পরিচালক, জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল

মুজিববর্ষেই হাসপাতালের নতুন বস্নকগুলো চালু হবে

হৃদরোগের চিকিৎসায় দেশের একমাত্র বিশেষায়িত সরকারি প্রতিষ্ঠান 'ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব কার্ডিওভাস্কুলার ডিজিজেজ অ্যান্ড হসপিটাল' (এনআইসিভিডি) বা জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল। বর্তমানে এই প্রতিষ্ঠানের চিকিৎসক, শিক্ষক ও পরিচালকের দায়িত্ব পালন করছেন ডা. মীর জামাল উদ্দীন। হৃদরোগ হাসপাতালের চিকিৎসা ব্যবস্থা ও সমসাময়িক স্বাস্থ্যসেবা পরিস্থিতি নিয়ে যায়যায়দিনের সঙ্গে কথা বলেছেন তিনি।

প্রকাশ | ০৩ মার্চ ২০২১, ০০:০০

জাহিদ হাসান
ডা. মীর জামাল উদ্দীন
যায়যায়দিন : আপনি এই হাসপাতালের একজন চিকিৎসক, শিক্ষক ও পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। হাসপাতাল নিয়ে আপনার অভিজ্ঞতার কথা বলুন। ডা. মীর জামাল উদ্দীন : প্রথমত আমি একজন কার্ডিওলজিস্ট। অন্যদিকে হৃদরোগ চিকিৎসায় এনআইসিভিডি বাংলাদেশে সবচেয়ে প্রথম ও একমাত্র বিশেষায়িত সরকারি প্রতিষ্ঠান। এই মুহূর্তে দেশে এক হাজারের মতো কার্ডিওলজিস্ট আছেন। এর প্রায় ছয়শ' জনই এখান থেকে পাস করে বিভিন্ন হাসপাতালে হৃদরোগের সেবা দিচ্ছেন। এ কারণে প্রতিষ্ঠানটিকে কার্ডিওলজিস্ট তৈরির সূতিকাগার বলা হয়। আর এই ইনস্টিটিউটের চিকিৎসক, শিক্ষক ও পরিচালক হিসেবে কাজ করতে পেরে নিজেকে ভাগ্যবান মনে করি। যাযাদি : এখানকার অবকাঠামোগত সামর্থ্যের চেয়ে রোগী বেশি। এই সংকট সমাধানে আপনারা কী করছেন? ডা. মীর জামাল : হৃদরোগ হাসপাতালের অবকাঠামোগত সামর্থ্যের চেয়ে রোগীর সংখ্যা অনেক বেশি। ৪২৪ বিছানার চিকিৎসা কেন্দ্রটিতে প্রতিদিন বারোশ'র মতো রোগী ভর্তি থাকছেন। প্রতিদিন হাজারেরও বেশি রোগী বহির্বিভাগে সেবা পাচ্ছেন। এখানে এসে কেউ চিকিৎসা পায়নি এমন নজির নেই। তবে শয্যা অনুপাতে রোগীর সংখ্যা বেশি হওয়ায় কর্তৃপক্ষকে জানানোর পর স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে হাসপাতালের উত্তর ও দক্ষিণ বস্নকে অতিরিক্ত চারটি করে ফ্লোর তৈরির কাজ শেষের দিকে। আশা করছি মুজিববর্ষেই হাসপাতালের দক্ষিণ বস্নক চালু করা যাবে। তখন ৪০০টি শয্যা বাড়বে। এখানে উলেস্নখ্য, উত্তর বস্নক চালু করতে পারলে আরও ৪শ'সহ মোট ১২৫০ বেডে রোগীরা সেবা নিতে পারবেন। তখন আর কাউকে মেঝেতে শুয়ে চিকিৎসা নিতে হবে না। যাযাদি : এখানে চিকিৎসার ক্ষেত্রে কোন ধরনের সাফল্য রয়েছে? ডা. মীর জামাল : হার্টের সমস্যায় ভোগা রোগীদের সেবায় এই হাসপাতালের চিকিৎসকদের বেশকিছু সাফল্য রয়েছে। হৃদরোগ সেবায় যত ধরনের ইন্টারভেনশন এবং কার্ডিয়াক সার্জারি রয়েছে তার সবকিছুই এখানে হয়। যেমন দেশে কেবলমাত্র জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউটেই ছোট্ট একটি ছিদ্র করে হার্টের বাইপাস অপারেশন করা হয়। পাশাপাশি সব ধরনের সিম্পল ইন্টারভেনশন ও কমপেস্নক্স ইন্টারভেনশন চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। এ ছাড়া সাধারণ কার্ডিয়াক চিকিৎসা যেমন, বুকেব্যথা, হার্টঅ্যাটাক, জন্মগতভাবে হার্টে ছিদ্র, হার্ট রিদমের পরিবর্তন এ ধরনের সব চিকিৎসা দেওয়া হয়। এজন্য ইকোকার্ডিওগ্রাম, এক্সারসাইজ স্টেটমেন্ট টেস্টসহ অন্য চিকিৎসা ও পরীক্ষা-নিরীক্ষার ব্যবস্থা রয়েছে। যাযাদি : অপারেশন খরচ ও বিনামূল্যে ওষুধ প্রাপ্তির ক্ষেত্রে এ হাসপাতালের অবস্থান কোন ধরনের? ডা. মীর জামাল : এখানে নাম মাত্র ফি'তে বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হয়। যেমন ধরুন, বেসরকারি ডায়াগনস্টিক সেন্টারে একটি সাদা-কালো ইকো-কার্ডিওগ্রাম পরীক্ষায় পনের'শ টাকা খরচ হয়। সেখানে এনআইসভিডিডিতে ২০০ টাকায় হচ্ছে। একইভাবে বাইরে একটি কালার-ডপলার ইকো পরীক্ষায় আড়াই থেকে তিন হাজার টাকার প্রয়োজন হলেও হৃদরোগ ইনস্টিটিউটে লাগে ছয়'শ টাকা। এখানে অল্প খরচেই রোগীরা মানসম্মতভাবে পরীক্ষা করাতে পারেন। গরিব রোগীদের জন্য বিনামূল্যে পরীক্ষার ব্যবস্থা রয়েছে। এ ছাড়া বেসরকারি হাসপাতালে হার্টের একটি এনজিওগ্রামে ২২ থেকে ২৫ হাজার টাকা নেওয়া হলেও হৃদরোগে খরচ লাগে ২ হাজার টাকা। গরিব ও মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য বিনামূল্যে এই পরীক্ষার সুযোগ রয়েছে। অন্যান্য হাসপাতালের চেয়ে এই ইনস্টিটিউটে অপারেশন খরচও অনেক কম। হার্ট অ্যাটাকের সঙ্গে সঙ্গে জীবন রক্ষাকারী ওষুধ স্ট্রেপটোকাইনেস, রক্ত তরলকরণে এনোক্সাপারিন, এনাসটেবল এনজাইনা জাতীয় ইনজেকশন হাসপাতাল থেকে বিনামূল্যে দেওয়া হয়। এনজিওগ্রামে ব্যবহৃত উচ্চমূল্যের ডাই, ক্যাথেটার কর্ডেজশিপ ইত্যাদি বিনামূল্যে দেওয়া হয়। হার্টের ছিদ্র বন্ধের কাজে ব্যবহৃত প্রায় একলাখ টাকা দামের ডিভাইস ক্লোজার যন্ত্র, হার্টের হৃদস্পন্দন কমে গেলে ৯০ হাজার থেকে দেড় লাখ টাকার পেসমেকার প্রতিস্থাপন, হার্টের রক্তনালির বস্নকের চিকিৎসায় ব্যবহৃত রিং লাগানো বা স্টেন্টিং কিছু কিছু রোগীর ক্ষেত্রে বিনামূল্যে দেওয়া হয়। এ ছাড়া স্বল্পখরচে হৃৎপিন্ডের ভাল্বের ত্রম্নটি সংশোধন ও ভাসকুলার সার্জারি অপারেশন করা হয়। যাযাদি : একটি বিশেষায়িত হাসপাতালের জন্য পর্যাপ্ত পরিমাণে আধুনিক যন্ত্রপাতি, প্রশিক্ষিত টেকনিশিয়ান, নার্স, ব্রাদার, জুনিয়র ডাক্তার এমনকি আয়া-ওয়ার্ডবয়ও গুরুত্বপূর্ণ। আপনার হাসপাতাল এদিক থেকে কতটা স্বয়ংসম্পূর্ণ? ডা. মীর জামাল : একটি বিশেষায়িত হাসপাতালে অবশ্যই পর্যাপ্ত পরিমাণ আধুনিক যন্ত্রপাতি প্রয়োজন। তার অধিকাংশ এই হাসপাতালে রয়েছে। এর বাইরে অল্পকিছু যন্ত্রের প্রয়োজন যেগুলোর জন্য স্বাস্থ্যসচিব, স্বাস্থ্যমন্ত্রী ও স্বাস্থ্য সচিবকে অবহিত করা হয়েছে। তারাও এ ব্যাপারে আশ্বস্ত করেছেন। আর জুনিয়র ডাক্তার, নার্স টেকনেশিয়ানরা দীর্ঘদিন ধরে এখানে কাজ করায় দক্ষ হয়ে উঠছেন। এখানে ৬০ শতাংশ ফ্রি বেড। ৪০ শতাংশ পেইং বেড। ৩০টি কেবিন রয়েছে। শীতাতপনিয়ন্ত্রিত ওয়ার্ড রয়েছে। দরিদ্র রোগীদের জন্য সোশ্যাল ওয়েলফেয়ার ফান্ড রয়েছে। দুই শিফটে দায়িত্ব শতাধিক বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক, মেডিকেল অফিসার ও প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত নার্স ও ব্রাদাররা সর্বক্ষণিক সেবা দিচ্ছেন। যাযাদি : সেবা প্রদানে আন্তরিকতার ক্ষেত্রে জাতীয় হৃদরোগ হাসপাতালের চিত্র কেমন? সবচেয়ে বড় অবদান বা উলেস্নখযোগ্য দিক কোনটি বলে আপনি মনে করেন? ডা. মীর জামাল : হৃদরোগ সেবাদানের ক্ষেত্রে এটি সবচেয়ে বড় ও বিশেষায়িত প্রতিষ্ঠান। রোগীর চাপও বেশি। তবে প্রশিক্ষিত চিকিৎসক, নার্স, আয়া-ওয়ার্ডবয় সবাই রোগীর সেবায় নিবেদিত কর্মী। হাসপাতাল সম্পর্কে স্বাস্থ্যসচিব নিজে বলছেন, এনআইসিভিডিতে যতজন রোগী মেঝেতে শুয়ে চিকিৎসা নেন, তার অর্ধেক কার্ডিওলজির রোগী বাংলাদেশের অন্যান্য প্রাইভেট হাসপাতালে ভর্তি হয় না। মূলত সেবার মান ভালো এবং চিকিৎসা পায় বলেই রোগীরা ছুটে আসেন। তাছাড়া এখানকার চিকিৎসা আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন। এখানে মেঝেতে শুয়ে থাকা একজন রোগীর সিপিআর (কার্ডিও পালমোনারি রিসাসিটেশন) অর্থাৎ হৃৎপিন্ড ও ফুসফুস পূর্ণসঞ্চালন প্রয়োজন হলে এনআইসভিডির কর্তব্যরত চিকিৎসক মাটিতে হাঁটু গেড়ে বসে রোগীর মানসম্মত সিপিআর সেবা দিয়ে থাকেন। এভাবে দেশের মানুষকে চিকিৎসাদানের ক্ষেত্রে হৃদরোগ ইনস্টিটিউটের বড় অবদান রাখছে। যাযাদি : যে কোনো হাসপাতালে কেবল চিকিৎসা নয়, ল্যাব টেস্ট গুরুত্বপূর্ণ। এ ক্ষেত্রে আপনারা কী করছেন ? ডা. মীর জামাল : চিকিৎসার ক্ষেত্রে ল্যাব টেস্ট অনেক গুরুত্বপূর্ণ। রোগীদের হার্ট-অ্যাটাক সমস্যা চিহ্নিতকরণে ট্রপোনিল আই নামক একটি জরুরি টেস্টের প্রয়োজন হয়। এখানে সপ্তাহের সাতদিন রোগীদের বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষায় ২৪ ঘণ্টা ল্যাবরেটরি খোলা থাকে। প্রায় সব ধরনের ল্যাব টেস্ট এখানে করা হয়। অত্যাধুনিক অপারেশন থিয়েটার, আইসিইউ, বস্নাড ব্যাংক ও অ্যাম্বুলেন্স সুবিধা রয়েছে। এই ইনস্টিটিউটের আরেকটি বড় অবদান হচ্ছে কার্ডিওলজিস্ট তৈরির মাধ্যমে রোগীদের সেবা দেওয়া এবং হার্টের চিকিৎসা বিষয়ক গবেষণাকে প্রাধান্য দেওয়া। এখানে পোস্ট গ্রাজুয়েটে অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীরা নিয়মত বিভিন্ন গবেষণা কার্যক্রমে নিয়োজিত থাকার সুযোগ পাচ্ছেন। শিক্ষার্থীরা ট্রান্স রেডিয়াল এনজিওগ্রাম এবং ট্রান্স রেডিয়াল এনজিওপস্নাস্ট অর্থাৎ হাতে কলমে এনজিওগ্রাম ও এনজিওপস্নাস্ট করাতে পারেন। অন্যান্য সরকারি হাসপাতালে এই সুযোগ একেবারেই কম। যাযাদি : বলা হয় বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি মৃতু্যহার হৃদরোগে। এই রোগ থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার উপায় কী কী? ডা. মীর জামাল : হার্টের সমস্যাজনিত মৃতু্যহার অনেক বেশি, এটা শুধু বাংলাদেশেই নয়, সব দেশেই। তবে কারণগুলো এড়িয়ে চলতে পারলে মৃতু্যহার অনেকটা কমিয়ে আনা সম্ভব। এজন্য উচ্চরক্তচাপ ও ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখা, ধূমপান পরিহার, ডিসলিপিডিমিয়া বা রক্তে চর্বি জমতে না দেওয়া, কায়িক পরিশ্রম করা, সর্বোপরি স্বাস্থ্যসচেতন জীবন-যাপনের মাধ্যমে হৃদরোগসহ রক্তনালির রোগ থেকে বেঁচে থাকা সম্ভব। এভাবে হৃদরোগে মৃতু্যহারও কমে আসবে। যাযাদি : করোনাকালে রোগীদের সেবা দিতে গিয়ে কোন ধরনের চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হতে হয়েছে? ডা. মীর জামাল : দেশে করোনা সংক্রমণের শুরুতে এখানে রোগীর সংখ্যা কিছুটা কম হলেও বর্তমানে বেড়েছে। রোগীদের সেবা দিতে দিন-রাত চিকিৎসক, নার্স ওয়ার্ডবয় ও অন্য স্টাফসহ প্রায় ১৭শ' জনবল কাজ করেছে। করোনার মধ্যে সেবা দিতে গিয়ে হাসপাতালের প্রায় ৪শ' জনবল সংক্রমিত হয়েছেন। রোগীদের সেবা দিতে গিয়ে ডা. মনোয়ার হোসেন নামে হাসপাতালের একজন চিকিৎসক মৃতু্যবরণ করেছেন। আমি নিজেও করোনা আক্রান্ত হয়েছিলাম। হাসপাতালে নো মাস্ক নো সার্ভিস চালু করা হয়েছে। সরাসরি রোগীর সেবায় নিয়োজিতদের এন-৯৫ মাস্ক, হেড মাস্ক, গাউন, সু-কাভার, বিশেষ চশমা, হ্যান্ডগস্নাভস, স্যানিটাইজার নিয়মিত সরবরাহ করা হচ্ছে। রোগীর সঙ্গে অ্যাটেনডেন্স কমানো ও স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার ওপর সর্বাধিক গুরু দেওয়া হয়েছে। যাযাদি : হাসপাতালের ভবিষ্যৎ নিয়ে কি সুসংবাদ দেবেন? ডা. মীর জামাল: ১৭ জানুয়ারি প্রধানমন্ত্রীর দিকনির্দেশনায় এবং স্বাস্থ্যমন্ত্রী ও স্বাস্থ্য সচিবের তত্ত্বাবধানে জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউটকে ৪১৪ বিছানা থেকে ১২৫০-এ উন্নীত করা হয়েছে। শিগগিরই এই নির্দেশনা আমরা বাস্তবায়ন করতে পারব, ইনশাআলস্নাহ।