শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১
টাঙ্গাইলের মির্জাপুর

স্বাধীনতার ৪৯ বছর পর স্মৃতিফলক

শিলা আক্তার
  ০২ মার্চ ২০২১, ০০:০০
টাঙ্গাইলের মির্জাপুরে মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের স্মরণে নির্মিত স্মৃতিফলক

মহান মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের স্মরণে স্বাধীনতার ৪৯ বছর পর টাঙ্গাইলের মির্জাপুরে স্মৃতিফলক নির্মিত হয়েছে। ২০২০ সালে স্থানীয় প্রকৌশল অধিদপ্তর ৩৩ লাখ ২১ হাজার ৩৭৫ টাকা ব্যয়ে স্মৃতিফলক নির্মাণ করেন। এটি মূলত ঢাকার বাইরে গোরান-সাটিয়াচড়ার প্রথম প্রতিরোধ যুদ্ধের স্মৃতি হিসেবে নির্মিত হয়।

এদিকে, একাত্তরের মার্চ মাসের মাঝামাঝি থেকেই মির্জাপুর উপজেলার গোড়ান-সাটিয়াচড়া গ্রামের বীরসন্তানরা সামরিক প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। সেনাসদস্য মোশাররফ হোসেন তাদের প্রশিক্ষণ দেন। তাছাড়া স্থানীয় বীর মুক্তিযোদ্ধারা পাকুলস্না থেকে ধল্যা পর্যন্ত সড়কের দুই পাশে ব্যাংকার কেটে মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি নেয়। তৎকালীন ইপিআর (বর্তমান বিজিবি) সদস্যরা ও মুক্তিযোদ্ধারা সম্মিলিতভাবে নাটিয়াপাড়া থেকে অগ্রসর হয়ে ২ এপ্রিল সাটিয়াচড়ায় অবস্থান নেন। এ সময় মুক্তিযোদ্ধাদের সার্বিক সহযোগিতার জন্য ভূমিকা পালন করেন, খন্দকার আসাদুজ্জামান, বদিউজ্জামান খান, আব্দুল লতিফ সিদ্দিকী, কাদের সিদ্দিকী, ন্যাপ নেতা সৈয়দ আব্দুল মতিন, শ্রমিক নেতা হাবিবুর রহমান খান প্রমুখ।

গোড়ান-সাটিয়াচড়া থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের একটি দল ধল্যাতে এগিয়ে গিয়ে ঘাঁটি স্থাপন করে। আর কাদের সিদ্দিকীর নেতেৃত্বে ইপিআর ও মুক্তিযোদ্ধাদের দল নাটিয়াপাড়ায় অবস্থান করে। অপরদিকে গোড়ান-সাটিয়াচড়ায় অবস্থান নেয় মুক্তিযোদ্ধাদের প্রধান ও শক্তিশালী দল। এখানে নেতৃত্বে থাকেন ইপিআরের সুবেদার আব্দুল আজিজ ও সুবেদার আব্দুল খালেক। লতিফ সিদ্দিকী ও খন্দকার আসাদুজ্জামানের নেতৃত্বে জেলা গণপরিষদের পক্ষ থেকে তাদের থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করা হয়।

একাত্তরের ৩ এপ্রিল শনিবার ভোর ৫টায় অসংখ্য গাড়ির শব্দে ধল্যায় অবস্থানকারী মুক্তিযোদ্ধাদের ঘুম ভেঙে যায়, তারা অতিদ্রুত প্রস্তুতি নিতেই হানাদার বাহিনীর ১৫০ থেকে ২০০ গাড়িরবহর অতি নিকটে চলে আসে। বহরের সামনে ছিল ফায়ার বিগ্রেডের খালি গাড়ি আর আকাশে চক্কর দিচ্ছিল বিমান। সময়ের অভাবে ধল্যায় অবস্থানরত মুক্তিবাহিনী পাকহানাদার বাহিনীকে প্রতিরোধ করতে না পেরে পিছিয়ে গিয়ে গোড়ান-সাটিয়াচড়ায় মূল মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে অবস্থান নেয়। হানাদারবাহিনীর গাড়িরবহর গোড়ান-সাটিয়াচড়ায় মুক্তিযোদ্ধাদের প্রধান ঘাঁটির ৬০ থেকে ৭০ গজের মধ্যে চলে এলে সড়কের বাম পাশে পূর্ব থেকেই অবস্থান নেওয়া ইপিআর বাহিনীর বাঙালি নায়েক সুবেদার আব্দুল আজিজ লাইট মেশিনগান দিয়ে সর্বপ্রথম গুলিবর্ষণ করেন, সঙ্গে সঙ্গে সড়কের উভয়পাশ থেকে ৫০ থেকে ৬০টি রাইফেল, এলএমজি, রকেটলাঞ্চার ও মর্টার দিয়ে পাকিস্তানি হানাদারদের ওপর আক্রমণ করা হয়।

