ভাষাসৈনিক চুন্নু মিয়ার স্বীকৃতি ও স্মৃতি সংরক্ষণের দাবি

প্রকাশ | ০৩ মার্চ ২০২১, ০০:০০

এম এইচ শিপন, বোরহানউদ্দিন (ভোলা)
ভোলার একমাত্র ভাষাসৈনিক রেজা-এ-করিম চৌধুরী চুন্নু। কিন্তু চুন্নু স্যার নামেই তিনি সমধিক পরিচিত। জেলার বোরহানউদ্দিন উপজেলার কুতুবা ইউনিয়নের আব্দুল জব্বার মিয়া বাড়িতে ১৯৩১ সালে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ১৯৭০ সালের নির্বাচনে এমএলএ নির্বাচিত হন। ছিলেন ভোলার মুক্তিযুদ্ধের প্রথম সারির সংগঠক। এছাড়া স্বাধীন বাংলাদেশের সংবিধান প্রণয়ন কমিটির অন্যতম সদস্যও ছিলেন। সাদাসিধে এ মানুষটি বিনা বেতনে শিক্ষকতা করেছেন বোরহানউদ্দিন মাধ্যমিক বিদ্যালয় ও আব্দুল জব্বার কলেজসহ ৪ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে। বর্ণাঢ্য কর্মজীবনের অধিকারী এ ব্যক্তি পৃথিবী ছেড়ে চলে যান ২০০৭ সালের ২ মার্চ (শুক্রবার)। ভাষা আন্দোলনের ৬৯ বছর পরও বিভিন্ন মহলের দাবি সত্ত্বেও ভোলার এ ভাষা সৈনিকের স্বীকৃতি ও তার স্মৃতি সংরক্ষণের উদ্যোগ আজও নেওয়া হয়নি। দেরিতে হলেও ভাষাসৈনিক রেজা-এ-করিম চৌধুরী চুন্নু মিয়ার স্বীকৃতি ও স্মৃতি সংরক্ষণের দাবি জানিয়েছেন ভোলার সচেতন মহল। ৭-৮ বছর আগে তৎকালীন জেলা প্রশাসক বেলায়েত হোসেন বরাবর চুন্নু মিয়ার স্মৃতি সংরক্ষণের দাবি সংবলিত স্মারকলিপি দেয় এলাকাবাসী; কিন্তু দাবি বাস্তবায়নের আশ্বাস পাওয়া গেলেও এখনো তা অধরাই রয়ে গেছে। চুন্নু মিয়ার ব্যক্তিগত ডায়রি ও ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস থেকে জানা যায়, তিনি ঢাকা কলেজে অধ্যয়ন করার সময় মাত্র ২১ বছর বয়সে ভাষা আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েন। ১৯৫২ সালে জিন্নাহর রাষ্ট্র ভাষা উর্দু ঘোষণার পর তার মধ্যে বিদ্রোহের আগুন জ্বলে উঠে। তখন তিনিসহ তার এক সহপাঠী তাৎক্ষণিকভাবে ঢাকা কলেজের ভিপি ইকবাল আনসার হেনরীর সফঙ্গ যোগাযোগ করে সর্বদলীয় রাষ্ট্র ভাষা সংগ্রাম পরিষদের নেতাদের সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করে ভাষা আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেন। তার ডায়েরি থেকে জানা যায়, ১৯৫২ সালে ২১ ফেব্রম্নয়ারি পূর্ব পাকিস্তান সরকার অপরাহ্নে ঢাকা শহরে ১৪৪ ধারা জারি করে। ছাত্র প্রতিনিধিরা আগেই ১৪৪ ধারা ভঙ্গের সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। চুন্নু মিয়ার ভাষায়, 'আমরা জানতাম ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে মিছিলে গেলে নিশ্চিত গুলি হবে। তারপরও মায়ের ভাষার প্রতি অপরিসীম ভালবাসা আমাকে মিছিলে যেতে উদ্বুদ্ধ করেছে। হঠাৎ মনে পড়ে আমি যদি আগামীকাল মিছিলে গিয়ে গুলিতে শহীদ হই তাহলে আমার লাশের সন্ধান হয়তো আত্মীয়রা পাবেন না। একথা ভেবে আমি রাতে বসেই আমার পুরো নাম-ঠিকানা সাদা কাগজে লিখে পকেটে ঢুকিয়ে রাখলাম। যাতে এ ঠিকানা অনুযায়ী আমার লাশ অন্তত স্বজনদের কাছে পৌঁছে দিতে পারে।' বায়ান্নর ২১ ফেব্রম্নয়ারি ভোর থেকেই ছাত্র নেতাদের পরামর্শ অনুযায়ী ৮/১০ জনের খন্ড মিছিল শুরু হলো। তাদের কলেজের তৃতীয় ব্যাচের মিছিলে ছিলেন তিনি। মিছিল যখন কলা ভবনের কাছে পৌঁছল তখন তাকেসহ অনেককে আটক করে পুলিশ ফাঁড়িতে নিয়ে যায় তারা। রাতে তাদের ফাঁড়িতে অবস্থান করতে হয়। সকালে পুলিশ তাকেসহ অন্যদের পুলিশ ভ্যানে করে কোর্টে নিয়ে যায়। কোর্টে হাজির না করেই এক ঘণ্টার মধ্যে তাদের কেন্দ্রীয় কারাগারে নেওয়া হয়। এরপর এক মাস কারাভোগের পর ২১ মার্চ মুক্ত আকাশের চোখ দেখেন তিনি। স্বীকৃতি ও স্মৃতি সংরক্ষণের ব্যাপারে চুন্নু মিয়ার বড় ছেলে কবির চৌধুরী ও ছোট ছেলে মাহাবুব-উল আলম চৌধুরী বলেন, বাবার মুখে আমরা ভাষা আন্দোলনের সেই গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকার কথা শুনেছি। ওইসময় তিনি স্বীকৃতি, স্মৃতি সংরক্ষণ হবে বা হবে না- এ চিন্তা করে আন্দোলনে যোগ দেননি। মায়ের ভাষা বাংলার জন্য আন্দোলনে যোগ দিয়েছেন তিনি। এখন রাষ্ট্র চাইলে ১৯৫২ সালের জেল রেকর্ড তলব করলেই ঘটনার সত্যতা বেরিয়ে আসবে। তারা মনে করেন, রাষ্ট্র উদ্যোগী হয়ে ভাষাসৈনিকদের পূর্ণাঙ্গ তালিকা প্রকাশ করা উচিত। বোরহানউদ্দিন পৌরসভার মেয়র মো. রফিকুল ইসলাম বলেন, অচিরেই ভাষাসৈনিক চুন্নু স্যারের নামে নবনির্মিত একটি সুপরিসর সড়কের নামকরণ করা হবে। ভোলা-২ (বোরহানউদ্দিন-দৌলতখান) আসনের সংসদ সদস্য আলী আজম মুকুল জানান, 'চুন্নু স্যার আমার প্রিয় শিক্ষক। স্যারের নামে বোরহানউদ্দিন উপজেলার প্রবেশ দ্বারে একটি সুদৃশ্য তোরণ নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল; কিন্তু ভোলা-চরফ্যাশন সড়ক প্রসস্তকরণ পরিকল্পনার পর ওই উদ্যোগ স্থগিত করা হয়। সড়ক প্রসস্তকরণের পরপরই বোরহানউদ্দিন উপজেলার প্রবেশ দ্বারে তোরণ নির্মাণ হবে।' ছবি ১. ভাষাসৈনিক রেজা-এ-করিম চৌধুরী চুন্নু মিয়া ২. ভাষাসৈনিক রেজা-এ-করিম চৌধুরী চুন্নু মিয়ার বাড়ি ৩. বাংলাদেশের সংবিধান প্রণয়ন কমিটির সদস্য হিসেবে সংরক্ষিত স্বাক্ষর