রোহিঙ্গা সংকট অবসানে প্রধানমন্ত্রীর ৩ প্রস্তাব

প্রকাশ | ২৫ সেপ্টেম্বর ২০১৮, ০০:০০

যাযাদি ডেস্ক
এক বছরের বেশি সময় ধরে চলমান রোহিঙ্গা সংকট অবসানে তিনটি প্রস্তাব বিশ্বনেতাদের সামনে তুলে ধরেছেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এই সংকটের ভুক্তভোগী দেশের সরকার প্রধান হিসেবে সোমবার নিউইয়কের্ জাতিসংঘ সদর দপ্তরে শরণাথীর্ সংকট নিয়ে উচ্চ পযাের্য়র এক বৈঠকে প্রস্তাবগুলো দেন তিনি। জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে যোগ দিতে যুক্তরাষ্ট্রে পৌঁছনোর পরদিনই এই বৈঠকে যোগ দিলেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী। সুপারিশগুলো প্রথমত, মিয়ানমারকে রোহিঙ্গাদের প্রতি বৈষম্যমূলক আইন ও নীতি বাতিল এবং বৈষম্যমূলক আচরণ বন্ধ করতে হবে। এছাড়া রোহিঙ্গাদের জোরপূবর্ক স্থানান্তরিত করার প্রকৃত কারণগুলো খুঁজে বের করতে হবে। দ্বিতীয়ত, মিয়ানমারের রোহিঙ্গাদের নাগরিক সুরক্ষা ও অধিকার নিশ্চিত করে একটি সহায়ক পরিবেশ তৈরি করতে হবে। প্রয়োজনে একটি ‘সেইফ জোন (নিরাপদ অঞ্চল)’ প্রতিষ্ঠা করতে হবে। তৃতীয়ত, জাতিসংঘ মানবাধিকার কাউন্সিলের ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং মিশনের সুপারিশের আলোকে ন্যায়বিচার ও জবাবদিহি নিশ্চিত করে মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের নৃশংসতার হাত থেকে বঁাচাতে হবে। মিয়ানমারের রাখাইন প্রদেশে সেনা অভিযানে নিপীড়নের মুখে গত বছরের আগস্ট থেকে ১১ লাখের বেশি রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে। এই নিপীড়নকে ‘জাতিগত নিমূর্ল অভিযান’ হিসেবে দেখছে জাতিসংঘও। আন্তজাির্তক সম্প্রদায়ের সমালোচনার মুখে মিয়ানমার এই শরণাথীের্দর ফেরত নিতে বাংলাদেশের সঙ্গে চুক্তি করলেও প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া শুরু করার ক্ষেত্রে গড়িমসি দেখাচ্ছে। আন্তজাির্তক সম্প্রদায় এই রোহিঙ্গাদের ফেরত নেয়ার পাশাপাশি নিজ দেশে তাদের নিরাপত্তার সঙ্গে বসবাস নিশ্চিতের ওপর জোর দিচ্ছে; যদিও মিয়ানমার এই মুসলিম জনগোষ্ঠীকে তাদের নাগরিক হিসেবে মানতেই নারাজ। প্রত্যাবাসনের পাশাপাশি রোহিঙ্গা ‘গণহত্যা’র জন্য মিয়ানমারের শীষর্ সেনা কমর্কতাের্দর বিচারের সুপারিশ করেছে জাতিসংঘ ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং মিশন, যার কড়া প্রতিক্রিয়াও এসেছে দেশটির সেনাপ্রধানের কাছ থেকে। এই পরিস্থিতিতে জাতিসংঘ শরণাথীির্বষয়ক হাইকমিশানার ফিলিপ্পো গ্র্যান্ডির সভাপতিত্বে সোমবারের বৈঠকে সংকট অবসানে তিন প্রস্তাব তুলে ধরা হলো বাংলাদেশের পক্ষ থেকে। শেখ হাসিনা বলেন, ‘মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে যেখানে তারা শতাব্দী ধরে বসবাস করত, সেখান থেকে তাদের জোরপূবর্ক বাড়ি থেকে বিতাড়িত করা হয়েছে।’ মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে ১১ লাখ রোহিঙ্গাকে বাংলাদেশে আশ্রয় দিলেও ভিন্ন দেশে এই নাগরিকদের চাহিদা মেটাতে গিয়ে চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হওয়ার কথাও আন্তজাির্তক সম্প্রদায়কে বলেন তিনি। ‘মিয়ানমারের আরাকানের এই বিপুল সংখ্যক নাগরিকের স্থান দেয়ার বিরূপ প্রভাব আমাদের সমাজ, পরিবেশ ও অথর্নীতির ওপর পড়েছে।’ শেখ হাসিনা বলেন, ‘একটি দায়িত্বশীল সরকার হিসেবে আমরা আমাদের সীমানা খুলে দিয়েছি এবং জোরপূবর্ক স্থানান্তরিত রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিয়েছি। আমরা কেবল তাদের জীবনই বঁাচাইনি, আমরা অঞ্চলের স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করেছি। ‘আমরা চাই রোহিঙ্গারা নিরাপত্তা ও মযার্দা নিয়ে তাদের মূল ভূমিতে ফিরে যাক।’ রোহিঙ্গাদের সাময়িকভাবে ভাসান চরে স্থানান্তরের পরিকল্পনা তুলে ধরে তিনি বলেন, ‘তাদের প্রত্যাবতর্ন না হওয়ায় আমরা তাদের মৌলিক চাহিদা মেটানোর চেষ্টা করছি। ‘ভূমির স্বল্পতা এবং সামাজিক-সাংস্কৃতিক ও পরিবেশের ওপর প্রভাবের কারণে আমরা তাদের ভাসান চর নামে একটি নতুন দ্বীপে স্থানান্তরিত করতে যাচ্ছি। সেখানে তাদের আরও ভালো জীবনযাত্রা নিশ্চিত হবে।’ রোহিঙ্গাদের সাহায্যে জাতিসংঘসহ বিভিন্ন আন্তজাির্তক সংস্থাগুলোর এগিয়ে আসার প্রশংসাও করেন প্রধানমন্ত্রী। তিনি একই সঙ্গে বলেন, ‘দুঃখজনক বিষয় হলো, জাতিসংঘের ২০১৮ সালের জয়েন্ট রেসপন্স প্লান বাস্তবায়নের জন্য ৯৫০ মিলিয়ন মাকির্ন ডলার দরকার হলেও মাত্র ৩৩ শতাংশ তহবিল নিশ্চিত করা হয়েছে।’ রোহিঙ্গাসহ অন্যান্য আক্রান্ত জনগোষ্ঠীর জন্য মানবিক সাহায্য ও সহযোগিতা নিশ্চিত করতে আন্তজাির্তক সম্প্রদায়কে আরও দায়িত্বশীল মনোভাব দেখাতে হবে। শেখ হাসিনা বলেন, ‘উন্নয়নশীল দেশগুলোকেই এই ধরনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হচ্ছে। উন্নয়নশীল দেশগুলো মানবতার ডাকে সাড়া দিয়েই তা করে।’ উন্নয়নশীল দেশগুলোর এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় বিশ্বনেতাদের রাজনৈতিক সদিচ্ছা ও প্রতিশ্রææতি নিয়ে এগিয়ে আসার আহŸানও জানান তিনি। ‘বিশ্বকে অবশ্যই ভুলে গেলে চলবে না যে, প্রত্যেক উদ্বাস্তু তার নিজের দেশে নিরাপদে ফেরত চায়। মিয়ানমার থেকে উৎখাত হওয়া মানুষগুলোকে নিরাপত্তা ও মযার্দা নিয়ে তাদের ঘরে ফিরে যেতে হবে।’ সোমবার এই বৈঠকের আগে প্রধানমন্ত্রী জাতিসংঘ সদর দপ্তরে যুক্তরাষ্ট্রের স্থায়ী মিশনের আয়োজনে ‘গেøাবাল কল টু অ্যাকশন অন ড্রাগ প্রবলেম’ শীষর্ক একটি উচ্চ পযাের্য়র বৈঠকে যোগ দেন। এই বৈঠকে জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস ও যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পও ছিলেন। এবারের সাধারণ অধিবেশনে শেখ হাসিনা ২৭ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশের পক্ষে তার বক্তব্য তুলে ধরবেন। গতবারের মতো এবারও তার ভাষণে রোহিঙ্গা প্রসঙ্গ গুরুত্ব পাবে বলে জানানো হয়েছে। গতবারের সাধারণ অধিবেশনে তিনি রোহিঙ্গাদের রক্ষায় পঁাচটি প্রস্তাব তুলে ধরে তাতে বিশ্বনেতাদের মনোযোগ আকষর্ণ করেছিলেন।