ভাগ্য বিড়ম্বিত তৃতীয় লিঙ্গের কষ্টগাথা

প্রকাশ | ২৩ ফেব্রুয়ারি ২০২১, ০০:০০

আবু সালেহ মো. মুসা, ময়মনসিংহ
আর দশটা শিশুর মতো পরিবারে জন্ম নিয়ে বেড়ে উঠেও সমাজের মূল স্রোত থেকে প্রায় বিচ্ছিন্ন হিজড়া সম্প্রদায়। সামাজিক প্রতিকূলতায় স্বজনরাও তাদের বোঝা ভেবে ঠেলে দেয় দূরে। অনেকেরই জায়গা হয় না পরিবারে। অতি কাছের আপনজনরাও হয়ে যায় অচেনা। জীবন বাঁচিয়ে রাখার তাগিদে সমাজে চলতে গিয়ে পদে পদে শিকার হতে হয় লাঞ্ছনা-বঞ্চনার। সমাজচু্যত হয়ে পথে পথে ঘুরে বেড়ানো ভাগ্য বিড়ম্বিত তৃতীয় লিঙ্গের এসব মানুষের ভাসমান জীবনের পরতে পরতে রয়েছে শত কষ্ট ও ভিন্নতর গল্প-কাহিনি। ময়মনসিংহের বিভিন্ন এলাকায় সড়কে, চলমান যানবাহন, হাট-বাজার, পাড়া-মহলস্নায় প্রতিনিয়ত চোখে পড়ে জীবিকার তাগিদে নানা অঙ্গভঙ্গিতে পথে পথে ঘুরে সামান্য সাহায্যের জন্য সাধারণ মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করে যাচ্ছেন তৃতীয় লিঙ্গের ভাগ্য বিড়ম্বিতরা। আবার দেখা যায় গ্রামাঞ্চলে কোনো সচ্ছল পরিবারে নবাগত শিশুর সংবাদ পেয়ে সেখানে হাজির হয়ে বিশেষ ভঙ্গিমায় বলছে- 'ওগো পেয়ারি পোলা নাচাইবি'। সায় পেয়ে ঢোল বাজিয়ে, নবাগতকে কোলে নিয়ে, হাতে হাত তালি দিয়ে, নেচে গেয়ে সাহায্যের আবদার করছে। তখন সামান্য সাহায্য পেয়ে তা নিয়ে খুশি মনে ফেরে তারা। আবার অনেক সময় দূর দূর করে তাড়িয়ে দেয় অনেকেই। জীবন চলতে চায় না, তবুও নানা কষ্টে চালিয়ে নেয় তারা। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ২০১৩ সালের নভেম্বরে সরকার হিজড়া জনগোষ্ঠীকে 'তৃতীয় লিঙ্গ' হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান করে। এর ফলে হিজড়ারা অন্যদের মতো শিক্ষা, চাকরি, বাসস্থান, স্বাস্থ্যসহ অন্যান্য সুবিধা পাওয়ার সুযোগ লাভ করে। যদিও হিজড়াদের পুরুষ বা নারী ঘোষণা দিয়ে ভোট দেওয়ার অধিকার আগে থেকেই ছিল, তথাপি এমন স্বীকৃতি স্পষ্টভাবে হিজড়াদের অধিকারগুলো সংহত করতে আরও সহায়ক হয়েছে। তৃতীয় লিঙ্গ হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়ার পরও অদ্যাবধি এই জনগোষ্ঠীর অধিকার সংরক্ষণে কোনো নির্দিষ্ট আইন প্রণয়ন করা হয়নি। প্রতিনিয়ত এই জনগোষ্ঠী নানাবিধ চ্যালেঞ্জ, চরম বৈষম্য, আগ্রাসন আর হিংস্রতার শিকার হচ্ছেন। সরকারি হাসপাতালে তারা সমান সেবা পাচ্ছেন না, ডাক্তারি পরীক্ষায় তাদের লিঙ্গ যতার্থতার দোহাই দিয়ে সরকারি চাকরি থেকে বঞ্চিত করা হচ্ছে, স্ব-স্ব পরিবার এখনো বিতাড়িত করছে, বিতাড়িত হতে হচ্ছে। সমাজ সেবা অধিদপ্তর থেকে এদের পুনর্বাসনের কথা বলা হলেও সেটা যথার্থ নয় বলে জানান তারা। ময়মনসিংহের তৃতীয় লিঙ্গরা