শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

বীরশ্রেষ্ঠ হামিদুরের গ্রামের নামকরণ এখনো 'হামিদনগর' হয়নি

ম তারেক মাহমুদ, কালীগঞ্জ (ঝিনাইদহ)
  ১৬ ডিসেম্বর ২০২০, ০০:০০
বীরশ্রেষ্ঠ শহীদ সিপাহী হামিদুর রহমান গ্রন্থাগার ও স্মৃতি জাদুঘর -যাযাদি

ঝিনাইদহ শহর থেকে ঢাকা-খুলনা সড়ক ধরে ১৫ কিলোমিটার পথ গেলে কালীগঞ্জ শহর। এ শহর থেকে কোটচাঁদপুর উপজেলা শহর হয়ে চুয়াডাঙ্গা সড়ক ধরে সাত কিলোমিটার গেলে ভারতীয় সীমান্তবর্তী উপজেলা মহেশপুরের খালিশপুর বাজার। চমচম মিষ্টির জন্য সুখ্যাতি অর্জন করা এ বাজার পার হয়ে ডান দিকের পাকা সড়ক ধরে মাত্র তিন কিলোমিটার এগোলেই কপোতাক্ষ নদের তীর ঘেঁষে বীরশ্রেষ্ঠ হ পৃষ্ঠা ১৫ কলাম ৫ হামিদুর রহমানের বাড়ি। বীরশ্রেষ্ঠের এ গ্রামটির নাম খর্দ্দ খালিশপুর। ২০০৮ সালের গ্রামের নাম হামিদনগর ঘোষণা করা হলেও তা এখন পর্যন্ত বাস্তবায়ন হয়নি। বাড়িতে প্রবেশ করেই চোখে পড়ে বিগ বাজেটের চারতলা বিল্ডিংয়ের ফাউন্ডেশনের কাজ চলছে। বীরশ্রেষ্ঠের পরিবারের জন্য এ বাড়িটি নির্মিত হচ্ছে। ঝিনাইদহ গণপূর্ত বিভাগ নিয়ন্ত্রণাধীন এ বাড়িটি তৈরির কাজ শুরু হয়েছিল চলতি বছরের ২৬ অক্টোবর। স্থানীয় এক ঠিকাদার এটি করছেন। বাড়ির প্রতিটি ফ্লোরে থাকবে দুটি ইউনিট। বাড়ির চারপাশে প্রাচীরসহ থাকছে আলাদা গেস্টরুম ও গার্ডরুম। বাড়িটি পেয়ে যারপরনাই খুশি বীরশ্রেষ্ঠর পরিবার। এর আগে এরশাদ সরকার একতলাবিশিষ্ট একটি ঘর করে দেয়। তারপর ঘরটি নষ্ট হয়ে গেলে দীর্ঘদিন ধরে বীরশ্রেষ্ঠ শহীদ হামিদুরের পরিবার টিন শেডের বাড়িতে বসবাস করে আসছিল। বর্তমান সরকারের সময় চারতলা বাড়ির সিদ্ধান্ত হয়। বীরশ্রেষ্ঠ হামিদুর রহমান ছিলেন চার ভাই ও দুই বোনের মধ্যে সবার বড়। চলতি বছরের ১৬ অক্টোবর মারা যান সেজ ভাই শুকুর আলী। এর দু'বছর আগে স্ট্রোক করে মারা যান ছোট ভাই ফজলুর রহমান। ২০০৫ সালের ২১ ফেব্রম্নয়ারি মারা যান মা কায়দাছুন্নেছা। এখন জীবিত আছেন একমাত্র ভাই হামজুর রহমান ও দুই বোন। প্রতি মাসে সরকারের পক্ষ থেকে এই পরিবারকে ৩৫ হাজার টাকা ভাতা পাঁচটি হিসাব নম্বরে প্রদান করা হয়। এছাড়া জাতীয় যেকোনো দিবসে বঙ্গভবনে দাওয়াত দিয়ে পরিবারের পাঁচজনকে বিশেষ সম্মানী দেওয়া হয়। বীরশ্রেষ্ঠের তিন ভাই প্রত্যেকের এক ছেলে ও এক মেয়ে রয়েছে। এর মধ্যে মেজ ভাই হামজুর রহমানের ছেলে মুস্তাফিজুর রহমান হামিদুর রহমান গ্রন্থাগার ও স্মৃতি জাদুঘরের লাইব্রেরিয়ানের চাকরি করছেন। দু'জন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছে। বাকিরা সবাই মাধ্যমিক ও প্রাথমিকের শিক্ষার্থী। এছাড়া বীরশ্রেষ্ঠের ছোট ভাই ফজলুর রহমানের স্ত্রী জেসমিন সুলতানা সরকারি বীরশ্রেষ্ঠ হামিদুর রহমান কলেজের অফিস সহকারী হিসেবে চাকরি করছেন। কথা হয় বীরশ্রেষ্ঠ হামিদুর রহমানের মেজ ভাই হামজুর রহমান ও তার ছেলে মুস্তাফিজুর রহমান মিলনের সঙ্গে। জানালেন পরিবারের অতীত-বর্তমান, সুখ-দুঃখ আর মুক্তিযুদ্ধের সেই দিনগুলোর কথা। ২৮ অক্টোবর বীরশ্রেষ্ঠ শহীদ সিপাহি হামিদুর রহমানের মৃতু্যবার্ষিকী। চলতি বছর ছিল বীরের ৪৯তম মৃতু্যবার্ষিকী। ২০০৮ সালের ৯ মার্চ শহীদ সিপাহি হামিদুর রহমান গ্রন্থাগার ও স্মৃতি জাদুঘর উদ্বোধন করেন মুক্তিযুদ্ধের ৪নং সেক্টর কমান্ডার বীর উত্তম (অব.) মেজর জেনারেল সিআর দত্ত। জাদুঘর উদ্বোধনকালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের স্থানীয় সরকার, পলস্নী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা আনোয়ারুল ইকবাল গ্রামের নাম 'হামিদনগর' ঘোষণা দেন; কিন্তু আজও তা কাগজ-কলমে কার্যকর হয়নি। বীরশ্রেষ্ঠর পরিবারের দাবি, স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদ আর উপজেলা নির্বাহী অফিসারের গাফিলতির কারণেই এখনো এ গ্রামের নাম হামিদনগর হয়নি। তারা বীরশ্রেষ্ঠ হামিদুর রহমান কলেজ ও স্মৃতি জাদুঘরের পাশে সরকারের পতিত ৩৭ বিঘা খাস জমিতে বীরশ্রেষ্ঠ হামিদুর রহমান ইকোপার্ক তৈরির দাবি জানান। ইতোমধ্যে বীরশ্রেষ্ঠের পরিবারের পক্ষ থেকে তার মেজ ভাই হামজুর রহমান কমিউনিটি হাসপাতাল করার জন্য ক্রয়কৃত আট শতক জমি দান করেছেন। জাদুঘরের সামনে স্থাপিত বীরশ্রেষ্ঠ হামিদুরের বিশাল আকৃতির পোট্রেটের নিচে জন্ম সাল ১৯৫৩ উলেস্নখ করা হলেও মাস বা দিন উলেস্নখ করা হয়নি। তবে দেশে প্রকাশিত কয়েকটি বইয়ে শহীদ হামিদুরের জন্ম তারিখ ২ ফেব্রম্নয়ারি ১৯৫৩ সাল লেখা হয়ে আসছে। গ্রন্থাগার ও স্মৃতি জাদুঘরে আসা দর্শনার্থীদের সুবিধার্থে জাদুঘরের সামনেই স্থাপন করা হয়েছে বীরশ্রেষ্ঠ হামিদুরের জীবনী সংবলিত একটি বিশাল আকৃতির ফলক। যেখানেও শুধু হামিদুরের জন্ম সালই লেখা হয়েছে। এছাড়া স্বাধীনতা যুদ্ধের মৃতু্যঞ্জয়ী এ সৈনিকের জীবনী ফলকে মায়ের নাম ভুল লেখা হয়েছে। ঝিনাইদহের মহেশপুর উপজেলার খর্দ্দ খালিশপুর (প্রস্তাবিত হামিদনগরে) গ্রামের শহীদ হামিদুরের বাড়ি গিয়ে পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, জাতীয় পরিচয়পত্র ও জমির দলিলসহ গুরুত্বপূর্ণ কাগজপত্রে মায়ের নাম লেখা রয়েছে কায়দাছুন্নেছা। অথচ জাদুঘরের ফলকে লেখা হয়েছে কায়দাছুন্নেছা। জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড এবং মাদ্রাসা বোর্ড কর্তৃক প্রকাশিত বইয়ে বীরশ্রেষ্ঠ হামিদুরের মায়ের নাম লেখা হয়েছে 'কায়সুননেসা'। ফলকে মুক্তিযোদ্ধা হামিদুর রহমানের সংক্ষিপ্ত জীবনীতে আরও লেখা হয়েছে 'ভারতের পশ্চিমবঙ্গের চব্বিশ পরগোনা জেলার চাপড়া থানার ডুমুরিয়া গ্রামে ১৯৫৩ সালে জন্মগ্রহণ করেন। বাবার নাম আক্কাছ আলী মন্ডল, মায়ের নাম কায়ছুন্নেছা। ১৯৪৭ সালের ভারত বিভাগের পর তাদের পরিবার যশোরের সীমান্তবর্তী ঝিনাইদহের মহেশপুর উপজেলার খোর্দ্দ খালিশপুর গ্রামে স্থানীয়ভাবে বসবাস শুরু করেন। ১৯৭১ সালের ২ ফেব্রম্নয়ার তিনি ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে যোগ দেন। পরে মৌলভীবাজার জেলার শ্রীমঙ্গলের দক্ষিণ-পূর্বে কমলগঞ্জ উপজেলার ধলই নামক স্থানে মুক্তিবাহিনীতে যোগ দেন। ২৮ অক্টোবর রাতে ধলইয়ের যুদ্ধে অসীম সাহসিকতা প্রদর্শন করে এলএমজি চালনারত অবস্থায় শত্রম্নপক্ষের দু'জনকে ঘায়েল করেন। তিনিও নিজেও শত্রম্নর গুলিতে শাহাদৎ বরণ করেন। পরে এই বীর সৈনিকের লাশ ধলই থেকে ৩০ কিলোমিটার দক্ষিণে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের অন্তর্গত আমবাসা নামক স্থানে একটি মসজিদের পাশে সমাহিত করা হয়। মুক্তিযুদ্ধে বীরোচিত ভূমিকার আত্মত্যাগের স্বীকৃতিস্বরূপ তাকে সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় সম্মাননা বীরশ্রেষ্ঠ খেতাবে ভূষিত করা হয়। সুদীর্ঘ ৩৬ বছর পর ২০০৭ সালের ১১ ডিসেম্বর হামিদুরের দেহাবশেষ বাংলাদেশে নিয়ে এসে ঢাকার শহীদ বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে সমাহিত করে বাংলাদেশ সরকার।'

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে