রক্তে কেনা আমার স্বাধীনতা

১০ হাজার কঙ্কালের স্মৃতি বহন করছে বেলতলী বধ্যভূমি

লাকসাম (কুমিলস্না)

প্রকাশ | ০৫ মার্চ ২০২১, ০০:০০

আরিফুর রহমান স্বপন
কুমিলস্নার লাকসামের বেলতলী বধ্যভূমি -যাযাদি
একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর নিষ্ঠুর নির্যাতন ও হত্যাযজ্ঞের স্মৃতি বহন করছে লাকসামের বেলতলী বধ্যভূমি। '৭১-এর যুদ্ধকালীন সময়ে কুমিলস্নার লাকসাম রেলওয়ে জংশনের দক্ষিণে বেলতলীতে প্রায় ১০ হাজার বাঙালিকে নির্মমভাবে হত্যার পর লাশ মাটিচাপা দিয়েছিল পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী। মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি বাহিনী লাকসাম রেলওয়ে জংশনের পাশে থ্রি-এ সিগারেট ফ্যাক্টরিতে ঘাঁটি করে। এখানে কারও প্রাণ গেছে টর্চারশেলে আবার কারও প্রাণ গেছে বধ্যভূমিতে। যাদের ধরে এনে মাটিচাপার জন্য গর্ত করানো হতো আবার তাদের হাত-পা বেঁধে গর্তের পাড়ে চালানো হতো গুলি। বুকে গুলি নিয়েও বেঁচে থাকতেন অনেকে। তাও শেষ রক্ষা হতো না। তাদেরও দেওয়া হতো মাটিচাপা। এ ঘাঁটিতে মুক্তিযোদ্ধাসহ সাধারণ মানুষকে ধরে এনে নির্বিচারে হত্যা করে ৫শ গজ দূরে বেলতলী বধ্যভূমিতে মাটিচাপা দেওয়া হতো। এখানে মাটির নিচে শায়িত আছে প্রায় ১০ হাজার বাঙালি। মাটি খুঁড়লেই মিলবে তাদের হাড় কঙ্কাল। পাকিস্তানি বর্বরতা ও নৃশংসতার সাক্ষ্ণী বেলতলীর সেই বেলগাছটি নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে বধ্যভূমির সাক্ষী হিসেবে জন্ম নেওয়া খেজুর গাছটিও এখন আর নেই। ২০০০ সালের দিকে হইচই পড়েছিল বধ্যভূমি স্মৃতি রক্ষার। এরপর যথারীতি থেমে গেছে। লাকসাম রেলওয়ে জংশনের দক্ষিণ পাশে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালে তৈরি করা বাঙ্কারের উত্তর ও দক্ষিণের জায়গাজুড়ে বধ্যভূমির অবস্থান। এর আয়তন প্রায় ৩ হাজার বর্গমিটার। রেলওয়ে জংশন থেকে বিভিন্ন স্থানে পাড়ি দিতে আসা কুমিলস্না জেলার দক্ষিণাঞ্চল, বৃহত্তর নোয়াখালী ও চাঁদপুরের হতভাগ্য বাঙালি যুবক-যুবতী, বৃদ্ধ নারী-পুরুষ এবং ছোট্ট শিশুদের বর্বর নির্যাতনের পর এখানে মাটিচাপা দিত পাকিস্তানি সেনারা। বধ্যভূমির সে সময়ের জীবন্ত সাক্ষী লাকসাম রেলওয়ে জংশন কলোনির শ্রীদাম চন্দ্র দাশ এভাবেই ওই হত্যাযজ্ঞের বর্ণনা করেন। ৬৯ বছর বয়সী শ্রীদাম চন্দ্র দাশ জানান, নিজেদের জীবন বাঁচাতে বাধ্য হয়ে ওই সময় সিগারেট ফ্যাক্টরি থেকে তার মামা সুরেন্দ্র দাশ ও উপেন্দ্র দাশ নারী-পুরুষের প্রায় ১০ হাজার লাশ নিয়ে বধ্যভূমিতে গর্ত করে মাটিচাপা দিয়েছে। বধ্যভূমির মাটি খুঁড়লেই সন্ধান মিলবে হাজার হাজার বাঙালির হাড়-কঙ্কাল। শ্রীদাম একাই হাজারখানেক লাশ মাটিচাপা দিয়েছেন। সব মিলিয়ে সংখ্যা কত হবে তার জানা নেই, তবে ১০ হাজারেরও বেশি হবে বলে শ্রীদাম জানায়। শ্রীদাম জানান, সে সময় সাধারণ মানুষ লাকসাম জংশন দিয়ে দেশের বিভিন্ন স্থানে যাতায়াত করতেন। আর এদের ওপর চালানো হতো বর্বর নির্যাতন। একদিন চাঁদপুর থেকে ধরে আনা হলো ১১ কলেজছাত্রীকে। মাসখানেক তাদের আটকে রাখা হলো থ্রি-এ সিগারেট ফ্যাক্টরি টর্চারশেলে। চালানো হলো পাকিস্তানি পাশবিক নির্যাতন। পরে এক-এক করে তাদের হত্যা করে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী। শ্রীদাম বলেন, লাকসাম জংশনে থাকত বিহারি পুলিশ বাকাউল হাবিলদার। লাকসাম পাকিস্তানি বাহিনীকবলিত হলে বহু মুক্তিযোদ্ধা আর স্বাধীনতা পক্ষের লোকজনকে কৌশলে ধরে এনে এখানে হত্যা করেছে বিহারি বাকাউল হাবিলদার। সে লাকসামের মুক্তিযোদ্ধা আবদুল খালেক, কুমিলস্নার আমোদ পত্রিকার সাংবাদিক আবুল খায়ের, পাইকপাড়ার ছোবাহান, পীরে কামেল নুরু মিয়াসহ অসংখ্য লোকজনকে ধরে এনে এখানে হত্যা করেছে। স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা জাহাঙ্গীর মাওলা চৌধুরী জানান, শ্রীদাম ছাড়াও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. শান্তি রঞ্জন দাশও বধ্যভূমির একজর নীরব সাক্ষী। তিনি সে সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলেন। যুদ্ধের সময় তিনি অসুস্থ হয়ে পড়লে বাবার কর্মস্থল লাকসাম রেওয়ে জংশনে চলে আসেন এবং হাসপাতালে ভর্তি হন। হাসপাতালের প্রায় ৫০-৬০ গজ দুরেই এই বধ্যভূমি। একবার পাকিস্তানি সেনারা শান্তি রঞ্জনকে ধরে নিয়ে যায়। উর্দু জানার কারণে সৌভাগ্যক্রমে তিনি বেঁচে যান। তার মতে, এ ছাড়া এ বধ্যভূমির আর কোনো জীবন্ত সাক্ষী নেই। তবে শ্রীদাম একমাত্র প্রত্যক্ষ ও জীবন্ত সাক্ষী। স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা আবদুল বারী মজুমদার, মুক্তিযোদ্ধা আবুল হোসেন ননী জানায়, মুক্তিযুদ্ধের প্রথম সাপ্তাহে পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে সম্মুখযুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধাসহ বহু লোক নিহত হন। এদের মধ্যে মোস্তফা কামাল ও সোলায়মান নামে দুই ভাই, মিশ্রীর আবদুল খালেক, কামড্ডা গ্রামের আবুল খায়েরের স্মৃতি এখনো ভুলতে পারছে না কেউ। ১৯৭১ সালে মুক্তিযোদ্ধাদের সংগঠিত করা এবং সুষ্ঠুভাবে যুদ্ধ পরিচালনার জন্য বৃহত্তর লাকসামকে ৪টি সেক্টরে ভাগ করা হয়। ৪টি সেক্টরের যুদ্ধকালে কমান্ডার হিসেবে মো. আবু তাহের মজুমদার, মো. ছায়েদুল ইসলাম, অ্যাডভোকেট আবুল বাশার ও মো. আবদুল মালেক দায়িত্ব পালন করেন। পাকিস্তানিরা এ অঞ্চলের চারদিকের সীমানা নিয়ে গঠিত ৪টি সেক্টর কমান্ডের সঙ্গে একাধিক পস্নাটুন গেরিলা যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। লাকসামের উত্তরে বিজয়পুর (বর্তমান সদর দক্ষিণ উপজেলা), পশ্চিমে চাঁদপুর জেলার শাহরাস্তি উপজেলা, দক্ষিণে নোয়াখালী জেলার বর্তমানে সোনাইমুড়ী উপজেলা এবং পূর্বে বর্তমান চৌদ্দগ্রাম উপজেলার ভারত সীমান্ত ছিল এ অঞ্চলের যুদ্ধকালীন এলাকা। লাকসাম হাইস্কুল মাঠে তৎকালীন ছাত্রনেতা মরহুম নজির আহমেদ ভুঁইয়ার নেতৃত্বে স্বাধীনতাকামী মুক্তিযোদ্ধারা ১১ ডিসেম্বর প্রথম স্বাধীনতার পতাকা উত্তোলনের মধ্যদিয়ে এ অঞ্চলকে শত্রম্নমুক্ত করেন। বেলতলী বধ্যভূমি বিষয়ে মুক্তিযোদ্ধা আবদুল বারী মজুমদার জানান, মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের পরিচালক ২০০০ সালে জানিয়েছিলেন, ইন্টারন্যাশনাল কোয়ালিশন অব হিস্ট্রোরিক সাইট মিউজিয়ামস অব কনসেন্সের সহায়তায় লাকসামের বেলতলী, জয়পুরহাট ও বগুড়া এ তিনটি বধ্যভূমির খনন কাজ করা হবে। কিন্তু এ পর্যন্ত আর কিছুই হয়নি। বর্তমানে অযত্ন আর অবহেলায় রেলওয়ে পাথরের নিচে মাটিচাপা পড়ে আছে প্রায় ১০ হাজার বাঙালির হাড়-কঙ্কাল। মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিবিজড়িত এ স্থানটি চিহ্নিতকরণে ২০০৮ সালে এগিয়ে আসেন লে. জেনারেল (অব.) হারুনুর রশিদ বীরপ্রতীক। তার সৌজন্যে কুমিলস্নার সাবেক মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার মুক্তিযোদ্ধা সফিউল আলম বাবুল ওই সময় বেলতলী বধ্যভূমিতে একটি স্মৃতিফলক স্থাপন করেন। পরে ২০১৪ সালে স্থানীয় সংসদ সদস্য বর্তমান স্থানীয় সরকার, পলস্নীউন্নয়ন ও সমবায়মন্ত্রী মো. তাজুল ইসলামের আন্তরিক প্রচেষ্টায় তার ব্যক্তিগত তহবিল, জেলা পরিষদ, রেলওয়ের একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ও মুক্তিযোদ্ধা সংসদের যৌথ অর্থায়নে বেলতলী বধ্যভূমিতে একটি স্মৃতিস্তম্ভ স্থাপন করা হয়। রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে এই স্মৃতিস্তম্ভটি এখন হারিয়ে যেতে বসেছে। ক্যাপশন অযত্ন আর অবহেলায় পড়ে আছে লাকসামের বেলতলী বধ্যভূমি।