শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১
একুশ আমার অহংকার

শহীদ মিনার নির্মাণে উপেক্ষিত নির্দেশনা!

মেহেরপুর
গোলাম মোস্তফা
  ২৩ ফেব্রুয়ারি ২০২১, ০০:০০
মেহেরপুর সরকারি ডিগ্রি কলেজে নির্মিত শহীদ মিনার -যাযাদি

সরকারি নির্দেশনা আছে দেশের প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শহীদ মিনার নির্মাণ করার। কিন্তু মেহেরপুর জেলার অধিকাংশ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেই সেই নির্দেশনা বাস্তবায়ন হয়নি আজও। যে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে শহীদ মিনার আছে, শুধু ফেব্রম্নয়ারি মাস এলেই সেগুলো পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করা হয়। ভাষা আন্দোলনের ফেব্রম্নয়ারি মাস শেষ হলেই শহীদ মিনার চত্বর হয় ওঠে গরু-ছাগলের চারণভূমি।

জেলা প্রশাসনের তথ্যানুযায়ী, জেলায় মোট ৫১৮টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান রয়েছে। এর মধ্যে সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় ৩টি, বেসরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয় ১১৪টি, নিম্ন মাধ্যমিক বিদ্যালয় ১১টি, সরকারি কলেজ ৪টি, বেসরকারি কলেজ ১২টি, কারিগরি শিক্ষাকেন্দ্র ৬টি, কলেজিয়েট স্কুল ৫টি, সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ২৯৬টি, নন-রেজিস্টার্ড প্রাথমিক বিদ্যালয় ৭টি এবং মাদ্রাসা ৬০টি।

সরেজমিনে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বিভিন্ন মাধ্যমিক ও নিম্ন মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের মধ্যে ৪৩টি, মাদ্রাসার মধ্যে ৪টি এবং কলেজের মধ্যে ৬টিতে শহীদ মিনার আছে। বাকি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কোনো শহীদ মিনার নেই। তবে চলতি বছর বেশ কিছু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শহীদ মিনার নির্মাণের কাজ চলছে। এর মধ্যে কিছু কিছু প্রতিষ্ঠান শহীদ মিনারের নির্মাণকাজ প্রায় শেষের পথে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রধান জানান, সরকারি নির্দেশনা অনুযায়ী প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় তাদের শহীদ মিনার নির্মাণ করার ইচ্ছে থাকলেও তা সম্ভব হয়ে উঠছে না। কারণ শহীদ মিনার নির্মাণ করার নিজস্ব পর্যাপ্ত ফান্ড ওইসব প্রতিষ্ঠানের নেই। যদি সরকারিভাবে বরাদ্দ দেওয়া হয় তবে প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শতভাগ শহীদ মিনার নির্মিত হবে বলে তারা মনে করেন।

মেহেরপুর জেলায় কবে কখন প্রথম শহীদ মিনার নির্মিত হয়েছিল, তার কোনো সঠিক তথ্য পাওয়া যায়নি। জেলায় ভাষাসৈনিক হিসেবে দাবি করা দুজনের একজন নজির বিশ্বাস মারা গেছেন এবং ইসমাইল হোসেন অসুস্থতার কারণে কিছুই বলতে পারেননি। তবে তৎকালীন মেহেরপুর সরকারি ডিগ্রি কলেজের ছাত্র এবং তৎকালীন মহাকুমা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক ও বীর মুক্তিযোদ্ধা মেহেদী বিলস্নাহ আল মাহমুদ জানান, ১৯৬২ সালে বেসরকারিভাবে মেহেরপুর ডিগ্রি কলেজ যখন প্রতিষ্ঠিত হয়, তার কয়েক বছর পর ১৯৬৬ সালে ক্যাম্পাসে প্রথম ছোট একটি বেদি নির্মাণ করে, সেখানে শহীদদের শ্রদ্ধা জানানো হতো। পরবর্তীতে ১৯৬৮ সালে তিনিসহ আরও কিছু ছাত্রনেতা সেটা সংস্কার করে সেই বছরই একুশে ফেব্রম্নয়ারি পালন করেন।

এরপর '৬৯ সালের দিকে মেহেরপুর সরকারি বালক ও বালিকা বিদ্যালয় এবং কবি নজরুল শিক্ষা মঞ্জিলে নির্মিত হয় শহীদ মিনার। প্রথম দিকে মেহেরপুর সরকারি ডিগ্রি কলেজে জেলার সর্বস্তরের মানুষ শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতেন। পরবর্তীতে মেহেরপুর পৌরসভা কর্তৃক পৌর ময়দানে ১৯৭৪ সালে বর্তমান শহীদ সামসুজ্জোহা পার্কে নির্মাণ করা হয় কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার। ক্ষমতার পালাবদলে বেশ কয়েকবার শহীদ মিনারটির নির্মাণশৈলী পরিবর্তন করা হয়েছে। বর্তমানে এই শহীদ মিনারেই ভাষা আন্দোলনের শহীদদের শ্রদ্ধা জানানো হয়।

শিক্ষার্থী সজিব হোসেন যায়যায়দিনকে জানান, 'আমাদের মাতৃভাষা বাংলা। ২১শে ফেব্রম্নয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃত। আমরা জানি শুধু দেশেই নয়, পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে শহীদ মিনার আছে। অথচ আমাদের বিদ্যালয়ে কোনো শহীদ মিনার না থাকায় একুশের নানা কর্মসূচি পালনে আমাদের খুব কষ্ট হয়।'

শিক্ষার্থীর অভিভাবক শরিফুল ইসলাম জানান, যে কারণেই হোক মেহেরপুরের অধিকাংশ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেই শহীদ মিনার নেই। আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে শহীদদের তাৎপর্য জানাতে, শেখাতে প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শহীদ মিনার তৈরি করা জরুরি।

মেহেরপুর ছহিউদ্দিন ডিগ্রি কলেজের সহকারী অধ্যাপক মাসুদ রেজা বলেন, প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শহীদ মিনার নির্মাণে সরকারিভাবে কঠোর নির্দেশনার প্রয়োজন।

গাংনী ডিগ্রি কলেজের সহকারী অধ্যাপক এনামূল আযীম বলেন, জেলায় বেশ কিছু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শহীদ মিনার নেই। ফলে আমাদের ছেলেরা মহান শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে পারছে না। এভাবে চলতে থাকলে আমাদের ঐতিহ্য এবং শহীদদের ত্যাগ কালের গর্ভে হারিয়ে যাবে।

মেহেরপুর জেলা শিক্ষা অফিসার মাহফুজুল হক যায়যায়দিনকে বলেন, 'জেলার সিংহভাগ প্রতিষ্ঠানেই শহীদ মিনার নেই। গেল ডিসেম্বরের সরকারি নির্দেশনা অনুযায়ী প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় শহীদ মিনার নির্মাণ করতে বলা হয়েছিল। আমি প্রতিটি উপজেলায় সেই নির্দেশনা পাঠিয়ে দিয়েছি। কিছুটা অগ্রগতি হয়েছে।'

জেলা প্রশাসক ড. মুনসুর আলম খাঁন যায়যায়দিনকে জানান, সরকারি নির্দেশনা অনুযায়ী প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে তাদের নিজস্ব অর্থায়নে শহীদ মিনার নির্মাণের জন্য বলা হয়েছে। ইতোমধ্যে অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবার শহীদ মিনার নির্মাণ করেছে। বাকি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে জোর তাগিদ দেওয়া হয়েছে যাতে আগামী বছর শহীদ মিনার নির্মাণ করা হয়।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে