রক্তে কেনা আমার স্বাধীনতা

ইতিহাসের নির্মমতার সাক্ষী বধ্যভূমি ও গণকবর

বগুড়ার ধুনট

প্রকাশ | ০১ মার্চ ২০২১, ০০:০০

ইমরান হোসেন ইমন
বগুড়ার ধুনট
১৯৭১ সালে পাক হানাদার বাহিনী দেশের অন্যান্য স্থানের মতো বগুড়ার ধুনট উপজেলাতেও তাদের নৃশংসতম হত্যাকান্ড ঘটিয়েছিল। এ নির্মমতার সাক্ষী হয়ে আছে বেশকিছু বধ্যভূমি ও গণকবর। কিন্তু দেশ স্বাধীনের ৪৯ বছর অতিবাহিত হলেও এ উপজেলায় এখনো নির্মিত হয়নি কোনো স্মৃতিসৌধ বা স্মৃতিস্তম্ভ। সংরক্ষণ না করায় মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি বিজড়িত এসব স্থানগুলো আজ হারিয়ে যেতে বসেছে। অযত্ন-অবহেলায় অরক্ষিত অবস্থায় পড়ে রয়েছে বধ্যভূমি ও গণকবরগুলো। ধুনট উপজেলার সবচেয়ে বড় বধ্যভূমি হচ্ছে এলাঙ্গী বধ্যভূমি। এলাঙ্গী ইউনিয়নের বীর মুক্তিযোদ্ধা হামিদুল ইসলাম ফটিক ও শামছুল হক জানান, পাক হানাদার বাহিনী ২৭ এপ্রিল প্রথম ধুনটে আসে। ওইদিনই তারা ক্যাম্প স্থাপন করেন। এই ক্যাম্পের ইনচার্জ ছিলেন, ক্যাপ্টেন দবিবর রহমান খান পাঞ্জাবি। তারা স্থানীয় মুসলিম লীগ নেতাদের সহায়তায় এলাঙ্গী গ্রামের হিন্দু বসতির উপর আক্রমণ চালান। প্রতিটি বাড়ি থেকে পুরুষ, মহিলা ও শিশুদের ধরে নিয়ে এলাঙ্গী গ্রামের দুর্গাচরণ ঘোষের পুকুরপাড়ে দাঁড় করিয়ে ৩৯ জনকে ব্রাশ ফায়ারে হত্যা করেন। তাদের মধ্যে দুর্গাচরণ ঘোসের মেয়ে সরবালা ঘোষ, শেরপুরের বীরেন কুন্ডু, তার শিশুপুত্র মাধব কুন্ডু, এলাঙ্গী গ্রামের খাকুনি বিনি, হরাই প্রমাণিক, মাধাই সাহা ও নায়েব আলীসহ ৩২ জনের নাম পাওয়া যায়। এসব বধ্যভূমিগুলোতে নেই কোনো নাম ফলক। রক্ষণাবেক্ষণের উদ্যোগও নেওয়া হয়নি। ধুনট উপজেলায় বেশ কয়েকটি গণকবর রয়েছে। গণকবরগুলো ধুনট থানা ভবনের পাশেই অবস্থিত। তন্মধ্যে ধুনট থানা সংলগ্ন পূর্বপাশে জেল হোসেন নামে এক ব্যবসায়ীর চাতালের অবস্থিত গণকবরটি ধুনটের একমাত্র গণকবর হিসেবে পরিচিত। ১৯৭১ সালে পাক সেনারা এই গণকবরে কান্তনগর গ্রামের মোস্তাফিজুর রহমান, ভরনশাহী গ্রামের জহির উদ্দিন, মাঝবাড়ী গ্রামের ফরহাদ হোসেন, জিলস্নুর রহমান, পর্বত আলী, শিয়ালী গ্রামের নুরুল ইসলাম ও চান্দারপাড়া গ্রামের আব্দুল লতিফসহ নাম না জানা আরও ২৮ জনকে হত্যা করে একসঙ্গে পুঁতে রাখে। বর্তমানে এই গণকবরটি অযত্ন আর অবহেলায় পড়ে আছে। গণকবরে যাওয়ার কোনো রাস্তা নেই। প্রতিটি জাতীয় দিবসে এই গণকবরে প্রশাসনের পক্ষ থেকে দোয়া মাহফিলের আয়োজন করা হলেও এটা রক্ষণাবেক্ষণে কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। এই গণকবর ছাড়াও ধুনট থানার উত্তর পার্শ্বে অবস্থিত 'গায়েন বাড়ী' গণকবর ধুনট উপজেলার সবচেয়ে বড় গণকবর। গায়েন বাড়ীর নাতি আনোয়ার হোসেন জানান, এই গণকবর সম্পর্কে তার দাদি মইফুল বিবির কাছ থেকে অনেক গল্প শুনেছেন। ১৯৭১ সালের আগস্ট মাসের মাঝামাঝি রাত ১০টার দিকে যমুনা পাড়ি দিয়ে ৫০ থেকে ৬০ জনের একটি কাফেলা তাদের বাড়ির পাশ দিয়ে যাচ্ছিল। কিন্তু পাশে যে সেনা ক্যাম্প আছে, তারা বুঝতে পারেনি। তখন এই কাফেলার লোকদের ধরে এনে নারী ও শিশুসহ ৪২ জনকে তার দাদির চোখের সামনে জীবিত অবস্থায় বাঁশঝাড়ে পুঁতে রাখে পাক সেনারা। এছাড়া এর পাশেই রয়েছে 'বাবু বাড়ী' গণকবর নামে পরিচিত আরেকটি গণকবর। যজ্ঞেশ্বর বাবুর বাড়ীর দক্ষিণ-পশ্চিম পার্শ্বে একটি নারিকেল গাছের নিচে একসঙ্গে ১৩ জনকে জীবিত অবস্থায় পুঁতে রেখেছে পাক সেনারা। এছাড়াও আশপাশে আরও বেশ কয়েকটি গণকবর রয়েছে। তবে 'গায়েন বাড়ী' ও 'বাবু বাড়ী' দুটি গণকবরই অরক্ষিত অবস্থায় রয়েছে। বাঁশঝাড় ও আবর্জনায় ভরে রয়েছে এই গণকবরগুলো। দীর্ঘদিন ধরে সংরক্ষণ না করায় মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিবিজড়িত এসব স্থানগুলো আজ হারিয়ে যেতে বসেছে। তবে এখনো যেসব বধ্যভূমিতে স্মৃতিসৌধ বা স্মৃতিস্তম্ভ তৈরি হয়নি, তা বাস্তবায়নে দ্রম্নত পদক্ষেপ নিতে স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, প্রশাসন এবং সরকারের কাছে দাবি জানিয়েছেন স্থানীয় বীর মুক্তিযোদ্ধারা। গোসাইবাড়ী ইউনিয়নের বীর মুক্তিযোদ্ধা ইলিয়াস হোসেন জানান, 'আমাদের ধুনট উপজেলায় কোনো শহীদ মুক্তিযোদ্ধার নামে কোনো স্মৃতিস্তম্ভ নেই। তাই সরকারের কাছে শহীদ মুক্তিযোদ্ধার নামে স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণের দাবি করছি।' মথুরাপুর ইউনিয়নের পিরহাটি গ্রামের শহীদ মুক্তিযোদ্ধা আব্দুর রউফের ছেলে রেজাউল হক মিন্টু বলেন, যারা দেশের জন্য জীবন দিয়েছে তাদের গণকবরগুলো আজও রক্ষণাবেক্ষণ করা হয়নি। অযত্নে-অবহেলায় পড়ে রয়েছে কবরগুলো। ধুনটের ইতিহাস ও মুক্তিযুদ্ধ গবেষণা গ্রন্থের রচয়িতা গবেষক আব্দুর রাজ্জাক বলেন, সংগ্রহ ও সংরক্ষণের অভাবে মুক্তিযুদ্ধের অনেক স্মৃতি ধুনট থেকে হারিয়ে যাচ্ছে। স্থানীয় মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস ভবিষ্যতে জাতীয় মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস রচনায় সহায়ক হবে। ধুনট উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) সঞ্জয় কুমার মহন্ত বলেন, এই উপজেলায় নতুন যোগদান করেছেন। তাই এসব বিষয়ে তার জানা নেই। খোঁজ নিয়ে গণকবরগুলো রক্ষণাবেক্ষণ ও স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হবে। এ বিষয়ে বগুড়া-৫ (শেরপুর-ধুনট) আসনের সংসদ সদস্য বীর মুক্তিযোদ্ধা আলহাজ হাবিবুর রহমান বলেন, 'ধুনট-শেরপুর এলাকায় যেসব বধ্যভূমি রয়েছে সেগুলোতে স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ এবং সংরক্ষণে আমরা কাজ শুরু করছি। এরই মধ্যে এগুলো তালিকাভুক্তকরণ, চিহ্নিতকরণ এবং সেগুলো বাস্তবায়নে মন্ত্রণালয়ে প্রজেক্ট আকারে পাঠানো হবে। ইতোমধ্যে ধুনট উপজেলায় মুক্তিযোদ্ধা কমপেস্নক্স নির্মাণ করা হয়েছে।'