দলগতভাবে স্বল্প খরচের বাসা ভাড়া নিয়ে কোনোমতে দিন কাটাচ্ছেন। আবার স্বল্পসংখ্যক দলবদ্ধভাবে না থেকে ব্যক্তিগতভাবে অন্য সাধারণ পেশাতেও নিয়েজিত হতে পেরেছেন। \হময়মনসিংহ শহরে বসবাসকারী হিজড়া সালমা, সমলা, রানী, রুবি, পিয়ারি, প্রিয়াংকা, মমতা, শারমিন, রত্না, হাসি, জোনাকী, মালা, কাজল, ময়ুরী, অন্তরা, দুলারী, লিপি, সুখীসহ অনেকের সঙ্গে কথা হয় তাদের জীবন সংগ্রামের নানা বিষয় নিয়ে। তারা জানান, জীবন তাদের বড় কষ্টের। কাজ করতে চাইলে কোনো কাজ করার সুযোগ তারা পান না। মানুষ তাদের প্রায় সব সময়ই যেন ঘৃণার চোখে দেখে। কেউ তাদের স্নেহ-ভালোবাসা দিতে চায় না। তুচ্ছতাচ্ছিল্যে ভরা জীবনে তারা পেটের ক্ষুধা মেটাতে নানা কিছু করে থাকে। তাদের দাবি- সরকার বা রাষ্ট্র তাদের প্রতি যথাযথ যত্নশীল নয়। বিভিন্ন এনজিও বা সংস্থা তাদের নিয়ে কিছু কাজ করলেও সেটা প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল বলে তারা মনে করেন। হিজড়া মমতা জানান, বাইরে দেখা কষ্টের চেয়েও মনের ভেতরে তাদের অনেক বেশি কষ্ট রয়েছে। সেজন্যই তারা নানা সময় নানা অঙ্গভঙ্গি করে, নেচে-গেয়ে আনন্দ উলস্নাসের মধ্যে থেকে মনের কষ্ট চাপা দিয়ে রাখার চেষ্টা করেন। প্রিয়ংকা হিজড়া জানান, তাদের জীবন কাহিনি বলার কোনো জায়গা নেই। কিছু বলতে চাইলেই ভদ্রবেশী মানুষ ঘৃণায় সরে যায়। বাসা ভাড়া নিতে গেলে বাড়ির মালিক হিজড়া বলে বাসা দিতে চায় না। হোটেলে খেতে গেলে পাশ থেকে মানুষ উঠে যায়। এতে হোটেল মালিকের অন্যায় আচারণের শিকার হতে হয় তাদের। গাড়িতে উঠলে যাত্রীর শরীরে শরীর লাগলে নাক সিটকায়, সিটে বসলে সঙ্গে কেউ বসে যেতে চায় না। যাত্রীরা ড্রাইভার-কন্ডাক্টরদের গালিগালাজ করে হিজড়াদের কেন গাড়িতে উঠতে দিয়েছেন। তিনি বলেন, আমরাও তো মানুষ! তবে কেন আমাদের সঙ্গে এমন আচরণ? তৃতীয় লিঙ্গের মানুষের জীবনমান উন্নয়নে কাজ করছে এমন একটি সেবামূলক সংগঠন 'বন্ধু সোশ্যাল ওয়েলফেয়ার সোসাইটি'-এর ময়মনসিংহ বিভাগীয় মিডিয়া কমিটির যুগ্ম-আহ্বায়ক সুলতান মাহমুদ কনিক বলেন, সমাজ বাস্তবতায় হিজড়ারা আসলেই এক চরম অবহেলিত গোষ্ঠী। তাদের জীবনমানের উন্নয়ন ঘটিয়ে তাদের সমাজের মূলস্রোতে নিয়ে আসার জন্য কাজ করছে বন্ধু সোশ্যাল ওয়েলফেয়ার সোসাইটি। সরকারি, বেসরকারি সব পর্যায় থেকেই হিজড়াদের নানামুখী কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা দরকার। সমতাভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠা এবং একটি দেশের সার্বিক উন্নয়নে হিজড়াদের মতো সমাজের পিছিয়ে পড়া সব গোষ্ঠীকে দায়িত্বের সঙ্গে তাদের জীবনমান উন্নয়নের মাধ্যমে সমাজের মূল স্রোতে নিয়ে আসতে হবে।