অন্তিম শয়ানে আবদুল কাদের

প্রকাশ | ২৭ ডিসেম্বর ২০২০, ০০:০০ | আপডেট: ২৭ ডিসেম্বর ২০২০, ০০:১০

যাযাদি রিপোর্ট
চিরবিদায়। তবুও ছাড়তে চায় না মন। প্রিয়জনকে শেষবিদায় জানানোর বেদনা চিরজীবন লুকিয়ে থাকে অন্তরজুড়ে। চোখের জলে সে বেদনা ঝরে পড়ে নিরন্তর। শেষযাত্রায় অভিনেতা আবদুল কাদেরের নাতনি ছোট্ট লুবাবার অশ্রম্নসিক্ত হৃদয়ছোঁয়া স্পর্শ বলে দিচ্ছে দাদাকে হারিয়ে কতটা বেদনাহত সে -যাযাদি

ক্যানসারের কাছে হার মেনে চলেই গেলেন মঞ্চ, টিভি ও চলচ্চিত্রের বরেণ্য অভিনেতা আবদুল কাদের। শনিবার সকাল ৮টা ২০ মিনিটে রাজধানীর এভারকেয়ার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি (ইন্নালিলস্নাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)। মৃতু্যকালে তার বয়স হয়েছিল ৬৯ বছর। তিনি স্ত্রী খায়রুন্নেসা কাদের এবং এক ছেলে ও এক মেয়ে রেখে গেছেন। শনিবার বেলা দুইটার দিকে মিরপুর ডিওএইচএস সেন্ট্রাল মসজিদে তার প্রথম জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। সেখান থেকে বিকাল ৩টার দিকে তার মরদেহ নিয়ে যাওয়া হয় বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমিতে। প্রথম জানাজা শেষে সহকর্মী ও সর্বস্তরের মানুষের শ্রদ্ধা জানাতেই মরদেহ নিয়ে যওয়া হবে শিল্পকলায়। সেখানে শ্রদ্ধা শেষে অনুষ্ঠিত হয় মরহুমের দ্বিতীয় জানাজা। এরপর তাকে দাফন করা হয় বনানীর কবরস্থানে। আবদুল কাদেরের মৃতু্যতে গভীর শোক প্রকাশ করেছেন রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। আবদুল কাদেরের পরিবার জানায়, শারীরিকভাবে অসুস্থ হলে উন্নত চিকিৎসার জন্য ৮ ডিসেম্বর তাকে চেন্নাইয়ে নেওয়া হয়। সেখানকার হাসপাতালে পরীক্ষার পর ১৫ ডিসেম্বর তার শরীরে ক্যানসার ধরা পড়ে। এরপর চিকিৎসকরা জানান, সারা শরীরে ক্যানসার ছড়িয়ে পড়েছে। তার অবস্থা সংকটাপন্ন। শারীরিক দুর্বলতার কারণে তাকে কেমোথেরাপিও দেওয়া যায়নি। ২০ ডিসেম্বর আবদুল কাদেরকে নিয়ে দেশে ফেরেন স্বজনরা। এরপর দিন তাকে এভারকেয়ার হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। ২১ ডিসেম্বর তার করোনাভাইরাস সংক্রমণ ধরা পড়ে। ২৪ ডিসেম্বর রাত ১২টার দিকে শারীরিক অবস্থা অবনতি হলে চিকিৎসকরা করোনা ইউনিট থেকে তাকে হাসপাতালের আইসিইউতে স্থানান্তর করেন। ১৯৫১ সালে মুন্সীগঞ্জ জেলার টঙ্গিবাড়ী থানার সোনারং গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন আবদুল কাদের। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নেওয়ার পর সিঙ্গাইর কলেজ ও লৌহজং কলেজে শিক্ষকতা শুরু করেন তিনি। পরে বিটপি বিজ্ঞাপনী সংস্থায় এক্সিকিউটিভ হিসেবে যোগ দেন। বিটপি ছাড়ার পর তিনি ৩৫ বছর বাটায় কাজ করেন। ১৯৭২ সালে আন্তঃহল নাট্য প্রতিযোগিতায় চ্যাম্পিয়ন মহসিন হলের নাটক সেলিম আল দীন রচিত ও নাসির উদ্দীন ইউসুফ নির্দেশিত 'জন্ডিস ও বিবিধ বেলুন'-এ অভিনেতা হিসেবে পুরস্কার পেয়েছিলেন আবদুল কাদের। ১৯৭২-৭৪ পরপর ৩ বছর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মহসিন হল ছাত্র সংসদের নাট্যসম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন তিনি। বাংলাদেশ টেলিভিশন (বিটিভি) প্রযোজিত বিশ্ববিদ্যালয় সাধারণ জ্ঞানের অনুষ্ঠান 'বলুন দেখি'তে চ্যাম্পিয়ন দলের অন্যতম সদস্য হিসেবে পুরস্কার পাওয়া আবদুল কাদের ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত ডাকসু নাট্যচক্রের কার্যনির্বাহী পরিষদের সদস্য ছিলেন। ১৯৭৩ সাল থেকে থিয়েটার নাট্যগোষ্ঠীর সদস্য এবং চার বছর যুগ্ম সম্পাদকের ও ছয় বছর সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন তিনি। ১৯৭২ সাল থেকে টেলিভিশন ও ১৯৭৩ সাল থেকে রেডিও নাটকে অভিনয় শুরু হয় তার। টেলিভিশনে আবদুল কাদের অভিনীত প্রথম ধারাবাহিক নাটক 'এসো গল্পের দেশে'। আবদুল কাদের বাংলাদেশ টেলিভিশনের নাট্যশিল্পী ও নাট্যকারদের একমাত্র সংগঠন টেলিভিশন নাট্যশিল্পী ও নাট্যকার সংসদের (টেনাশিনাস) সহসভাপতি ছিলেন। থিয়েটারের প্রায় ৩০টি প্রযোজনার প্রদর্শনীতে অভিনয় করেছেন তিনি। তার উলেস্নখযোগ্য মঞ্চনাটক 'পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায়', 'এখনও ক্রীতদাস', 'তোমরাই', 'স্পর্ধা', 'দুই বোন', 'মেরাজ ফকিরের মা'। ১৯৮২ সালে দক্ষিণ কোরিয়ার সিউলে অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক নাট্য উৎসবে বাংলাদেশের নাটক থিয়েটারের 'পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায়'- এ অভিনয় করেন তিনি। এছাড়া দেশের বাইরে জাপান, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, কলকাতা, দিলিস্ন, দুবাই এবং দেশের প্রায় সব কটি জেলায় আমন্ত্রিত হয়ে অভিনয় করেছেন গুণী এ অভিনেতা। টেলিভিশনে অসংখ্য জনপ্রিয় নাটকে অভিনয় করেছেন কাদের। এর মধ্যে 'কোথাও কেউ নেই', 'মাটির কোলে', 'নক্ষত্রের রাত', 'শীর্ষবিন্দু', 'সবুজ সাথী', 'তিন টেক্কা', 'যুবরাজ', 'আগুন লাগা সন্ধ্যা', 'প্যাকেজ সংবাদ', 'সবুজ ছায়া', 'কুসুম কুসুম ভালোবাসা', 'নীতু তোমাকে ভালোবাসি', 'আমাদের ছোট নদী', 'দুলাভাই', 'অজ্ঞান পার্টি', 'মোবারকের ঈদ', 'বহুরূপী', 'এই মেকআপ', 'ঢুলি বাড়ি', 'সাত গোয়েন্দা', 'এক জনমে', 'জল পড়ে পাতা নড়ে', 'খান বাহাদুরের তিন ছেলে' ইত্যাদি। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের 'ডাকঘর' নাটকে অমল চরিত্রে অভিনয়ের মাধ্যমে তার প্রথম নাটকে অভিনয়। আবদুল কাদের মঞ্চ ও ছোট পর্দার পাশাপাশি অভিনয় করেছেন সিনেমায়ও। অভিনয়ের পাশাপাশি বেশ কিছু বিজ্ঞাপনের কাজও করেছেন তুমুল জনপ্রিয় এই অভিনেতা।