শনিবারের বিশেষ আয়োজন

অতুলনীয় স্বাদের হাজারী গুড়

প্রকাশ | ২৭ ফেব্রুয়ারি ২০২১, ০০:০০

আবদুর রহমান মলিস্নক ও শুভংকর পোদ্দার
মানিকগঞ্জের দুইশ' বছরের ঐতিহ্য হাজারী গুড়। মো. সোরহাব হোসেন তার বানানো গুড় বাজারজাতকরণের জন্য প্রস্তুত করছেন -যাযাদি
ঝিটকার হাজারী গুড়। মানিকগঞ্জের ইতিহাস-ঐতিহ্য ও লোকজ সংস্কৃতির প্রধানতম অনুষঙ্গ। এক নামেই যার পরিচিতি। প্রায় দুশ' বছরের ঐতিহ্য হাজারী গুড়ের খ্যাতি বহু আগেই ছড়িয়ে পড়েছে দেশের গন্ডি পেরিয়ে বিদেশ বিভূঁইয়ে, সুদূর ইউরোপে। শীতের মৌসুম এলেই ধুম লেগে যায় পিঠা পায়েশের। তার জন্য প্রয়োজন খেজুরের গুড়। এসময় সারা দেশের মানুষ রসনা মিটিয়ে উপভোগ করে সুস্বাদু নানা ধরনের পিঠা-পায়েশ ফিরনি আরো কত কী! খেজুরের গুড়ের বিশেষ সংস্করণ হচ্ছে বিখ্যাত 'হাজারী গুড়'। এটি সবার সাধ ও সাধ্যের মধ্যে না থাকলেও অনেকেই এর স্বাদ, রং ও গন্ধ সম্পর্ক জানেন। বিভিন্ন কারণে এই গুড়ের সেই জৌলুস ধরে রাখা না গেলেও এখনো কদর আছে হাজারী গুড়ের। কী কারণে এই গুড়ের এতো কদর। কীভাবেই বা এটি তৈরি হয় এ নিয়ে মানুষের মনে নানা কৌতূহল রয়েছে। নির্দিষ্ট এলাকার কারিগররা ছাড়া কেউ জানেন না এই গুড়ের মূল রহস্য। এই গুড় এতো মোলায়েম আর নরম যে এর রহস্য ভেদ সম্ভব হয়ে ওঠে না-হাতের কোনো জাদুতে এই গুড় হয়ে ওঠে স্বাদে-গন্ধে অতুলনীয়। ইতিহাসখ্যাত হাজারী গুড়ের প্রধান বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এটি গুঁড়ো করে ফুঁ দিলে তা ছাতুর মতো বাতাসে উড়ে যায় এবং হাত থেকে মাটিতে পড়ে গেলেই ভেঙে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে যায়। অথচ সাধারণ গুড় ভাঙতে অনেকখানি কসরত করতে হয়। হাজারী গুড়ের ইতিহাস দু-এক দশকের নয়। ব্রিটিশ আমলে ইংল্যান্ডের রানী এলিজাবেথকেও এ গুড় উপহার দেওয়া হয়েছিল। রানি এলিজাবেথ এ গুড় খেয়ে অভিভূত হয়েছিলেন। মুগ্ধতা প্রকাশ করতে করতে গিয়ে আগ্রহী হয়ে 'হাজারী' নামে একটি সিলমোহরও তৈরি করে দিয়েছিলেন রানি। তিনি নিজেই ছড়িয়ে দিয়েছিলেন এ গুড়ের নাম। বিশ্বের কমপক্ষে ২০-২৫টি দেশের বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ এ গুড়ের স্বাদ নিতে প্রতি বছরই অপেক্ষায় থাকেন। যিনি একবার এ গুড়ের স্বাদ আস্বাদন করেছেন তিনি আর ভুলতে পারেন না। সারাদেশে তাই এক নামে পরিচয় এ গুড়ের। হাজারী গুড় নিয়ে এলাকায় প্রচলিত আছে রূপকথার গল্প। প্রায় দেড়শ' বছর আগে জেলার হরিরামপুর উপজেলার ঝিটকা অঞ্চলে মো. হাজারী প্রামাণিক নামে একজন গাছি ছিলেন। যিনি খেজুরের রস দিয়ে গুড় তৈরি করতেন। একদিন বিকালে খেজুর গাছে হাঁড়ি বসিয়ে গাছ থেকে নামামাত্রই একজন দরবেশ তার কাছে রস খেতে চান। তখন হাজারী প্রামাণিক ওই দরবেশকে বলেছিলেন, সবেমাত্র গাছে হাঁড়ি বসানো হয়েছে। এতো অল্প সময়ে বড় জোর ১০-১৫ ফোঁটা রস হাঁড়িতে পড়েছে। তবুও দরবেশ তাকে গাছে উঠে হাঁড়ি নামিয়ে রস খাওয়ানোর অনুরোধ জানান। দরবেশের অনুরোধে হাজারী প্রামাণিক খেজুর গাছে ওঠেন। তিনি দেখতে পান, রসে হাঁড়ি ভরে গেছে। রসভর্তি হাঁড়ি নিয়ে তিনি গাছ থেকে নেমে দরবেশকে রস খাওয়ান এবং দরবেশের পা জড়িয়ে ধরেন। তখন দরবেশ তাকে বুকে জড়িয়ে ধরে বলেন, তুমি যত গুড় তৈরি করবে, তার সুনাম দেশ-বিদেশে ছড়িয়ে পড়বে। এরপর থেকেই গাছি হাজারী প্রামাণিকের নামেই এই গুড়ের নাম হাজারী গুড় তৈরি করা হয়। মানিকগঞ্জের হরিরামপুর উপজেলার ঝিটকা এলাকায় বেশ কয়েকটি ইউনিয়নে এই গুড় বানানো হয়। ঝিটকা এলাকায় ঐতিহ্যবাহী হাজারী পরিবারসহ পঞ্চাশের অধিক গাছি পরিবার এই শিল্পের সঙ্গে জড়িত। তবে এক শ্রেণির অসাধু গুড় প্রস্তুতকারক সাদা রঙের গুড়ের ওপর হাজারী গুড়ের নাম খোদাই করে বাজারজাত করে সাধারণ ক্রেতাদের ধোঁকা দিচ্ছে। চিনি চুন আর হাইড্রোজ মিশিয়ে বানানো হচ্ছে হাজারী গুড়। নির্বিচারে খেজুর গাছ কেটে ইটভাটায় লাকড়ি হিসেবে পোড়ানো ও পদ্মানদীর ভাঙনের ফলে খেজুর গাছ ক্রমেই নিঃশেষ হয়ে আসছে। তাই ঐতিহ্যবাহী এই গুড়শিল্প এখন ধ্বংসের মুখে এসে দাঁড়িয়েছে। ভাটা পড়েছে এর জৌলুস ও জনপ্রিয়তায়। গাছিরা জানান, ১৫ থেকে ২০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা এই গুড় উৎপাদনের উপযুক্ত সময়। আগের দিন বিকালে গাছ কেটে হাঁড়ি বেঁধে দেওয়া হয়। পরদিন ভোরে গাছ থেকে রস নামিয়ে ছেঁকে ময়লা পরিষ্কার করে মাটির তৈরি পাত্রে (জালা) অথবা টিনের তৈরি পাত্রে চুলায় জ্বাল দিয়ে বিশেষ পদ্ধতিতে গুড় তৈরি করতে হয়। মিষ্টি ও টলটলে রস ছাড়া এ গুড় হয় না। এক কেজি হাজারী গুড় তৈরিতে প্রয়োজন হয় প্রায় ১২ থেকে ১৫ কেজি রস। প্রচুর চাহিদা থাকায় গুড় নেওয়ার জন্য আগে থেকেই গাছিদের বলে রাখতে হয়। প্রতি কেজি গুড় বিক্রি হয় ১৪০০ থেকে ১৫০০ টাকায়। হাজারী প্রোডাক্টস মানিকগঞ্জের স্বত্বাধিকারী শফিকুল ইসলাম হাজারী শামীম বলেন, ঝিট্‌কা এলাকার ২০ থেকে ২৫টি পরিবার প্রতিদিন ৫০ থেকে ৬০ কেজি গুড় তৈরি করেন। খেজুর গাছ কমে যাওয়ায় গুড়ের উৎপাদনও কমছে। ভেজাল প্রতিরোধ করতে চলতি বছরে রেজিস্টার্ড ট্রেডমার্কযুক্ত প্যাকেটের মাধ্যমে গুড় বাজারজাত করা হচ্ছে। হাজারী গুড় টিকিয়ে রাখতে হলে রাস্তাঘাট ও পতিত জমি এবং ভিটে-বাড়ির আঙিনায় বেশি বেশি করে খেজুরগাছ রোপণ করতে এলাকাবাসীর প্রতি আহ্বানও জানান তিনি। হরিরামপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. সাইফুল ইসলাম যায়যায়দিনকে বলেন, 'ঐতিহ্যবাহী হাজারী গুড়কে টিকিয়ে রাখতে হলে প্রথমে খেজুর গাছের পরিমাণ বৃদ্ধি করা প্রয়োজন। আমরা সে লক্ষ্যে কাজ করছি।' তিনি বলেন, গুড়ের মান বজায় রাখতে প্রবীণ কারিগরদের সঙ্গে আলোচনা করে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।'