ভাষা আন্দোলনে 'তমদ্দুন মজলিস'র ভূমিকা অনন্য। ১৯৪৭ সালের ১ সেপ্টেম্বর অর্থাৎ দেশভাগের ১৭ দিন পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞানের তৎকালীন শিক্ষক অধ্যাপক আবুল কাসেমের উদ্যোগে ঢাকার আজিমপুরে তার নিজ বাসায় গঠিত হয় ভাষা আন্দোলনের সূচনাকারী সংগঠন 'তমদ্দুন মজলিস'। সংগঠনের এই 'তমদ্দুন মজলিস' নামটি দিয়েছিলেন নরসিংদীর কৃতী সন্তান অ্যাডভোকেট ফজলুর রহমান ভূঁইয়া। তার বাড়ি নরসিংদীর মনোহরদী উপজেলার লেবুতলা ইউনিয়নের তারাকান্দি গ্রামে।
তমদ্দুন মজলিসের ডাকে ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ বাংলা ভাষার দাবিতে দেশব্যাপী
প্রথম হরতাল কর্মসূচি পালিত হয়। ওই হরতালের অংশ হিসেবে নরসিংদীতে বিক্ষোভ মিছিল ও সংক্ষিপ্ত সমাবেশ হয়েছিল।
ওই সমাবেশের পর নরসিংদীতে ভাষা আন্দোলনের পক্ষে ব্যাপক জনমত গড়ে উঠে। এ সময় একপর্যায়ে নরসিংদী সফরে আসেন মওলানা ভাসানী, শেখ মুজিবুর রহমান ও তৎকালীন এমএলএ আনোয়ার বেগম। তাদের আগমনে নরসিংদীর দত্তপাড়া এলাকার ঈদগাহ মাঠে এক বিশাল জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। নরসিংদীর মোসলেহ উদ্দিন ভূঁইয়া ওই জনসভায় সক্রিয় ভূমিকা রাখেন।
এর আগে, ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট পাকিস্তান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়। নতুন রাষ্ট্র গঠনের পর শাসকচক্র পূর্ব পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের মাতৃভাষা বাংলাকে বাদ দিয়ে সর্বত্র উর্দু ভাষা চালুর ষড়যন্ত্র শুরু করে। কিন্তু এই ষড়যন্ত্র যে হচ্ছে, সেটা আগে থেকেই টের পেয়েছেন পূর্ব পাকিস্তানের মানুষ। এমন পরিস্থিতিতে নবগঠিত পাকিস্তানের ভাষা এবং রাষ্ট্র কাঠামো কেমন হবে, তা নিয়ে দেশ ভাগের দুই মাস আগে (মে-মাসে) ঢাকায় এক ঘরোয়া আলোচনা সভা হয়। রাজনৈতিককর্মী, সাংবাদিক, বুদ্ধিজীবী, ছাত্রনেতা এবং শিক্ষাবিদদের সমন্বয়ে ওই সভা অনুষ্ঠিত হয় এবং সভাটি হয়েছিল নরসিংদীর কৃতীসন্তান রাজিউদ্দিন ভূঁইয়ার দু'তলা বাড়ির হলরুমে। রাজিউদ্দিন ছিলেন একজন বিশিষ্ট সমাজকর্মী, রাজনীতিবিদ এবং জমিদার। এ ছাড়া তার অন্যতম পরিচয় হলো তিনি উপমহাদেশের প্রথম মুসলিম মহিলা চিকিৎসক ও ভাষাসৈনিক অধ্যাপক ডা. জোহরা বেগম কাজীর স্বামী। ওই বৈঠক বা সভায় এই স্বামী-স্ত্রী দুইজনেরই ভূমিকা ছিল অনন্য। অনেকের মতে, ১৯৪৭ সালের ভাষা আন্দোলনের প্রথম বৈঠক ছিল এটি।
'নরসিংদীতে ভাষা আন্দোলন' শীর্ষক গ্রন্থে ফজলুর রহমান ভূইয়া বলেন, 'রাষ্ট্রভাষা-আন্দোলনের মানসিক প্রস্তুতি শুরু হয়েছিল বহু পূর্বে। ১৯৪৭ সালের ১ সেপ্টেম্বর 'তমদ্দুন মজলিস' প্রতিষ্ঠার পর বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবি আন্দোলনের রূপ পরিগ্রহ করে। এই আন্দোলন দিন দিন ব্যাপকতা লাভ করে সাংস্কৃতিক আন্দোলন থেকে রাজনৈতিক আন্দোলনে পরিণত হয়। অনেক ত্যাগ ও সংগ্রামের পর অবশেষে ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রম্নয়ারি রক্তের বিনিময় বাংলা ভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়'।
এদিকে, নরসিংদীতে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার কোনটা-এ নিয়ে বিরোধের নিষ্পত্তি আজও হয়নি। ১৯৫৩ সালে নরসিংদী সরকারি কলেজ প্রাঙ্গণে প্রথম শহীদ মিনার নির্মিত হয়। কিন্তু জেলায় প্রথম হওয়া সত্ত্বেও এখনো পর্যন্ত এটি কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার হিসেবে স্বীকৃতি পায়নি। যদিও শুরু থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত প্রায় অর্ধশতাব্দী কাল এই কলেজ শহীদ মিনারকে অলিখিত 'কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার' হিসেবে ধরে একুশের বিভিন্ন কর্মসূচি পালিত হয়েছে।
২০০৯ সালে নরসিংদীর জেলা প্রশাসক (ডিসি) ছিলেন অমৃত বাড়ৈ। ওই বছরের ফেব্রম্নয়ারি মাসের শুরুতে তিনি নরসিংদী স্টেডিয়ামের উত্তর-পশ্চিম কোণে রাস্তার পাশে নতুন এক শহীদ মিনার নির্মাণ করেন। নির্মাণ শেষে তিনি এর নাম দিয়েছিলেন 'নরসিংদী কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার'। নরসিংদীর সুশীলসমাজের কয়েকজনের পরামর্শে তিনি নরসিংদী সরকারি কলেজের ঐতিহাসিক প্রথম শহীদ মিনারকে বাদ দিয়ে এই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন বলে জানা গেছে। ডিসি অমৃত বাড়ৈর এই 'কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার' নামকরণের সঙ্গে সঙ্গেই প্রতিবাদ করেন স্থানীয় ছাত্রসমাজ। ডিসির এই সিদ্ধান্তকে ইতিহাস বিকৃতি এবং ক্ষমতার অপব্যবহার বলে দাবি করেন নরসিংদী সরকারি কলেজের সব শিক্ষার্থীরা।
ওই সময় নরসিংদী-৫ (রায়পুরা) আসনের সংসদ সদস্য রাজিউদ্দিন আহমেদ রাজু ছিলেন ডাক ও টেলিযোগাযোগমন্ত্রী। ডিসি অমৃত বাড়ৈর মুখে ছাত্রদের বিক্ষোভের শুনে মন্ত্রী এই সমালোচিত নাম বাদ দেওয়ার জন্য ডিসিকে কড়া ভাষায় নির্দেশ দেন। মন্ত্রীর নির্দেশে পরের দিনই সমালোচিত 'কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার' নাম বাতিল করে সেখানে নতুন নামফলক স্থাপন করা হয় এবং নতুন নাম ফলকে নাম দেওয়া হয় নরসিংদী মুসলেহ উদ্দিন ভূইয়া স্টেডিয়াম সংলগ্ন শহীদ মিনার। নরসিংদী জেলা প্রশাসন বর্তমানে এই স্টেডিয়াম সংলগ্ন শহীদ মিনারেই আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উদ্যাপন করেন।
ভাষা আন্দোলনে নরসিংদী ছিল আন্দোলনকারীদের জন্য নিরাপদ স্থান। ঢাকার অদূরবর্তী এলাকা এবং উপযুক্ত পরিবেশ থাকায় এখানে আশ্রয় নিয়েছিলেন তৎকালীন বামপন্থি বিপস্নবী নেতারা। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রম্নয়ারি ঢাকায় পুলিশের গুলিবর্ষণের খবর নরসিংদী পৌঁছলে নরসিংদীবাসী গর্জে উঠে। বিশেষ করে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আন্দোলন-বিক্ষোভ প্রকট আকার ধারণ করে। তখন নরসিংদীর সর্বত্র 'রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই' শ্লোগানে মুখরিত হয়ে উঠে।
অন্যদিকে, নরসিংদীর মাধ্যমিক স্কুলগুলোতে শতভাগ শহীদ মিনার থাকলেও মাদ্রাসা এবং প্রাইমারি স্কুলে শতভাগ নেই। নরসিংদী জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা জানান, নরসিংদীর ছয়টি উপজেলায় মোট ৭৭৩টি প্রাইমারি স্কুল আছে। কিন্তু এসব স্কুলের অধিকাংশগুলোতেই এখনো শহীদ মিনার নির্মাণ হয়নি। তিনি জানান, সব স্কুলে শহীদ মিনার নির্মাণের চেষ্টা চলছে।