হানাদার বাহিনী পাল্টা আক্রমণ করে। মুক্তিযোদ্ধাদের প্রবল আক্রমণে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী দিশাহারা হয়ে পড়ে। ইতোমধ্যে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীরা ৩০ থেকে ৩৫টি গাড়ি ধ্বংসপ্রাপ্ত হয় এবং ৩০০-এর অধিক সৈন্য নিহত হয়, প্রায় ২০০ জনের মতো সৈন্য আহতও হয়। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে পাকিস্তানি হানাদারদের এতো পরিমাণে ক্ষতি খুব কমই হয়েছে। যুদ্ধের এক পর্যায়ে সুবেদার আব্দুল খালেকের এলএমজি নষ্ট হয়ে গেলে তিনি তার নিরস্ত্র সহযোগী ফজলুর রহমান ফারুককে দ্রম্নত স্থান ত্যাগ করতে বলেন। ফজলুর রহমান ফারুক স্থান ত্যাগ করে ১০০ গজ যাওয়া মাত্রই হানাদারদের মেশিনগানের গুলিতে ঝাঁঝড়া হয়ে যায় তার দেহ। হানাদারবাহিনী প্রথমে প্রচন্ড মার খেলেও পরে ব্যাপক শক্তি নিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের ওপর আক্রমণ করে। এই আক্রমণের সামনে অল্প অস্ত্রে সজ্জিত মুক্তিযোদ্ধারা আর বেশি সময় টিকতে পারেনি। পর্যাপ্ত অস্ত্র না থাকায় অর্থাৎ গোলাবারুদ ফুরিয়ে যাওয়ায় মুক্তিযোদ্ধারা পিছু হটেন। এদিকে হানাদার বাহিনী কামান ও হেলিকপ্টার দিয়ে মুক্তিবাহিনীর ব্যাংকার আক্রমণ করে ধ্বংস করে দেয়। গোড়ান-সাটিয়াচড়ার যুদ্ধে মুক্তিবাহিনীর ব্যাপক ক্ষতি হয়। সকাল ৯টায় সব প্রতিরোধ ভেঙে যায়। কাদের সিদ্দিকী পিছিয়ে নাটিয়াপাড়ায় গিয়ে দেখেন ই.পি.আর সদস্যরা কিছু ভারি অস্ত্রসহ তাদের আস্তানা গুটিয়ে টাঙ্গাইলের দিকে যাত্রা শুরু করেছেন। তিনি ইপিআর সদস্যদের প্রতিরোধ না ওঠানোর জন্য অনুরোধ করলেও তারা তা শোনেননি। ফলে মুক্তিযোদ্ধাদের ৩০৩ রাইফেল দিয়ে প্রতিরোধটিকে রাখা সম্ভব হয়নি। পরে কাদের সিদ্দিকীসহ সব মুক্তিযোদ্ধা টাঙ্গাইল শহরে চলে আসেন।

এই যুদ্ধে প্রায় ২৯ জন ইপিআর ও পুলিশ বাহিনীর বাঙালি সদস্য, প্রায় ৪৫ জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। ১৯৭১ সালের ৩ এপ্রিল পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী গোড়ান-সাটিয়াচড়া গ্রামে প্রবেশ করে নারকীয় ধ্বংসযজ্ঞ চালায়, তারা নারী, পুরুষ, শিশু, বৃদ্ধ যাকে পেয়েছে তাকেই হত্যা করে। সেদিন এই দুই গ্রামের শতাধিক ব্যক্তি শহীদ হন।

পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী শুধু গুলিবর্ষণ, বেয়নেট চার্জ করে মানুষ হত্যা করেই ক্ষান্ত হয়নি, তারা পুড়িয়ে দিয়েছে অসংখ্য ঘর-বাড়ি। বর্বর পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ১৮ জন বাঙালি ইপিআর সদস্যসহ ৩০ জনকে একই ঘরে জড়ো করে আগুন দিয়ে পুড়িয়ে হত্যা করে। একটি ব্যাংকারে আত্মগোপন করা ১৫ জনকে নির্মমভাবে হত্যা করে। গ্রাম দুটি জনমানব শূন্য বিরাণ ভূমিতে পরিণত হয়। ইপিআর বাহিনীর সদস্য, মুক্তিযোদ্ধা, সাধারণ গ্রামবাসীসহ বীর শহীদরা এই গ্রামের মাটিতেই চিরশায়িত আছেন। আজও গণকবরগুলো যথাযোগ্য সম্মান পায়নি, শহীদ পরিবারদের হয়নি যথাযথ মূল্যায়ন।

যুদ্ধের স্মৃতি কে ধরে রাখতে ২০২০ সালে স্থানীয় প্রকৌশল অধিদপ্তর ৩৩ লাখ ২১ হাজার ৩৭৫ টাকা ব্যয়ে একটি স্মৃতিফলক নির্মাণ করেন। এ ব্যাপারে মির্জাপুর উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ড কাউন্সিলের সাবেক কমান্ডার অধ্যাপক দুর্লভ বিশ্বাস বলেন, দির্ঘদিন পর হলেও মুক্তিযোদ্ধাদের স্মরণে মির্জাপুরে একটি স্মৃতিফলক নির্মিত হওয়ায় তারা আনন্দিত।

উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আবদুল মালেক বলেন, বীর শহীদরা আমাদের গর্ব, তারা আমাদের জন্য যে আত্মত্যাগ করেছেন তার জন্যই স্মৃতিফলক নির্মিত হয়েছে এবং পর্যায়কক্রমে শহীদদের স্মরণে আরও স্মৃতিফলক নির্মাণ করা হবে।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে