মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

শ্রদ্ধা-ভালোবাসায় এইচ টি ইমামের চিরবিদায়

যাযাদি রিপোর্ট
  ০৫ মার্চ ২০২১, ০০:০০
বীর মুক্তিযোদ্ধা, প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা ও স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম মন্ত্রিপরিষদ সচিব এইচ টি ইমামের মরদেহ কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে নেওয়া হলে সর্বস্তরের মানুষ শ্রদ্ধা নিবেদন করেন -ফোকাস বাংলা

রাজধানীর বনানী কবরস্থানে চিরনিদ্রায় শায়িত হলেন স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম মন্ত্রিপরিষদ সচিব ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার রাজনৈতিক উপদেষ্টা এইচ টি ইমাম। এর আগে ঢাকা জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে এই বীর মুক্তিযোদ্ধার প্রতি রাষ্ট্রীয় সম্মান জানানো হয়।

এদিকে বৃহস্পতিবার দুপুরে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে তার কফিনে ফুল দিয়ে শেষ শ্রদ্ধা জানান বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও সংগঠনের প্রতিনিধি এবং বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ। পরে বাদ আসর গুলশান আজাদ মসজিদে তার দ্বিতীয় জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। জানাজায় মরহুমের আত্মীয়স্বজন, আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতা, মন্ত্রিপরিষদের সদস্য, বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের বর্তমান ও সাবেক সচিব, সরকারের বিভিন্ন দপ্তরের পদস্থ কর্মকর্তা, তার দীর্ঘ কর্মজীবনের সহকর্মী এবং সহযোদ্ধারা অংশ নেন। জানাজার আগে মুসলিস্নদের উদ্দেশে সংক্ষিপ্ত কথা বলেন এইচ টি ইমামের ছেলে তানভীর ইমাম এমপি। তিনি তার বাবার পক্ষে সবার কাছে ক্ষমা ও দোয়া চান।

কিডনি জটিলতায় প্রায় দুই সপ্তাহ ধরে ঢাকার সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় বুধবার দিবাগত রাত ১টা ১৫ মিনিটে এইচ টি ইমাম মারা যান।

বৃহস্পতিবার সকালে মরদেহ হেলিকপ্টারে জন্মস্থান সিরাজগঞ্জের উলস্নাপাড়ায় নেওয়া হয়। সেখানে আকবর আলী সরকারি কলেজ মাঠে এইচ টি ইমামের প্রথম জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। বেলা দেড়টার দিকে এইচ টি ইমামের মরদেহ কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার প্রাঙ্গণে নিয়ে আসা হলে সেখানে সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের ব্যবস্থাপনায় বিকাল সাড়ে ৩টা পর্যন্ত সর্বস্তরের মানুষ তার কফিনে শ্রদ্ধা নিবেদন করে।

প্রথমে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদের পক্ষে তার সামরিক সচিব মেজর জেনারেল এস এম সালাহ উদ্দিন ইসলাম এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পক্ষে তার সামরিক সচিব মেজর জেনারেল নকিব আহমদ চৌধুরী কফিনে ফুল দেন। এরপর জাতীয় সংসদের স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরীর পক্ষ থেকে সংসদের সার্জেন্ট অ্যাট আর্মস কমোডর এম এম নাঈম রহমান শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। আর প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের পক্ষে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন মুখ্য সচিব ডক্টর আহমদ কায়কাউস।

মুক্তিযুদ্ধের সময় প্রবাসী সরকারের মন্ত্রিপরিষদ সচিবের দায়িত্ব পালন করা এইচ টি ইমাম ২০১৪ সাল থেকে প্রধানমন্ত্রীর রাজনৈতিক উপদেষ্টার দায়িত্ব পালন করে আসছিলেন। ১৯৭১ সালে পাকিস্তান সরকারের চাকরিতে থাকা অবস্থায় পাকিস্তানের প্রতি আনুগত্য ত্যাগ করে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিয়েছিলেন এইচ টি ইমাম। স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম মন্ত্রিপরিষদ সচিবও তিনি।

আওয়ামী লীগের পক্ষে সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের, উপদেষ্টা পরিষদ সদস্য মুকুল বোস, সভাপতিমন্ডলীর সদস্য জাহাঙ্গীর কবীর নানক, আব্দুর রহমান, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব উল আলম হানিফ, সংস্কৃতি বিষয়ক সম্পাদক অসীম কুমার উকিল, উপদপ্তর সম্পাদক সায়েম খান ফুল দিয়ে দলের উপদেষ্টা পরিষদ এই সদস্যকে শেষ বিদায় জানান। শ্রদ্ধা জানাতে আসেন তথ্যমন্ত্রী হাছান মাহমুদ, স্থানীয় সরকার, পলস্নী উন্নয়ন ও সমবায়মন্ত্রী মো. তাজুল ইসলাম; সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী কে এম খালিদ ও জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেন। যুবলীগের চেয়ারম্যান শেখ ফজলে শামস পরশ এবং ছাত্রলীগের সভাপতি আল নাহিয়ান খান জয় ও সাধারণ সম্পাদক লেখক ভট্টাচার্যের নেতৃত্বে সংগঠন দুটির নেতাকর্মীরাও এইচ টি ইমামের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপস, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক মো. আখতারুজ্জামান ও প্রক্টর অধ্যাপক এ কে এম গোলাম রব্বানীসহ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক কর্মকর্তারাও শ্রদ্ধা জানান।

শ্রদ্ধা জানাতে এসে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেন, 'এইচ টি ইমাম মেধা ও শ্রম দিয়ে সরকারকে যেমন সমর্থন করেছেন, তেমনি করে তিনি দেশের অনেক কাজ করেছেন। আওয়ামী লীগের প্রচার সেলের দায়িত্বও পালন করেছেন তিনি। তিনি হাসপাতালে যাওয়ার পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত সক্রিয় ছিলেন। চাকরি থেকে অবসর নিয়েছেন; কিন্তু কাজ থেকে তিনি কখনো অবসর নেননি, এমন কর্মপাগল, কর্মনিষ্ঠ মানুষ ছিলেন এইচ টি ইমাম। তার মৃতু্যতে যে শূন্যতা তৈরি হবে, তা সহজে পূরণ হওয়ার নয়।'

তথ্যমন্ত্রী হাছান মাহমুদ বলেন, 'এইচ টি ইমাম ছিলেন একজন অত্যন্ত দক্ষ, কর্মঠ, প্রাণবন্ত মানুষ। আমরা কখনো ভাবিনি তিনি হঠাৎ করে চলে যাবেন। এই করোনাকালেও তিনি ভালোভাবে কাজ-কর্ম চালিয়ে গেছেন। তিনি বয়সে বৃদ্ধ হলেও মনের দিক থেকে ছিলেন তরুণ। তার মতো বুদ্ধিদীপ্ত মানুষ খুব কমই আছে।'

আওয়ামী লীগের বিভিন্ন অঙ্গসংগঠন, জাসদ, বাংলাদেশ পুলিশ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশন, বাংলাদেশ পূজা উদযাপন কমিটি, জাতীয় কবিতা পরিষদ, স্বাধীনতা চিকিৎসা পরিষদ, আইন উপকমিটি, বাংলাদেশ গণসংগীত পরিষদসহ বিভিন্ন সংগঠন ও প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকেও ফুলের শ্রদ্ধা জানানো হয় আওয়ামী লীগের উপদেষ্টামন্ডলীর এই প্রয়াত সদস্যের প্রতি।

হোসেন তৌফিক ইমামের জন্ম ১৯৩৯ সালে, পরে তিনি এইচ টি ইমাম নামেই পরিচিত হয়ে ওঠেন। বাবার চাকরি সূত্রে তার শৈশব-কৈশোর কেটেছে বিভিন্ন জেলায়। ম্যাট্রিক পাস করেন ঢাকা কলেজিয়েট স্কুল থেকে। পাবনা অ্যাডওয়ার্ড কলেজ থেকে পাস করেন ইন্টারমিডিয়েট। রাজশাহী কলেজ থেকে বিএ ডিগ্রি নিয়ে তিনি ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে, অর্থনীতিতে এমএ ডিগ্রি অর্জন করেন। তখন তিনি বাম ছাত্র সংগঠনে যুক্ত ছিলেন।

পড়াশোনা শেষে এইচ টি ইমাম শিক্ষকতায় যোগ দিয়েছিলেন রাজশাহী সরকারি কলেজে, অর্থনীতির প্রভাষক হিসেবে। এরপর পাকিস্তানে সিভিল সার্ভিস পরীক্ষায় অংশ নিয়ে সরকারি চাকরিতে পোস্টগ্র্যাজুয়েট ডিপেস্নামা করেন লন্ডনের স্কুল অব ইকোনমিকস থেকে।

স্বাধীনতার পর ১৯৭৫ সালের ২৬ আগস্ট পর্যন্ত তিনি মন্ত্রিপরিষদের সচিবের দায়িত্বে ছিলেন। এরপর ১৯৭৮ থেকে ১৯৮৪ সাল পর্যন্ত সাভারের লোকপ্রশাসন প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের প্রকল্প পরিচালকের দায়িত্ব পালন করেন। পরে তিনি যোগাযোগ ও পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের সচিবও হন।

অবসর নেওয়ার পর আওয়ামী লীগে সক্রিয় হন এইচ টি ইমাম। দলের নির্বাচন পরিচালনার গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করে আসছিলেন তিনি। আওয়ামী লীগের নির্বাচন পরিচালনা কমিটির কো-চেয়ারম্যান ছিলেন, যে কমিটির চেয়ারম্যান শেখ হাসিনা।

২০০৯ সালে সরকার গঠনের পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাকে উপদেষ্টার দায়িত্ব দেন। প্রথমে তিনি জনপ্রশাসন বিষয়ক উপদেষ্টা ছিলেন। ২০১৪ সালে তাকে প্রধানমন্ত্রীর রাজনৈতিক উপদেষ্টা নিয়োগ করা হয়। মুক্তিযোদ্ধা পরিচালনা বিষয়ে এইচ টি ইমামের রচিত কয়েকটি গ্রন্থকে বেশ গুরুত্ব দেন গ্রন্থ সমালোচকরা।

এদিকে এইচ টি ইমামের মৃতু্যতে সাবেক যোগাযোগমন্ত্রী আবুল হোসেন গভীর শোক ও দুঃখ প্রকাশ করেন। তিনি মরহুমের রুহের মাগফিরাত কামনা করেন এবং শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানান। জনতা ব্যাংক লিমিটেডের পরিচালনা পর্ষদ এইচ টি ইমামের মৃতু্যতে শোক প্রকাশ করেছে। ব্যাংকের এমডি অ্যান্ড সিইও বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুছ ছালাম আজাদ জাতীয় শহীদ মিনারে তার মরদেহে পুষ্পস্তবক অর্পণ করেন। এ সময় ব্যাংকের ঊর্ধ্বতন নির্বাহী কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। শোক বার্তায় আব্দুছ ছালাম আজাদ বলেন, মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উজ্জীবিত হয়ে সরকারি কর্মকর্তা হিসেবে সদ্য স্বাধীন দেশ পরিচালনায় তার অগ্রণী ভূমিকা জাতি চিরদিন শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করবে।

জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক হারুন-অর-রশিদ ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক মো. গিয়াস উদ্দিন মিয়া এইচ টি ইমামের মৃতু্যতে শোক ও দুঃখ প্রকাশ করেন। শোক বার্তায় উপাচার্যরা মরহুমের বিদেহী আত্মার মাগফিরাত কামনা করেন।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে