্যে লবণাক্ত এলাকা দক্ষিণালে ডিবলিং পদ্ধতিতে ভুট্টা চাষ করা হচ্ছে।

যায়যায়দিন: মাটিতে জৈব উপাদান ফিরিয়ে আনতে করণীয় বিষয়ে কিছু পরামর্শ দিলে উপকৃত হবে কৃষক। এ বিষয়ে কিছু বলেন।

বিধান কুমার ভান্ডার: শিগগিরই মাটির মানচিত্র ও আইডি করা হবে। প্রতিটি জমির মাটিতে কতটুকু জৈব উপাদান আছে তা উলেস্নখ থাকবে। অনলাইনে সবাই জানতে পারবেন কার জমিতে উর্বরাশক্তি কতটা। উর্বরাশক্তি ফিরিয়ে আনতে চাষে ভিন্নতা আনতে হবে। এবার ধান করলে পরের বছর ডালজাতীয় ফসল করতে হবে। আবার দুই ফসল উৎপাদনের পর জমিকে বিশ্রাম নেওয়ার সুযোগ দিতে হবে। গরু-মহিষের গোবর জৈব পর্দাথের বড় উৎস। মাটির সঙ্গে খৈল মিশিয়ে দিলে তা থেকে মাটি পুষ্টি গ্রহণ করতে পারবে।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে