শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১
অনন্য অর্জন

বিশ্বের ৪১ 'জলবায়ু সংগ্রামীর' তালিকায় একজন রেজোয়ান

নাজমুল হাসান, গুরুদাসপুর (নাটোর)
  ২৫ জানুয়ারি ২০২১, ০০:০০
'নৌকা স্কুলের' মডেল হাতে নাটোরের গুরুদাসপুরের মোহাম্মদ রেজোয়ান -যাযাদি

চলনবিল অধু্যষিত বন্যাকবলিত এলাকা নাটোরের গুরুদাসপুর উপজেলা। বর্ষা মৌসুমে চলনবিল অঞ্চলের ছেলেমেয়েদের শিক্ষাব্যবস্থা নিশ্চিত করেছিলেন গুরুদাসপুরের সন্তান মোহাম্মদ রেজোয়ান। বন্যাকবলিত এলাকার মানুষের দুর্ভোগের কথা চিন্তা করে তিনি উদ্ভাবন করেন 'নৌকা স্কুল'। এ উদ্ভাবনের ফলে দেশ-বিদেশের নানা পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন এই স্থপতি। তবে এবার তার এই উদ্ভাবনের গল্প যোগ হয়েছে যুক্তরাজ্যের স্বনামধন্য পেঙ্গুইনর্ যানডম হাউস থেকে প্রকাশিত একটি বইয়ে। গত ২শ' বছরে বিশ্বে পরিবেশ রক্ষার সংগ্রামে অংশ নেওয়া ৪১ জনকে নিয়ে প্রকাশিত 'ক্লাইমেট রেবলস' নামের বইটির লেখক বেন লারউল।

জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ে সচেতনতা বাড়ানোর আন্দোলনে নেতৃত্বে থাকা সুইডিশ কিশোরী গ্রেটা থুনবার্গ, গ্রিনবেল্ট মুভমেন্টের প্রতিষ্ঠাতা ও ২০০৪ সালে শান্তিতে নোবেল পুরস্কার বিজয়ী ওয়াং গারিমাথাই, বিশ্বের অন্যতম পরিবেশবাদী সংগঠন গ্রিনপিসের প্রতিষ্ঠাতা, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল পার্কের জনক, উনিশ শতকে বনজ সম্পদ রক্ষায় আন্দোলনকারী জন মিওর এবং ৭৪টি দেশের পরিবেশবাদী সংগঠনের আন্তর্জাতিক নেটওয়ার্ক ফ্রেন্ডস অব দ্য আর্থ ইন্টারন্যাশনালের সঙ্গে বাংলাদেশের নৌকা স্কুলের উদ্ভাবক মোহাম্মদ রেজোয়ান 'ক্লাইমেট রেবল' হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছেন। নাটোরের গুরুদাসপুর উপজেলার সন্তান রেজোয়ানের উদ্ভাবিত নৌকা স্কুল বাংলাদেশসহ বিশ্বের আটটি দেশের বন্যাদুর্গত শিশুদের শিক্ষা কার্যক্রমে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে।

বিশ্বের অন্যতম খ্যাতনামা প্রকাশনা সংস্থা পেঙ্গুইনর্ যানডম হাউস গত এপ্রিলে 'ক্লাইমেট রেবলস' বইটি প্রথম প্রকাশ করে। লেখক বেন লারউল বইটির শুরুতে বলেছেন, 'বইয়ের গল্পগুলো প্রমাণ করে যে একজন ব্যক্তির ছোট ছোট প্রচেষ্টাগুলো ধীরে ধীরে বড়, শক্তিশালী বিশ্ব-পরিবর্তনের উদ্যোগে পরিণত হতে পারে।' নৌকা স্কুল সম্পর্কে লেখক তার বইটিতে বলেছেন, 'বন্যা বাংলাদেশের একটি বড় সমস্যা এবং এটা মানুষের জীবন আরও কঠিন করে তুলেছে। শিশুরা যাতে নিয়মিত লেখাপড়া চালিয়ে যেতে পারে, তা নিশ্চিত করার জন্য মোহাম্মদ রেজোয়ান একটি চমৎকার ধারণা দিয়েছেন। তিনি নৌকাকে স্কুলের শ্রেণিকক্ষ হিসেবে ব্যবহার করেছেন। তার এই উদ্যোগ সফল। ফলে তার দেশে এখন নৌকা স্কুল ছাড়াও ভাসমান গ্রন্থাগার, স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্র ও ভাসমান মাঠ করা হয়েছে।'

বইটিতে উঠে এসেছে রেজোয়ানের প্রতিষ্ঠিত অলাভজনক স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন সিধুলাই স্বনির্ভর সংস্থার কথা। বন্যাপ্রবণ এলাকায় বিশেষ করে যেখানে শিশুদের শিক্ষার সুযোগ নেই, সংস্থাটি সেখানে শিক্ষা সুবিধা নিশ্চিতকরণে অনুকরণীয় ভূমিকা পালন করছে। রেজোয়ান ২০০২ সালে চলনবিলে ভাসমান স্কুল প্রবর্তন করেন এবং অন্যান্য সংস্থা

তারই নৌকা স্কুলের অনুকরণে ২০১০ সাল-পরবর্তী সময়ে নৌকায় শিক্ষা কার্যক্রম শুরু করে। তার নৌকা স্কুলের ধারণাটি জাতিসংঘের ফান্ডস অ্যান্ড প্রোগ্রামস (ইউনিসেফ, ইউএনইপি ও ইউএনডিপি) থেকে উদ্ভাবনের স্বীকৃতি পেয়েছে। বর্তমানে বিশ্বের আটটি দেশে সিধুলাই স্বনির্ভর সংস্থার মতো ভাসমান স্কুল কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে।

২০১৯ সালে 'আর্থ হিরোজ' নামের একটি গ্রন্থে রেজোয়ানকে বিশ্বের ২০ জন বিশ্বনেতার একজন হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। তার ভাসমান স্কুলকে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, জাপানসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শ্রেণির পাঠ্যসূচিতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। তার ভাসমান স্কুলের নকশা 'ডিজাইন উইথ দ্য আদার ৯০%' প্রদর্শনীতে প্রদর্শিত হয়। এটি আয়োজন করেছিল যুক্তরাষ্ট্রের স্মিথ সোনিয়ানস্কুপার-হিউইট, ন্যাশনাল ডিজাইন মিউজিয়াম এবং বিল অ্যান্ড মেলিন্ডা গেটস ফাউন্ডেশন। এছাড়া তার এই নকশা সুইজারল্যান্ড ও ফ্রান্সে 'বেঙ্গল স্ট্রিম' স্থাপত্যবিষয়ক প্রদর্শনীতে প্রদর্শিত হয়।

মোহাম্মদ রেজোয়ান বইটিতে তাকে 'ক্লাইমেট রেবল' হিসেবে আখ্যায়িত করায় লেখকের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, 'আমি জনগণকে বন্যা ও ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড়ের মধ্যে সংগ্রাম করতে দেখেছি, সবসময় তারা নিজেদের দুর্যোগের আগের অবস্থায় নিয়ে এসে নতুন করে জীবন শুরু করেছে। তাদের এই সংগ্রামী বৈশিষ্ট্য আমাকে শিশুদের জন্য ভাসমান স্কুলের নকশা করতে অনুপ্রাণিত করেছে। এখনকার সময়ে বন্যা আরও অনিশ্চিত। আমাদের নৌকা স্কুল এই পরিবেশগত সমস্যার একটি সমাধান, তবে এখনো আরও অনেক কিছুই করার আছে।'

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে