শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১
সুচিত্রা সেনের পৈতৃক ভিটায় সংগ্রহশালা

মহানায়িকার স্মৃতি জাগানিয়া নিদর্শনে মুগ্ধ দর্শনার্থীরা

সুচিত্রা সেন বাংলা চলচ্চিত্রের এক কিংবদন্তি। অনন্য সৌন্দর্যের সঙ্গে ভুবনভোলানো আবেদনময় মিষ্টি হাসি আর অসাধারণ অভিনয়শৈলীর কারণে চিরকালীন বাঙালি সুচিত্রা সেন প্রজন্ম থেকে প্রজন্মের মন জয় করেছেন। কাল ১৭ জানুয়ারি সুচিত্রা সেনের সপ্তম প্রয়াণ দিবস। এ দিনটিকে সামনে রেখে সুচিত্রা সেনকে নিয়ে এই বিশেষ আয়োজন তৈরি করেছেন আমাদের পাবনা প্রতিনিধি
আরিফ আহমেদ সিদ্দিকী
  ১৬ জানুয়ারি ২০২১, ০০:০০
সুচিত্রা সেনের মু্যরাল

সুচিত্রা সেন- নায়িকাদের নায়িকা, মহানায়িকা। প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম আজ অবধি বাংলার মডেল কিংবা নায়িকারা সুচিত্রা সেনকে আইডল করে তার মতো শাড়ি পরেন, হাতাকাটা বস্নাউজ পরেন, চোখে কাজল টানেন, চুলে কখনো বেণী বাঁধেন কখনোবা খোঁপা সাজান কিংবা ঘাড় বাঁকিয়ে রোমান্টিক চাহনি দেন। একজন সত্যিকারের সুপারস্টার জানতেন, জনপ্রিয়তার শীর্ষে থাকতেই লাগাম টেনে ধরতে হয়, কখন থামতে হয়। সুচিত্রা সেনই জনপ্রিয়তার চূড়ায় যাওয়া সেই কিংবদন্তি নায়িকা, যিনি কেবল নিজের লাগাম টেনেই ধরেননি, অনন্ত যৌবনা ও তুমুল সম্মোহনী রূপের সৌন্দর্য দর্শক হৃদয়-মনের গভীরে গেঁথে দিয়ে নিজেকে লোকচক্ষুর আড়ালে নিয়েছেন। সুচিত্রা সেন সারাজীবন নিজের আশপাশে এক অদ্ভুত দুর্ভেদ্য দেয়াল তুলে রাখতে পেরেছিলেন- তা ভেদ করার কথা শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত কেউ ভাবতে পারেনি। এমন অসম্ভব সাহসী, বেপরোয়া এবং দৃঢ়চেতা একজন সেলিব্রিটি সে যুগে বিরল ছিল। শুধু সে যুগে কেন? যুগে যুগে তার মতো সময়ের চেয়ে এগিয়ে থাকা, দাপুটে অভিনেত্রীর জুড়ি মেলা ভার। শত প্রতিকূলতার মধ্যেও নিজ ব্যক্তিত্বের বলে বলীয়ান ক'জন হতে পারে? তাকে নিয়ে যত না আলোচনা, যত না প্রশংসা, যত না বিশ্লেষণ, তার চেয়ে বেশি মিথ হয়ে ঘুরে-ফিরে আসে; যেন অনন্তকালের চিরযৌবনা রূপবতী সুচিত্রা সেনের মৃতু্য নেই।

ভারত উপমহাদেশের বাংলা চলচ্চিত্রের কিংবদন্তি সুচিত্রা সেনের পৈতৃক বাড়িটি দীর্ঘদিন পর স্বাধীনতাবিরোধী চক্রের দখল থেকে উদ্ধার করা হয়। পরবর্তীতে পাবনা জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে এবং সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের সহযোগিতায় ওই বাড়িটি 'কিংবদন্তি মহানায়িকা সুচিত্রা সেন স্মৃতি সংগ্রহশালা' করা হয়েছে।

পাবনা জেলা শহরের পৌর এলাকার গোপালপুর মহলস্নার হেমসাগর লেনে সুচিত্রা সেনের পৈতৃক বাড়ি। এ বাড়িতেই তার জন্ম। বাবা করুণাময় দাশগুপ্ত ছিলেন স্থানীয় মিউনিসিপ্যালিটির স্যানিটারি ইন্সপেক্টর। বাবা-মায়ের পঞ্চম সন্তান ছিলেন সুচিত্রা। নবম শ্রেণিতে পড়াবস্থায় ১৯৪৭ সালে কলকাতার বিশিষ্ট বাঙালি শিল্পপতি আদিনাথ সেনের ছেলে মেরিন ইঞ্জিনিয়ার দীবানাথ সেনের সঙ্গে তার বিয়ে হয়। তাদের ঘরে একমাত্র সন্তান মুনমুন সেন। তার স্মৃতির প্রতি সম্মান জানিয়ে ওই বাড়িতে গড়ে তোলা হয়েছে 'কিংবদন্তি মহানায়িকা সুচিত্রা সেন স্মৃতি সংগ্রহশালা'।

সুচিত্রা সেন সম্পর্কে জানাতে ও তার স্মৃতি রক্ষার্থে জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে গড়ে তোলা সংগ্রহশালায় মহানায়িকার বিভিন্ন ছবি, জীবনের বিভিন্ন তথ্যসংবলিত বিলবোর্ড, পুস্তিকা, সিনেমার পোস্টারসহ রয়েছে নানা নিদর্শন। বাড়ির আঙিনায় সম্প্রতি স্থাপন করা হয়েছে সুচিত্রার একটি মু্যরাল। প্রধান ফটক দিয়ে ঢুকতেই চোখে পড়ে তার বিশালাকৃতির এ প্রতিকৃতি। বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করতেই চোখে পড়ে দৃষ্টিনন্দন সব ফুলের গাছ। বাড়িজুড়ে ছড়িয়ে আছে মহানায়িকার স্মৃতি। আর তাতে মুগ্ধ হচ্ছেন আগত দর্শনার্থীরা। সুচিত্রার পৈতৃক এ বাড়িটিকে পূর্ণাঙ্গ আর্কাইভে পরিণত করার দাবি পাবনাবাসীর।

সুচিত্রা সেন সম্পর্কে জানতে প্রতিদিন দেশ-বিদেশের অসংখ্য মানুষ তার এই পৈতৃক বাড়িতে ভিড় জমান। অন্য জেলা থেকে পাবনায় আসা ভ্রমণপিপাসুরা তার বাড়ি দেখতে এসে নিজেদের মুগ্ধতা প্রকাশ করেন। আর এ প্রজন্মের তরুণীরা তো সুচিত্রাকে ভাবেন নিজেদের আইডল হিসেবে।

সোমবার সাপ্তাহিক ছুটি ছাড়া প্রতিদিন ১০টা থেকে ৫টা পর্যন্ত খোলা থাকে সংগ্রহশালা। এখানে প্রতিদিন ২০-২৫ জনের বেশি দর্শনার্থী আসেন। দেশের বিভিন্ন অঞ্চল ছাড়াও কলকাতা থেকেও প্রায়ই দর্শনার্থীরা আসেন। তারা সংগ্রহশালাটি দেখে মুগ্ধ হন, আনন্দিত হন। দর্শনার্থীদের অভিমত, সংগ্রহশালাটি ঘুরে দেখে। বাংলা চলচ্চিত্রের মহানায়িকা সম্পর্কে অনেক কিছু জানতে পেরেছেন। তাদের দাবি, পাবনাবাসীর আবেগের সঙ্গে জড়িয়ে আছেন সুচিত্রা সেন। তাকে সরাসরি দেখার সুযোগ হয়নি। বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় তার সম্পর্কে জেনেছেন।

তথ্যমতে, ১৯৫২ সালে তিনি চলচ্চিত্র জগতে প্রথম পা রাখেন। প্রথম ছবি করেন 'শেষ কোথায়'। তবে ছবিটি আর মুক্তি পায়নি। এরপর ১৯৫৩ সালে মহানায়ক উত্তম কুমারের সঙ্গে 'সাড়ে চুয়াত্তর' ছবি করে সাড়া ফেলে দেন চলচ্চিত্রাঙ্গনে। সুচিত্রা সেন বাংলার পাশাপাশি হিন্দি ছবিতেও অভিনয় করেছেন। তার অভিনীত প্রথম হিন্দি ছবি দেবদাস (১৯৫৫)। সুচিত্রা সেন ১৯৭৮ সালে প্রণয় পাশা ছবি করার পর লোকচক্ষুর অন্তরালে চলে যান। এরপর থেকে তিনি আর জনসমক্ষে আসেননি। মাঝে একবার ভোটার পরিচয়পত্রে নাম অন্তর্ভুক্ত করতে ছবি তুলতে ভোটকেন্দ্রে যান। সুচিত্রা সেন ছিলেন রামকৃষ্ণ পরমহংসদেবের ভক্ত। একবার তিনি গোপনে কলকাতা বইমেলায় গিয়েছিলেন। সে সময়

বলিউড-টালিউডের বহু পরিচালক সুচিত্রা সেনকে নিয়ে ছবি করতে চাইলেও তিনি এতে সম্মত হননি। এমনকি দেশ-বিদেশের কোনো পরিচালক বা অভিনেতা বা অভিনেত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎও দেননি তিনি। সেই থেকে তিনি লোকচক্ষুর অন্তরালেই থেকে যান। যদিও তার বাসভবনে তিনি কেবল

কথা বলেছেন, তার একমাত্র মেয়ে মুনমুন সেন এবং দুই নাতনি রিয়া ও রাইমার সঙ্গে।

পুরস্কার ও সম্মাননা : সুচিত্রা সেন ১৯৬৩ সালে মস্কো আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে সাত পাকে বাঁধা ছবিতে অভিনয়ের জন্য সেরা অভিনেত্রীর পুরস্কার পান। ১৯৭২ সালে রাষ্ট্রীয় সম্মাননা পদ্মশ্রী পান। ২০১২ সালে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের বাংলাবিভূষণ সম্মাননা দেওয়া হয় তাকে। ২০০৫ সালে সুচিত্রা সেনকে ভারতের চলচ্চিত্র অঙ্গনের সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় সম্মান দাদা সাহেব ফালকে পুরস্কার দেওয়ার প্রস্তাব করা হলে সুচিত্রা সেন দিলিস্নতে গিয়ে ওই সম্মান গ্রহণ করতে অপারগতা প্রকাশ করেন।

সুচিত্রা সেনের ছবি : ১৯৫২ থেকে ১৯৭৮ অর্থাৎ ২৬ বছরে তিনি ৬২টি ছবিতে অভিনয় করেন। তার অভিনীত উলেস্নখযোগ্য ছবির মধ্যে রয়েছে : অগ্নি পরীক্ষা (১৯৫৪), গৃহ প্রবেশ (১৯৫৪), ঢুলি (১৯৫৪), মরণের পরে (১৯৫৪), দেবদাস (১৯৫৫-হিন্দি), শাপমোচন (১৯৫৫), সবার উপরে (১৯৫৫), মেঝ বউ (১৯৫৫), ভালোবাসা (১৯৫৫), সাগরিকা (১৯৫৬), ত্রিযামা (১৯৫৬), শিল্পী (১৯৫৬), একটি রাত (১৯৫৬), হারানো সুর (১৯৫৭), পথে হল দেরি (১৯৫৭), জীবন তৃষ্ণা (১৯৫৭), চন্দ্রনাথ (১৯৫৭), মুশাফির (১৯৫৭-হিন্দি), রাজলক্ষ্ণী ও শ্রীকান্ত (১৯৫৮), ইন্দ্রানী (১৯৫৮), দ্বীপ জ্বেলে যাই (১৯৫৮), চাওয়া পাওয়া (১৯৫৯), হসপিটাল (১৯৬০), বোম্বাই কা বাবু (১৯৬০-হিন্দি), সপ্তপদী (১৯৬১), সাত পাকে বাঁধা (১৯৬৩), উত্তর ফাল্‌গুনী (১৯৬৩), মমতা (১৯৬৬), গৃহদাহ (১৯৬৭), কমললতা (১৯৬৯), মেঘ কালো (১৯৭০), ফরিয়াদ (১৯৭১), আলো আমার আলো (১৯৭২), হার মানা হার (১৯৭২), দেবী চৌধুরাণী (১৯৭৪), শ্রাবণ সন্ধ্যা (১৯৭৪), প্রিয় বান্ধবী (১৯৭৫), আঁধি (১৯৭৫-হিন্দি), দত্তা (১৯৭৬) এবং সর্বশেষ প্রণয়পাশা (১৯৭৮)।

পৈতৃক বাড়ি উদ্ধার : ১৯৪৭ সালে সুচিত্রা সেনের বিয়ে হয়ে যায়। ১৯৫১ সালে তার বাবা করুণাময় অবসরে যান। ১৯৬০ সালে করুণাময় ০.২১ একর জায়গার ওপর বাড়িটি জেলা প্রশাসনের কাছে ভাড়া দিয়ে পরিবার নিয়ে কলকাতায় চলে যান। এ সময় প্রশাসন বাড়িটি সরকারি ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের বাসভবন হিসেবে ব্যবহার করেন। দীর্ঘদিন বাড়িটি সরকারি হেফাজতেই ছিল। ১৯৮৭ সালে পাবনা জেলা প্রশাসন বাড়িটি ইমাম গাজ্জালি ইনস্টিটিউট নামে একটি বেসরকারি গার্লস স্কুল এবং কলেজকে লিজ দেয়। স্বাধীনতাবিরোধী জামায়াতে ইসলামীর একটি ট্রাস্টি বোর্ড স্কুল ও কলেজটি পরিচালনা করত। স্কুলটি পরিচালনার সময় বাড়ির আঙিনায় থাকা নানা ফুল ও বিভিন্ন দামি গাছ সব কেটে সাবাড় করে খোলা অংশে জুড়ে কয়েকটি টিনের ঘর তোলা হয়। ছাদ ভেঙে টিনের চাল লাগানো হয়। বাড়ির প্রবেশ পথ বন্ধ করে দোকান ঘর করা হয়। ফলে প্রধান সড়ক থেকে আড়াল হয়ে গিয়েছিল বাড়িটি। জামায়াতে ইসলামীর হাত থেকে বাড়িটি উদ্ধারে আন্দোলন গড়ে তোলেন পাবনার সাংস্কৃতিক কর্মী, রাজনীতিবিদ ও গণমাধ্যমকর্মীরা। পাবনায় গঠিত সুচিত্রা সেন স্মৃতি সংরক্ষণ পরিষদ বাড়িটি দখলমুক্ত করতে সভা, সমাবেশ, মানববন্ধন, সংবাদ সম্মেলন, চলচ্চিত্র উৎসবসহ নানা কর্মসূচি পালন করেছে। একপর্যায়ে বাড়িটি দখলমুক্ত করতে আদালতের আশ্রয় নেওয়া হয়। দীর্ঘ আইনি লড়াই শেষে ২০১৪ সালের ১৬ জুলাই হাইকোর্ট বাড়িটি দখল মুক্ত করে এখানে সুচিত্রা সেনের স্মৃতি সংগ্রহশালা গড়ে তুলতে সরকারকে নির্দেশ দেন। যদিও বাড়িটি হাতছাড়া না করতে জামায়াতে ইসলামী নানা কৌশল অবলম্বন করেছে।

সংগ্রহশালা হিসেবে যাত্রা :যুদ্ধাপরাধের অভিযুক্ত রাজনৈতিক সংগঠন জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে আইনি লড়াই শেষে ২০১৪ সালের ১৬ জুলাই বাড়িটি দখল মুক্ত হয়। ২০১৭ সালের এপ্রিলের মাঝামাঝি সময়ে জেলা প্রশাসন স্বল্প পরিসরে মহানায়িকা সুচিত্রা সেন স্মৃতি সংগ্রহশালা হিসেবে বাড়িটি উন্মুক্ত করে দেয় দর্শনার্থীদের জন্য। শুরুতেই বিভিন্ন সময়ে তোলা মহানায়িকার ৪৬টি ছবি স্থান পায়, যা বর্তমানে অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে।

মহানায়িকার মহাপ্রয়াণ : দীর্ঘদিন অন্তরীণ থাকায় সুচিত্রা সেনের শরীরে নানা রোগ বাসা বেঁধেছিল। কিন্তু কোনো কিছুরই তোয়াক্কা করেননি। হঠাৎ নিজের লাগাম টেনে ধরে এই চিরআবেদনময়ী সৌন্দর্যের প্রতীক। প্রয়াণের আগে ফুসফুসে সংক্রমণ নিয়ে দক্ষিণ কলকাতার বেসরকারি একটি হাসপাতাল বেলভিউতে ২০১৪ সালের ১৭ জানুয়ারি চিকিৎসাধীন অবস্থায় না ফেরার দেশে চলে যান মহানায়িকা সুচিত্রা সেন।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে