জামালপুরের বকশীগঞ্জ

মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতির ধারক কামালপুর স্মৃতিসৌধ

প্রকাশ | ০৩ মার্চ ২০২১, ০০:০০

জিএম ফাতিউল হাফিজ বাবু
জামালপুরের বকশীগঞ্জে শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের স্মরণে নির্মিত স্মৃতিসৌধ
মহান মুক্তিযুদ্ধে ১১ নম্বর সেক্টরটি ছিল গুরুত্বপূর্ণ। অন্য সেক্টরের চেয়ে এ সেক্টরে সবচেয়ে বেশি যুদ্ধ হয়। জামালপুর জেলার বকশীগঞ্জ উপজেলার ধানুয়া কামালপুর ১১ নম্বর সেক্টরের প্রধান ঘাঁটি ছিল। এ ঘাঁটি থেকে জামালপুর, শেরপুর, টাঙ্গাইল, নেত্রকোনা, কুড়িগ্রাম জেলা নিয়ন্ত্রণ করা হতো। ধানুয়া কামালপুরের পাশে ভারতের মহেন্দ্রগঞ্জ ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ কেন্দ্র। সেখান থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে পুরো এলাকাজুড়ে ছড়িয়ে পড়তেন বীর মুক্তিযোদ্ধারা। বিশাল এলাকাজুড়ে গঠিত ১১ নম্বর সেক্টরের আগে এই অঞ্চল যুদ্ধ পরিচালনা করত জেড ফোর্স। ৩১ জুলাই পর্যন্ত তৎকালীন মেজর জিয়াউর রহমান জেড ফোর্সের অধিনায়ক হিসেবে ধানুয়া কামালপুরে যুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন। ২ নম্বর সেক্টর গঠনের পর জিয়াউর রহমানকে ওই সেক্টরের কমান্ডারের দায়িত্ব দেওয়া হলে ১১ নম্বর সেক্টরের দায়িত্ব পান মেজর আবু তাহের (কর্নেল তাহের)। মেজর আবু তাহেরের নেতৃত্বেই ৮ বার এ সেক্টরে পাকিস্তানি সেনাদের সঙ্গে সম্মুখযুদ্ধ হয় মুক্তিযোদ্ধাদের। ১৯৭১ সালের ৩১ জুলাই সম্মুখযুদ্ধে পাকিস্তানি বাহিনীর গুলিতে ক্যাপ্টেন সালাউদ্দিন মমতাজ বীরউত্তম শহীদ হন। পরে সেক্টর কমান্ডার মেজর আবু তাহেরের পরিকল্পনা অনুযায়ী ২৪ নভেম্বর হানাদার বাহিনীর ধানুয়া কামালপুর ঘাঁটি অবরোধ করেন। অবরোধের প্রথম দিনই কামালপুর মির্ধাপাড়া মোড়ে সম্মুখযুদ্ধে মর্টার শেলের আঘাতে সেক্টর কমান্ডার মেজর আবু তাহের একটি পা হারান। পরে ভারপ্রাপ্ত সেক্টর কমান্ডারের দায়িত্ব নেন উইং কমান্ডার হামিদুলস্নাহ খান বীরপ্রতীক। ধানুয়া কামালপুর যুদ্ধে ক্যাপ্টেন সালাউদ্দিন মমতাজ (বীরউত্তম), মুক্তিযোদ্ধা গাজী আহাদুজ্জামান, তসলিম উদ্দিনসহ শহীদ হন ১৯৭ জন বীর মুক্তিযোদ্ধা। অন্যদিকে একজন ক্যাপ্টেনসহ হানাদার বাহিনীর ২২০ সৈন্য মারা যায়। ধানুয়া কামালপুর যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে ২৯ জনকে তাদের বীরত্বের জন্য বীরবিক্রম, বীরউত্তম ও বীরপ্রতীক খেতাব দেওয়া হয়। বকশীগঞ্জের বিভিন্ন স্থানে বধ্যভূমি থাকলেও অযত্ন-অবহেলায় রয়েছে সেগুলো। গণকবরগুলো কালের সাক্ষী হিসেবে দাঁড়িয়ে আছে। ইতোমধ্যে ধানুয়া কামালপুর ইউনিয়নের ধানুয়া গ্রামের ৮ নিরীহ মানুষকে হত্যার ঘটনায় গণকবরগুলো সংরক্ষণ করা হয়েছে। শহীদ বীর মুক্তিযোদ্ধাদের স্মরণে তৎকালীন বিডিআরের (বর্তমানে বিজিবি) নিজস্ব অর্থায়নে ধানুয়া কামালপুর স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করা হয়েছে। এই স্মৃতি সৌধটি ১১ নম্বর সেক্টরের মহান মুক্তিযুদ্ধের ধারক-বাহক হিসেবে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে রয়েছে। এখানে মুক্তিযোদ্ধাদের স্মরণে নির্মাণ করা হয়েছে ধানুয়া কামালপুর মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর। সেক্টর কমান্ডার মেজর আবু তাহেরের স্মৃতি রক্ষার্থে ইউনিয়ন পরিষদ মাঠে তাহের স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করা হয়েছে। বকশীগঞ্জ এনএম উচ্চ বিদ্যালয়ের পেছনের গণকবরটি ব্যক্তিগতভাবে সংরক্ষণ করা হয়েছে। আজঅবধি বকশীগঞ্জ সরকারি উলফাতুন্নেছা বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের পাক সেনাদের টর্চার শেলে নির্যাতনের শিকার হয়ে মৃতু্যবরণ করা মানুষের গণকবর সংরক্ষণ করা হয়নি। অযত্ন-অবহেলায় সেটি জঙ্গলে পরিণত হয়েছে। বাট্টাজোড় পশ্চিম দত্তের চর গ্রামের গণকবরটি এখনো সংরক্ষণ করা হয়নি। স্থানীয় বীরমুক্তিযোদ্ধা আলহাজ আবদুল মুন্নাফ জানান, মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় তার জেঠাতো ভাই মুজা আলীসহ ১৭ জনকে ব্রাশফায়ার করে হত্যা করে গণকবর দেওয়া হলেও এ গণকবরটি এখনো সংরক্ষণের উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। ১১ নম্বর সেক্টরের বীরমুক্তিযোদ্ধা ও সাবেক সহকারী অধ্যাপক আফসার আলী জানান, সদিচ্ছার কারণে আজ পর্যন্ত বকশীগঞ্জ পৌর এলাকায় মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক স্মৃতিস্তম্ভ গড়ে ওঠেনি। তিনি মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি বিজড়িত স্থান ধানুয়া কামালপুরের মির্ধাপাড়া মোড়ে বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য স্থাপনের দাবি জানান। বকশীগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) মুন মুন জাহান লিজা বলেন, বেশিরভাগই গণকবর ও স্মৃতিবিজড়িত স্থানগুলো সংরক্ষণ করা হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি ধরে রাখতে সব কার্যক্রম হাতে নেওয়া হয়েছে। ইতোমধ্যে উপজেলা প্রশাসনের উদ্যোগে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের হাতের ছাপে বাংলাদেশ নামে একটি মানচিত্র আঁকা হয়েছে। একই সঙ্গে বিভিন্ন ইউনিয়নের সড়কগুলো বীর মুক্তিযোদ্ধাদের নামে নামকরণ করার কার্যক্রম হাতে নেওয়া হয়েছে।